আমার প্রশাসনের সময় আমরা ভারত ও আমার ভালো বন্ধু প্রধানমন্ত্রী মোদির সঙ্গে আমাদের বৃহত্তর অংশীদারি আরো জোরদার করব।’ সবাইকে দীপাবলির শুভেচ্ছা জানিয়ে পোস্ট শেষ করেছেন ডোনাল্ড ট্রাম্প। তিনি বলেছেন, ‘আমি আশা করি, আলোর এই উৎসব খারাপকে হটিয়ে শুভর বিজয় নিয়ে আসবে।’
এ ধরনের টুইট বা বক্তব্য দিয়ে গোলমাল বাধানোর রেকর্ড আছে ট্রাম্পের। ২০১৮ সালে দীপাবলির শুভেচ্ছা-টুইট ঘিরে বিতর্ক বাধিয়েছিলেন। দীপাবলির শুভেচ্ছা জানিয়ে টুইটে হিন্দুদের কথাই বলেননি। সমালোচনার জেরে বিড়ম্বনার মুখে প্রথম টুইট মুছে ফের করেন। সেখানে হিন্দুদের বদলে আনেন বৌদ্ধ, শিখ, জৈনদের কথা। পরে তা আবার কারেকশন করেন। এবার এখন পর্যন্ত সে ধরনের কিছু করেননি। তবে ধর্মীয় বিষয় নিয়ে নাড়াচাড়া করছেন আচ্ছামতো, যার একটির টুইস্ট পড়েছে ভারত-বাংলাদেশে একযোগে।
বাংলাদেশে হিন্দু বৌদ্ধ খ্রিস্টান ঐক্য পরিষদসহ সংখ্যালঘু সংগঠন ও ব্যক্তি এ নিয়ে অনেক কিছু হাসিলের অপেক্ষা করছেন। জুলাই বিপ্লবে তাঁদের ওপর অনেক নির্যাতন-সহিংসতা হয়েছে বলে চালানো বয়ানের তেজ বাড়ানোর চেতনা বোধ করছেন। পর পর চট্টগ্রামে বিশাল শোডাউন হয়েছে। চড়া গলায় সেখান থেকে কঠোর কঠোর বার্তা দেওয়া হয়েছে। এবার দেখিয়ে দেওয়ার ভাব তাঁদের। ট্রাম্প গদিতে এলে কিছু একটা ঘটানোর মতিগতি। ‘বাংলাদেশ সনাতন জাগরণ মঞ্চ‘ নামে আট দফা বা মন্ত্র ছোড়া হয়েছে। দাবিগুলোর মধ্যে ট্রাইব্যুনাল গঠন করে সংখ্যালঘু নির্যাতনের বিচার, সংখ্যালঘু কমিশন সুরক্ষা আইন প্রণয়ন, সংখ্যালঘু মন্ত্রণালয় গঠন এবং দুর্গাপূজায় পাঁচ দিন ছুটি এর মধ্যে অন্যতম। হিন্দু ধর্মীয় কল্যাণ ট্রাস্ট হিন্দু ফাউন্ডেশনে উন্নীতকরণ, বৌদ্ধ ও খ্রিস্টান ধর্মীয় কল্যাণ ট্রাস্টও ফাউন্ডেশনে উন্নীতকরণ, দেবোত্তর সম্পত্তি পুনরুদ্ধার ও সংরক্ষণ আইন প্রণয়ন এবং অর্পিত সম্পত্তি প্রত্যর্পণ আইন বাস্তবায়ন, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে উপাসনালয় নির্মাণ ও হোস্টেলে প্রার্থনা রুম, সংস্কৃত ও পালি শিক্ষা বোর্ড আধুনিকায়নের দাবির সঙ্গে জানতে চাওয়া হয়েছে ১. হিন্দুদের দেবোত্তর সম্পত্তি দখল করা হচ্ছে, সরকার নিশ্চুপ কেন? ২. রাষ্ট্রীয়ভাবে ৫৬০টি মডেল মসজিদ করা হয়েছে, একটি মন্দির বা গির্জা কেন করা হয়নি? ৩. ফেসবুকে ধর্ম অবমাননার অভিযোগে অনেক হিন্দু যুবক জেল খাটছে। কিন্তু শত শত ফেসবুক প্রফাইল এবং ওয়াজে সুস্পষ্টভাবে হিন্দু ধর্মকে সমালোচনা ও কটূক্তি করা হয়েছে ও হচ্ছে। এসব প্রমাণ থাকা সত্ত্বেও তাদের গ্রেপ্তার করা হচ্ছে না কেন? ৪. নিয়মিতভাবে প্রতিমা ভাঙা, মন্দিরে হামলা, দুর্গাপূজায় পেট্রলবোমা নিক্ষেপ হচ্ছে। এদের গ্রেপ্তার করে শাস্তি দেওয়া হচ্ছে না কেন? ৫. নতুন সরকারের কোনো দায়িত্বশীল উঁচু পদে; যেমন—সচিব, সেনা কর্মকর্তা, পুলিশ কর্মকর্তা, বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য, বিভিন্ন অধিদপ্তরের পরিচালক প্রভৃতি পদে যোগ্য লোক থাকা সত্ত্বেও কোনো হিন্দুকে নিয়োগ দেওয়া হচ্ছে না কেন?
মন্ত্র-দাবি যেটাই হোক, প্রশ্ন হচ্ছে এসব দফারফার ফের নিয়ে। আর পাল্টা প্রশ্ন তো আছেই। এ সময়টা বেছে নিলেন কেন? গত ১৫ বছর আওয়াজ না দিয়ে এখন কার কল্যাণে, কাকে ঘায়েল করতে মাঠে নামা? সরকারকে বিব্রতকর অবস্থায় ফেলতে? এসব দাবির বিষয়ে বিগত ১৫ বছর কী তৎপরতা ছিল? দাবিগুলো নিয়ে বর্তমান সরকারের সঙ্গে আলোচনায় বসার চেষ্টা করেছেন? বসেছেন কোনো রাজনৈতিক দলের সঙ্গে? শুরুতেই আলোচনায় না গিয়ে ঘটা করে সমাবেশ-শোডাউন কোন উদ্দেশ্যে? অনুষ্ঠানে ভারতীয় দূতাবাসের প্রতিনিধি থাকলেও সরকারি প্রতিনিধি রাখার দরকার মনে করলেন না কেন? তা দরকার মনে না করার কারণ থাকতেই পারে। ১৫ বছর এভাবে দাবি-বায়না নিয়ে নামেননি বলে এখন নামতে পারবেন না এমন কথা নেই। এ ছাড়া তাঁদের যৌক্তিক দাবিগুলো মানা বা বিহিত করা অবশ্যই দরকার। প্রশ্নটা অন্যখানে। তাঁরা কি আসলে দাবি আদায়ের জন্য নেমেছেন, নাকি বাজে রকমের পরিস্থিতি তৈরির মতলবে নেমেছেন? ধর্মীয় বিভাজন তৈরি করে বিশৃঙ্খলা সৃষ্টির অপচেষ্টা এখন যত না ষড়যন্ত্র, তার চেয়ে বেশি রাজনীতি। পরাজিত বা বিতাড়িতদের এমন কিছু করা ছাড়া রাজনীতির আর কোনো ফাঁকফোকর থাকে না।
এসবের নেপথ্যে আরো অনেক কিছু রয়েছে। সরকার এ প্রশ্নে এখনো উদারতার পথে। সমাবেশে বাধা দেওয়া হয়নি। সমাবেশের পরও কাউকে এ ব্যাপারে জিজ্ঞাসাবাদের তথ্য নেই। এটি অবশ্যই সরকারের এক ধরনের উদারতা। আট দফা দাবি তোলা সমাবেশটি সাধুসন্তদের উদ্যোগে অনুষ্ঠিত হওয়ায় বিশেষ তাৎপর্য রয়েছে। এতে হিন্দু সম্প্রদায়ের বিপুলসংখ্যক মানুষের উপস্থিতি গণমাধ্যমের দৃষ্টি আকর্ষণ করেছে। দাবি আদায়ের জন্য ঢাকা অভিমুখে লংমার্চের ঘোষণাও দেওয়া হয় সমাবেশ থেকে। সমাবেশের প্রধান বক্তা চিন্ময় কৃষ্ণ দাস ব্রহ্মচারী গণমাধ্যমকে বলেন, তাঁরা সরকারের দৃষ্টি আকর্ষণ করতে চেয়েছেন। এ অধিকার তাঁদের অবশ্যই রয়েছে। আগেও ছিল। কিন্তু তখন অধিকার চর্চা করেননি কেন? এখন করছেন বিশেষ কিছু একটার আশায়। প্রতিবেশী ভারত থেকে অবিরাম সেই আশার জোগান মিলছে। তারপর এখন সুদূর যুক্তরাষ্ট্র থেকে সেই আশার ঢোলে বাড়ি পড়ছে। এরই মধ্যে স্পষ্ট ৩১ অক্টোবর বাংলাদেশ সময় রাত ১১টায় পোস্ট করা ট্রাম্পের এই টুইটের মাঝে তাঁরা একটি প্রাণশক্তির ঘ্রাণ পাচ্ছেন।
৫ আগস্ট আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর বাংলাদেশ ও বিশ্বের সবচেয়ে বড় হিন্দু অধ্যুষিত রাষ্ট্র ভারতের সম্পর্কে ভাটা আর স্নায়ুতে নেই। তা একদম প্রকাশ্যে। পরিবর্তিত এই পরিস্থিতিতে যুক্তরাষ্ট্রের আসন্ন প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে রিপাবলিকান পার্টির প্রেসিডেন্ট প্রার্থী ডোনাল্ড ট্রাম্পের টুইট বাংলাদেশকে কী বার্তা দিয়েছে, এ নিয়ে নানা বিশ্লেষণ চলছে। এটি স্রেফ নির্বাচনী একটি ট্রিট বা প্রচারণা, নাকি ইউনূস সরকারকে চাপে ফেলতে ভারতীয় কোনো কৌশল, তা এখনো পরিষ্কার নয়। বাংলাদেশের সামগ্রিক পরিস্থিতি নিয়ে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র পুরোপুরি অবগত। কিন্তু ট্রাম্প কতটা অবগত, তা নিয়ে সন্দেহ আছে অনেকের। ভুল তথ্য দিয়ে তাঁকে বিভ্রান্ত করা হয়েছে কি না—এ প্রশ্নও আছে। এ ছাড়া শেখ হাসিনা সরকারের পতনের পর থেকেই বাংলাদেশের অভ্যন্তরীণ রাজনীতির ব্যাপারে ভারতের কিছু গণমাধ্যমের অতিরিক্ত আগ্রহ। দেশটির কিছু ডানপন্থী মিডিয়া ও রাজনীতিবিদ এ ধরনের মন্তব্য বা ঘটনার জন্য বরাবরই অপেক্ষায় থাকেন। তা অতিরঞ্জিতভাবে উপস্থাপনে তাঁদের জুড়ি নেই। ট্রাম্পের টুইট নিয়ে তাঁদের ব্যতিব্যস্ততা বাড়তি কিছু ইঙ্গিতও করছে। সরকারের জন্য সাবধানতা ও ব্যবস্থা নেওয়ার প্রশ্নে তা ইতিবাচক ও সহায়ক হতে পারে।