তীব্র জ্বালানি সংকটের কারণে চাহিদার তুলানায় কম বিদ্যুৎ উৎপাদন হচ্ছে। ফলে লোডশেডিং বেড়েছে সারা দেশে। এতে বিপর্যস্ত হয়ে পড়েছে জনজীবন। এদিকে গ্যাসের অভাবে বন্ধ হয়ে গেছে দেশের অর্ধেক সার কারখানা এবং ৩১টি বিদ্যুৎকেন্দ্র।
এর মধ্যে ১,৫০০ মেগাওয়াটের জন্য কেবল আদানি গ্রুপকেই বছরে দিতে হবে ১২০ কোটি ডলার, যদিও ভারতের অভ্যন্তরীণ বাজারের অন্য উৎস থেকে ১,১০০ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ কিনতে বাংলাদেশকে দিতে হয় ৪০০ মিলিয়ন বা ৪০ কোটি ডলার।
দেশের বেসরকারি বিদ্যুৎ উৎপাদনকারী ও ভারতের আদানি গ্রুপের কাছে বর্তমানে সরকারের বকেয়া প্রায় ৩৫ হাজার কোটি টাকা। এর সঙ্গে এলএনজি সরবরাহকারীরা পাবে আরো ৫০০ মিলিয়ন ডলার এবং বিবিয়ানা ও জালালাবাদ গ্যাসক্ষেত্র থেকে গ্যাস সরবরাহের জন্য শেভরন পাবে আরো ২০০ মিলিয়ন ডলার, বলে আনুষ্ঠানিক সূত্রগুলো জানিয়েছে।
সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা বলছেন, বিগত সরকারের অধীনে বিদ্যুৎ উৎপাদনের ব্যয় বেড়েছে একাধিক কারণে। এগুলো হলো উৎপাদনের জন্য আমদানি করা জ্বালানির ওপর ক্রমবর্ধমান নির্ভরশীলতা, ডলার সংকট, টাকার অবমূল্যায়ন এবং আদানি পাওয়ার বা বেক্সিমকোর তিস্তা সৌরবিদ্যুৎ প্রকল্পের মতো বিপুল ব্যয়ে অপ্রয়োজনীয় বিদ্যুৎ ক্রয়চুক্তি করা এবং একই সময়ে স্থানীয়ভাবে কয়লা ও গ্যাস উৎপাদনে উদ্যোগের অভাব।
এমতাবস্থায় শিল্পসংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা মনে করেন, এই সংকট থেকে উত্তরণের একমাত্র উপায় আমদানি ও স্থানীয়ভাবে উত্তোলন উভয় উপায়ে প্রাকৃতিক গ্যাসের সরবরাহ বাড়ানো। কারণ বিদ্যুৎ উৎপাদনের জন্য দেশে গ্যাসের ব্যবহারই এখনো সবচেয়ে কম খরচের।
জ্বালানি সূত্র জানায়, আওয়ামী লীগের ১৫ বছরের শাসনামলে ২০১৯ সাল পর্যন্ত বিদ্যুৎ বা জ্বালানি খাতের অবস্থা ভালোই ছিল, কারণ তখন পর্যন্ত বিদ্যুৎ উৎপাদনে স্থানীয়ভাবে উৎপাদিত সস্তা গ্যাসই ছিল মূল জ্বালানি হিসেবে আধিপত্যশীল। এতে বিদ্যুৎ উৎপাদন ব্যয়ও নিয়ন্ত্রণে ছিল। এ সময়ে দেশের ৬৮ ভাগ বিদ্যুৎ উৎপাদন হতো গ্যাস পুড়িয়ে।
তবে গ্যাসের সংকট যে অবশ্যসম্ভাবী, তা অন্তত এক দশক আগেই সবার জানা ছিল। ২০০২ সালেই একটি জাতীয় কমিটি কবে নাগাদ গ্যাসের ব্যবহার সর্বোচ্চ অবস্থানে পৌঁছাবে এবং পরবর্তী দশকগুলোতে কিভাবে তার অবনতি হতে থাকবে তার একটি প্রক্ষেপণ দিয়েছিল।
সে অনুযায়ী, ২০১৮ সালে দেশের গ্যাস উৎপাদন সর্বোচ্চ অবস্থানে দৈনিক ২৭০০ মিলিয়ন ঘনফুটে পৌঁছায়। তবে পরের বছরেই তা কমে যায় ৭০০ মিলিয়ন ঘনফুট। এ ঘাটতি মোকাবেলায় তখন মধ্যপ্রাচ্য থেকে এলএনজি আমদানি শুরু করে সরকার। স্থানীয় গ্যাসের চেয়ে আমদানি করা এলএনজি কয়েক গুণ বেশি দামি হলেও স্থানীয় গ্যাসের সঙ্গে এই জ্বালানির মিশ্র ব্যবহারের ফলে বিদ্যুৎ উৎপাদনের ব্যয় তখনো সহনীয় ছিল।
তবে ইউক্রেন যুদ্ধ শুরুর পর প্রতি মিলিয়ন থার্মাল ইউনিট এলএনজির দাম মাত্র ১০-১২ ডলার থেকে লাফিয়ে পৌঁছায় ৫৪ ডলারে, পরের বছরে তা কমে ২০ থেকে ৩০ ডলারে নামে। এখন তা আরো কমে নেমে এসেছে ১২ ডলারে। কিন্তু এর মধ্যে বাংলাদেশের যে ক্ষতি হওয়ার, তা তো হয়েই গেছে—ওই সময়ে চড়া দামের আমদানির ফলে সার্বিকভাবে দেশের জ্বালানি খাতে ব্যয় বৃদ্ধি ঘটেছে।
আওয়ামী লীগ সরকার ক্ষমতায় থাকার সময় সফলভাবে বিদ্যুতের বিভিন্ন অবকাঠামো গড়ে তুললেও প্রধান জ্বালানি উৎপাদনের দিকে তেমন মনোযোগ দেয়নি। এ সময়ে বাংলাদেশের বাপেক্সের সঙ্গে রাশিয়ার গ্যাজপ্রম কিছু তেল ও গ্যাস কূপ খনন করেছে, যাতে নির্দিষ্ট কিছু ক্ষেত্রে গ্যাস উৎপাদন সামান্য পরিমাণে বাড়ে।
বিগত সরকার বঙ্গোপসাগরে তেল ও গ্যাস অনুসন্ধানের অনুমতি দেওয়ার জন্য আন্তর্জাতিক জ্বালানি কম্পানিগুলোকে আকৃষ্ট করতে পারেনি, উপকূলে গ্যাস অনুসন্ধানের সরকারি উদ্যোগও তেমন ছিল না। এককথায় বলতে গেলে, গ্যাস সংকট সমাধানে সরকারের সমাধান সম্পূর্ণরূপে আমদানির উপর কেন্দ্রীভূত ছিল।
উল্লেখ্য, এলএনজি আমদানি করতে বাংলাদেশে বার্ষিক ২ বিলিয়ন ডলার ব্যয় হয়।
বড়পুকুরিয়া ছাড়া দেশের পাঁচটি কয়লাখনির কোনোটির উন্নয়নে নজর দেয়নি বিগত সরকার। বড়পুকুরিয়ায় গত দুই দশক ধরে ছোট পরিসরে কয়লা উত্তোলন করা হচ্ছে।
যদিও দেশে বিপুল কয়লার মজুদ আছে, তবে বর্তমানে বড়পুকুরিয়া ছাড়া কেবল ফুলবাড়ী কয়লাক্ষেত্রই খনি উন্নয়নের জন্য প্রস্তুত অবস্থায় রয়েছে। তবে সামাজিক ও পরিবেশগত প্রভাবের কথা চিন্তা করে সরকার এই খনির উন্নয়ন থেকে বিরত থেকেছে।
দেশের কয়লাখনি উন্নয়ন না করা হলেও, সুন্দরবনের কাছে রামপালে, মাতারবাড়ী ও পায়রায় কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্র গড়ে তোলার মতো প্রকল্প হাতে নিয়েছিল বিগত সরকার। এসব প্রকল্প নেওয়া হয়েছিল আমদানি করা কয়লার ওপর নির্ভর করে। প্রকল্পগুলোর মধ্যে রামপাল ও পায়রা আংশিকভাবে বিদ্যুৎ উৎপাদন করছে।
জ্বালানি মিশ্রণে গত পাঁচ বছরে কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎ উৎপাদনের অংশ মাত্র ২ শতাংশ থেকে বেড়ে ১১ শতাংশে পৌঁছেছে। এসব বিদ্যুৎকেন্দ্র চালাতে বছরে এক বিলিয়ন ডলারের বেশি মূল্যের কয়লা আমদানি করতে হবে।
রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ শুরুর পর থেকে কয়লার দামও আকাশচুম্বী হয়ে প্রতি মেট্রিক টন ৪০০ ডলারে পৌঁছায়, যেখানে এর প্রাক্কলন করা হয়েছিল মাত্র ১০০ ডলার। ফলে রামপাল ও পায়রায় উৎপাদিত প্রতি ইউনিট বিদ্যুতের দাম প্রত্যাশিত ৬ থেকে ৭ টাকার পরিবর্তে ১৫ টাকায় পৌঁছেছে। অবশ্য বর্তমানে ইন্দোনেশিয়ার কয়লার দাম প্রতি মেট্রিক টন ১২০ ডলার।
কয়লার চড়া দাম ও আর্থিক অব্যবস্থাপনার ফলে ডলার সংকটের কারণে বিগত সরকার পায়রা ও রামপালের বিদ্যুৎকেন্দ্র দুটি পূর্ণমাত্রায় সচল রাখতে কয়লা আমদানি করতে পারেনি।