দ্বাদশ জাতীয় সংসদের একপক্ষীয় নির্বাচনের কিছুদিন আগে আওয়ামী লীগের সভাপতিমণ্ডলীর সদস্য ও তৎকালীন কৃষিমন্ত্রী আব্দুর রাজ্জাক চ্যানেল টোয়েন্টিফোরকে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে বিএনপির কারাবন্দি নেতাদের নির্বাচনে আনার চেষ্টা সম্পর্কে বলেছিলেন, ‘তাঁদের প্রস্তাব দেওয়া হয়েছিল, তাঁরা যদি নির্বাচনে অংশ নেন, জেল থেকে ছেড়ে দেওয়া হবে।’ অনেকে মনে করেন, এই প্রচেষ্টায় সফলতার অন্যতম পল্টি খাওয়া নেতাদের হাল-হকিকতউদাহরণ বিএনপির সাবেক ভাইস চেয়ারম্যান শাহজাহান ওমর। রাজধানীর নিউ মার্কেট এলাকায় বাসে অগ্নিসংযোগের মামলায় গ্রেপ্তার হয়ে কারাগারে থাকা অবস্থায় ২০২৩ সালের ২৯ নভেম্বর হঠাৎ জামিনে মুক্ত হয়ে ক্ষমতাসীন দল আওয়ামী লীগের নৌকা প্রতীকের প্রার্থী হন। আওয়ামী লীগ সরকারের বিরুদ্ধে বিএনপির সঙ্গে যুগপৎ আন্দোলনে থাকা অবস্থায় বাংলাদেশ কল্যাণ পার্টির চেয়ারম্যান সৈয়দ মুহাম্মদ ইবরাহিম বলেছিলেন, এই সরকারের অধীনে যারা ভোটে যাবে তারা মোনাফেক।
কিন্তু হঠাৎ সিদ্ধান্ত পাল্টে নির্বাচনে অংশ নিয়ে তিনি সংসদ সদস্য হন এবং বলেন, প্রথমবার এমপি হওয়া প্রথমবার পিতা হওয়ার মতো, ভালো লাগছে। বিএনপির সাবেক ভাইস চেয়ারম্যান শমসের মবিন চৌধুরীও একসময় কারাগার থেকে মুক্ত হয়ে অপ্রকাশিত কারণে দল ছাড়েন। পল্টি খাওয়া হিসেবে পরিচিতি পাওয়া এই নেতাদের তালিকায় দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে নাম উঠেছে তৈমূর আলম খন্দকার, বিশিষ্ট শিল্পপতি সৈয়দ এ কে একরামুজ্জামান সুখন, প্রয়াত উকিল আব্দুস সাত্তারের। এঁদের মধ্য থেকে এখন এমন বক্তব্য আসছে, ‘চাপের মুখে নির্বাচনে অংশ নিতে বাধ্য হয়েছি।
দুর্নীতি আর ক্ষমতার লোভের কারণে শেষ হয়ে গেছে স্বঘোষিত ‘হ্যাডামওয়ালা’ রাজনীতিবিদ, বিএনপির সাবেক ভাইস চেয়ারম্যান ও সাবেক আলোচিত সংসদ সদস্য ব্যারিস্টার শাহজাহান ওমরের রাজনৈতিক ভবিষ্যৎ।
ঝালকাঠি জেলা বিএনপির সদস্যসচিব অ্যাডভোকেট শাহাদাৎ হোসেন বলেন, ‘শুধু ঝালকাঠিবাসীর কাছেই নয়, শাহজাহান ওমর সারা বাংলাদেশের মানুষের কাছে মীরজাফর হিসেবে চিহ্নিত হয়েছেন।’
ঝালকাঠি আইনজীবী সমিতির সদস্য শামীম আলম বাবু বলেন, ‘শাহজাহান ওমর বিএনপির রাজনীতি করলেও তিনি আওয়ামী লীগের এজেন্ট হিসেবে কাজ করেছেন। ঝালকাঠিতে বিএনপি শক্তিশালী হোক, এটা তিনি কখনো চাননি। তিনি বরাবরই চেয়েছেন, ঝালকাঠি বিএনপি দুর্বল থাকুক। বিএনপিকে দুর্বল রেখে তিনি ব্যক্তিস্বার্থ হাসিল করেছেন। নানা অপকর্ম ও দুর্নীতি করে কোটি কোটি টাকার মালিক হয়েছেন। আওয়ামী লীগের সঙ্গে সম্পর্ক রেখে তিনি স্বৈরাচারের প্রেতাত্মা হিসেবে কাজ করেছেন।’
চাপে পড়ে নির্বাচনে যেতে হয় : সৈয়দ ইবরাহিম
সাবেক সেনা কর্মকর্তা ও বাংলাদেশ কল্যাণ পার্টির চেয়ারম্যান সৈয়দ মুহাম্মদ ইবরাহিম গতকাল বুধবার বলেন, ‘কী ধরনের চাপে আমাকে নির্বাচনে যেতে হয়েছিল, তা বলার এখনো সময় আসেনি। তবে একসময় সব বলব।’ নিজের নির্বাচনী এলাকা কক্সবাজারের চকরিয়া-পেকুয়ায় যান কি না—এই প্রশ্নে তিনি বলেন, ‘৫ আগস্টের পর আর যাওয়া হয়নি। নির্বাচনী এলাকায় কার মনে কী ক্ষোভ আছে তা তো জানি না।’ তিনি আরো বলেন, ‘আমি দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে অংশ নিলেও বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের পক্ষে ছিলাম। গত ২৫ জুলাই আমি আমার নির্বাচনী এলাকায় ওই আন্দোলনের প্রতি সমর্থন জানাই। এ ছাড়া গত ১৪ জুলাই চ্যানেল আইয়ের একটি অনুষ্ঠানে জুমে অংশ নিয়েও ছাত্রদের দাবি মেনে নিতে সরকারের প্রতি আহ্বান জানিয়েছিলাম। জানা যায়, সম্প্রতি নির্বাচনী এলাকায় চিংড়িঘের দখল ও লুটপাটের অভিযোগে দায়ের করা একটি মামলায় সৈয়দ মুহাম্মদ ইবরাহিমকে অন্যতম আসামি করা হয়েছে।
শমসের মবিন চৌধুরীর পরিণতি
সাবেক সেনা কর্মকর্তা ও কূটনীতিক শমসের মবিন চৌধুরী বিএনপির ভাইস চেয়ারম্যান ছিলেন। ২০১৫ সালে তিনি বিএনপির সব পদ থেকে পদত্যাগ করেন। তার আগে ওই বছর কাশিমপুর কারাগার থেকে জামিনে মুক্তির পর থেকেই তৎকালীন আওয়ামী লীগ সরকারের সঙ্গে তাঁর এক ধরনের আঁতাত হয়েছে বলে সন্দেহ করা হচ্ছিল। কারাগার থেকে বের হওয়ার পর দলের চেয়ারপারসন খালেদা জিয়ার সঙ্গে বারবার দেখা করার চেষ্টা করেও ব্যর্থ হন তিনি। এরপর ২০১৮ সালে সাবেক রাষ্ট্রপতি এ কিউ এম বদরুদ্দোজা চৌধুরীর নেতৃত্বাধীন বিকল্পধারা বাংলাদেশে যোগ দেন। সর্বশেষ গত ৭ জানুয়ারি দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের আগে সেপ্টেম্বরে তিনি তৃণমূল বিএনপির চেয়ারপারসন হন এবং ওই দলের প্রার্থী হিসেবে নির্বাচনে অংশ নিয়ে জামানত হারান।
তৃণমূল বিএনপির নেতাকর্মীদের কাছেও ‘জাতীয় বেঈমান’ হিসেবে আখ্যা পান শমসের মবিন চৌধুরী। ২০২৩ সালের ২৯ ডিসেম্বর জাতীয় প্রেস ক্লাবে এক সভায় তাঁরা অভিযোগ করেন, সংসদ নির্বাচনে নিশ্চিত জয়ের লোভ দেখিয়ে তাঁদের মাঠে নামিয়ে এখন আর খোঁজ নিচ্ছেন না তিনি।
গত ৫ আগস্ট ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানে হাসিনা সরকারের পতনের পর পল্টন থানায় করা যুবদল নেতা শামীম মোল্লা হত্যা মামলায় পল্টি খাওয়া গ্রেপ্তার শমসের মবিন চৌধুরীকে গত ১৯ অক্টোবর কারাগারে পাঠানোর আদেশ দেন ঢাকার চিফ মেট্রোপলিটন ম্যাজিস্ট্রেট আদালত।
রাজনীতির কফিনে শেষ পেরেক তৈমূরের
নারায়ণগঞ্জের তুখোড় রাজনীতিবিদ তৈমূর আলম খন্দকার একসময় ছিলেন বিএনপির চেয়ারপারসন খালেদা জিয়ার উপদেষ্টা। দলীয় সিদ্ধান্ত উপেক্ষা করে ২০২২ সালের ১৬ জানুয়ারি নারায়ণগঞ্জ সিটি করপোরেশন (নাসিক) নির্বাচনে মেয়র পদে অংশ নিয়ে পরাজিত হন। দলের স্বার্থবিরোধী এই কাজের জন্য তাঁকে প্রথমে বিএনপির চেয়ারপারসনের উপদেষ্টার পদ থেকে প্রত্যাহার এবং পরে দল থেকে বহিষ্কার করা হয়। তার পরও বিএনপির বিভিন্ন কর্মসূচি ঘিরে শহরের মাসদাইর এলাকার তাঁর বাড়ি ‘মজলুম নিবাসে’ বিএনপির নেতাকর্মীদের নিয়মিত আসা-যাওয়া ছিল। কিন্তু দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন সামনে রেখে তিনি আওয়ামী লীগ সরকারের পৃষ্ঠপোষকতায় গঠিত তৃণমূল বিএনপির মহাসচিবের দায়িত্ব নেন এবং তীব্র সমালোচনা উপেক্ষা করেই সংসদ নির্বাচনে রূপগঞ্জ আসনের প্রার্থী হন।
সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা বলছেন, তৈমূরের প্রত্যাশা ছিল, বিএনপির অনেক নেতা তাঁর দলে যোগ দেবেন এবং তিনি ক্ষমতাসীন দল আওয়ামী লীগের সহযোগিতায় সংসদ সদস্য নির্বাচিত হবেন। কিন্তু তাঁকে লড়তে হয় আওয়ামী লীগের প্রার্থী গোলাম দস্তগীর গাজীর সঙ্গে। ফলাফল মাত্র তিন হাজার ভোট পেয়ে জামানত বাজেয়াপ্ত। বর্ষীয়ান রাজনীতিকের এই পরিণতিতে তাঁকে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে নানাভাবে ট্রলের শিকার হতে হয়। তৃণমূল বিএনপিতেও ভাঙন ধরে।
তৈমূরের সাবেক রাজনৈতিক সহকর্মীরা বলছেন, আওয়ামী লীগ সরকারের পতন তাঁর জন্য আতঙ্কের কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে। শমসের মবিন চৌধুরী গ্রেপ্তার হওয়ায় তৈমূর আলমও একই পরিণতির আশঙ্কায় রয়েছেন। তৃণমূল বিএনপিতে যোগ দিয়ে বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমানের কঠোর সমালোচনা করার কারণে বিএনপি নেতাকর্মীদের রোষানলেও রয়েছেন তিনি।
জানা যায়, তৈমূর আলম খন্দকার এখন রাজধানী ঢাকায়ই বেশি অবস্থান করছেন এবং নিজের অনুসারীদের এড়িয়ে চলছেন।
নারায়ণগঞ্জ জেলা বিএনপির সাধারণ সম্পাদক গোলাম ফারুক খোকন বলেন, ‘রাজনীতিতে দলের চেয়ে ব্যক্তি বড় না। দল না থাকলে আমাদের কোনো মূল্য নেই। অতিরিক্ত লোভের কুফল এখন তৈমূর সাহেবকে পেতে হবে।’
নারায়ণগঞ্জ মহানগর বিএনপির আহ্বায়ক অ্যাডভোকেট সাখাওয়াত হোসেন খান বলেন, ‘দল তাঁকে অনেক কিছু দিলেও তিনি তা ভুলে বেঈমানি করেছেন।’
লাভ হয়নি উকিল আব্দুস সাত্তারের পরিবারের
জীবনের দুই যুগেরও বেশি সময় ধরে ব্রাহ্মণবাড়িয়া জেলা বিএনপির নেতৃত্ব দিয়েছেন প্রয়াত উকিল আব্দুস সাত্তার। ছয়বার সংসদ সদস্য হলেও চারবারই বিজয়ী হয়েছেন ধানের শীষ প্রতীক নিয়ে। কিন্তু জীবনের শেষ সময়ে এসে পল্টি খাওয়া নেতাদের তালিকায় নাম লেখান।
উকিল আব্দুস সাত্তার দলীয় সিদ্ধান্ত মেনে একাদশ জাতীয় সংসদে ব্রাহ্মণবাড়িয়া-২ আসনের সংসদ সদস্য পদ থেকে পদত্যাগ করেন। কিন্তু তার পরই দলীয় সিদ্ধান্ত অমান্য করে ২০২৩ সালের ১ ফেব্রুয়ারি অনুষ্ঠিত উপনির্বাচনে অংশ নিয়ে আওয়ামী লীগ নেতাকর্মীদের সহযোগিতায় সংসদ সদস্য নির্বাচিত হন। সে সময় বিএনপি থেকে তাঁকে বহিষ্কার করা হয়। এদিকে উপনির্বাচনে জয়ী হওয়ার আট মাসের মধ্যেই তাঁর মৃত্যু হয়। ওই শূন্য আসনের উপনির্বাচনে নতুন দল তৃণমূল বিএনপির হয়ে প্রার্থী হন আব্দুস সাত্তারের ছেলে মো. মাইনুল হাসান তুষার। ওই নির্বাচনে তিনি আওয়ামী লীগের সমর্থন পেতে ব্যর্থ হন। অন্যদিকে বিএনপিও বিপক্ষে। ফলে কয়েক মাসের জন্য এমপি হওয়ার প্রত্যাশা পূরণ হয়নি তাঁর। এরপর দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে তুষার আওয়ামী লীগের মনোনয়ন ফরম সংগ্রহ করলেও মনোনয়ন পাননি। ওই সময় আব্দুস সাত্তারের ছেলে মাইনুল হাসান সাংবাদিকদের জানান, আওয়ামী লীগের নেতাদের নির্দেশেই তিনি ফরম কিনেছেন। বর্তমানে এই পরিবারটির রাজনৈতিক ভবিষ্যৎ অনিশ্চিত।
এমপি পদ হারিয়ে একরাম হামলা মামলার আসামি
ব্রাহ্মণবাড়িয়া-১ (নাসিরনগর) আসনে দলীয় সিদ্ধান্ত অমান্য করে একপক্ষীয় দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে স্বতন্ত্র প্রার্থী হিসেবে অংশ নেন বিএনপি চেয়ারপারসনের উপদেষ্টা সৈয়দ এ কে একরামুজ্জামান সুখন। এ কারণে দল থেকে তাঁকে বহিষ্কার করা হয়। আওয়ামী লীগের প্রার্থীকে হারিয়ে তিনি সংসদ সদস্যও নির্বাচিত হন। এরপর আনুষ্ঠানিকভাবে তিনি আওয়ামী লীগে যোগ দেন। কিন্তু গত ৫ আগস্ট ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানে আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর তিনি তাঁর সংসদ সদস্য পদ হারিয়েছেন। সম্প্রতি বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনে হামলা ও বিস্ফোরণের অভিযোগে ব্রাহ্মণবাড়িয়া জুডিশিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট (নাসিরনগর) প্রথম আমলি আদালতে নাসিরনগর উপজেলা কৃষক দলের সদস্যসচিব শাহ আলম পাঠান বাদী হয়ে একরামুজ্জামান সুখনসহ ১১৮ জনের বিরুদ্ধে মামলার আবেদন করেছেন।
সূত্রঃ