পুলিশের সাবেক মহাপরিদর্শক (আইজি) বেনজীর আহমেদ ও তাঁর স্ত্রী-সন্তানদের নামে কেনা রাজধানীর গুলশানের চারটি ফ্ল্যাটে তালা খুলে প্রবেশে নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট নিয়োগ দেওয়ার আদেশ দিয়েছেন আদালত। গতকাল রবিবার দুর্নীতি দমন কমিশনের (দুদক) আবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে ঢাকা মহানগর সিনিয়র স্পেশাল জজ আদালত এ আদেশ দেন। দুদকের পাবলিক প্রসিকিউটর (পিপি) মাহমুদ হোসেন জাহাঙ্গীর কালের কণ্ঠকে এসব তথ্য নিশ্চিত করেন।
মাহমুদ হোসেন জাহাঙ্গীর বলেন, আদালত শুনানি নিয়ে একজন নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট নিয়োগ দেওয়ার জন্য ঢাকার জেলা প্রশাসককে নির্দেশ দেন।
আদালতের আদেশ পাওয়ার পর দুদকের সম্পদ ব্যবস্থাপনা ইউনিটের পরিচালক একটি টিমসহ ১৩ জুন ওই ফ্ল্যাটগুলো পরিদর্শনে যান। পরিদর্শনের সময় ভবনের নিচতলায় রিসেপশনিস্ট মেহরাব হোসেন অপি জানান, সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা ওই ফ্ল্যাটগুলোয় বসবাস করেন না। ভবনের ম্যানেজার জসিমকে ভবনে পাওয়া যায়নি। তাঁর মোবাইলে ফোন করেও তাঁকে পাওয়া যায়নি।
পরিদর্শনকালে আরো জানা যায়, ওই ভবনের ১৩ ও ১৪ তলায় ডুপ্লেক্স আকারে ৯ হাজার বর্গফুটের বেশি জায়গা নিয়ে চারটি ফ্ল্যাট রয়েছে। ফ্ল্যাটগুলোর চাবি বেনজীরের কাছে। বর্তমানে তিনি ও তাঁর পরিবার ওই ভবনে বসবাস করেন না। কোথায় গেছেন—তা-ও কেউ বলতে পারছে না। আবেদনে আরো বলা হয়, ফ্ল্যাটগুলো রক্ষণাবেক্ষণ কাজে যেসব সার্ভিস চার্জ, ইলেকট্রিসিটি বিল, পানি ও গ্যাস বিলসহ অন্যান্য কিছু বিষয়ে আর্থিক খরচের বিষয় রয়েছে।
গত ৩১ মার্চ ও ২ এপ্রিল কালের কণ্ঠে সংবাদ প্রকাশের পরপরই স্ত্রীর চিকিৎসার নামে সিঙ্গাপুর পাড়ি দেয় বেনজীর ও তাঁর পরিবার। সেখান থেকে তাঁরা বেনজীরের কেনা মালয়েশিয়ার বাড়িতে গিয়ে ওঠেন। এরপর মালয়েশিয়া থেকে সপরিবারে চলে যান দুবাই। সেখানে পরিবারের সদস্যদের রেখে বেনজীর পর্তুগাল পাড়ি জমিয়েছেন বলে জানা গেছে।
একাধিক মামলার প্রস্তুতি
সম্পদ বিবরণী দাখিলের নোটিশ পাঠানোর পর ২১ কর্মদিবস এবং পরে সময়ের আবেদন করলে আরো ১৫ কর্মদিবস সময় পাবেন বেনজীর আহমেদ। তবে বিদেশে অবস্থান করায় বেনজীর যেমন দুদকের নোটিশ গ্রহণ করতে পারবেন না, তেমনি দুদকে সম্পদ বিবরণী দাখিল করতেও ব্যর্থ হবেন। এ অবস্থায় সম্পদ বিবরণী দাখিল না করলে তিনটি মামলা হবে। দুদকে সম্পদ বিবরণী দাখিল না করার জন্য হবে ‘নন-সাবমিশন’ মামলা, আর বেনজীর ও তাঁর পরিবারের সদস্যদের যেসব অবৈধ সম্পদের তথ্য-প্রমাণ পাওয়া গেছে, তার ভিত্তিতে আরেকটি ‘অবৈধ (জ্ঞাত আয়বহির্ভূত) সম্পদ অর্জনের’ মামলা হবে। এ ছাড়া তৃতীয় মামলাটি হবে বেনজীরের নজিরবিহীন পাসপোর্ট জালিয়াতির অভিযোগে। দুদক আইনে জ্ঞাত আয়বহির্ভূত সম্পদ অর্জনের মামলায় ১০ বছর এবং নন-সাবমিশন মামলায় তিন বছরের সাজার বিধান রয়েছে।
দুদকের ডাকে সাড়া দেয়নি বেনজীর পরিবার
গত ২৮ মে বেনজীর আহমেদ, তাঁর স্ত্রী জীশান মীর্জাসহ তাঁদের দুই মেয়েকে জিজ্ঞাসাবাদের জন্য তলব করে চিঠি দেয় দুদক। চিঠিতে ৬ জুন বেনজীর আহমেদ এবং ৯ জুন তাঁর স্ত্রী জীশান মীর্জা, মেয়ে ফারহিন রিসতা বিনতে বেনজীর ও তাহসিন রাইসা বিনতে বেনজীরকে জিজ্ঞাসাবাদের জন্য দুদকের প্রধান কার্যালয়ে হাজির থাকতে বলা হয়। আরেক মেয়ে জাহরা বিনতে বেনজীর নাবালিকা হওয়ায় তাকে তলব করা হয়নি। তবে প্রথম দফায় দুদকের ডাকে হাজির হননি বেনজীর আহমেদ। দ্বিতীয় দফায় ২৩ জুন জিজ্ঞাসাবাদের জন্য তাঁকে ফের দুদকে তলব করে চিঠি দেওয়া হয়। আর তাঁর স্ত্রী-কন্যাদের ২৪ জুন তলব করা হয়। দ্বিতীয় দফায়ও বেনজীর ও তাঁর স্ত্রী-সন্তানরা দুদকের জিজ্ঞাসাবাদের মুখোমুখি হননি।
নজিরবিহীন পাসপোর্ট জালিয়াতি
দুদকের অনুসন্ধানে পাসপোর্ট করার ক্ষেত্রে বেনজীর পরিচয় গোপন করে সাধারণ পাসপোর্ট নেওয়ার নজিরবিহীন জালিয়াতির তথ্য পাওয়া গেছে। অভিযোগ অনুসন্ধানে পাসপোর্ট অধিদপ্তরের ১১ কর্মকর্তা এবং র্যাবের এক ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাকে জিজ্ঞাসাবাদ করা হয়েছে। পুলিশ পরিচয় গোপন করে বেসরকারি চাকরিজীবী পরিচয়ে সাধারণ পাসপোর্ট তৈরি করেন তিনি। কিন্তু নবায়নের সময় ধরা পড়লে তা আটকে দেয় পাসপোর্ট অধিদপ্তর। চিঠি দেওয়া হয় র্যাব সদর দপ্তরে। কিন্তু প্রভাব খাটিয়ে সব ম্যানেজ করেন বেনজীর। পাসপোর্ট অফিসে না গিয়ে নেন বিশেষ সুবিধা। বানিয়ে নেন সাধারণ পাসপোর্ট। এমনকি তিনি সরকারি চাকরিজীবী পরিচয়ে বিশেষ পাসপোর্টও (লাল পাসপোর্ট) নেননি।
বেনজীর পরিবারের সম্পদ অনুসন্ধান শুরু যেভাবে
সর্বপ্রথম কালের কণ্ঠে ‘বেনজীরের ঘরে আলাদীনের চেরাগ’ এবং ‘বনের জমিতে বেনজীরের রিসোর্ট’ শিরোনামে গত ৩১ মার্চ ও ২ এপ্রিল পৃথক দুটি অনুসন্ধানী প্রতিবেদন প্রকাশিত হয়। প্রতিবেদন দুটি প্রকাশের পর দেশে-বিদেশে ব্যাপক সাড়া পড়ে। মূলত এরপরই দুদক বেনজীর ও তাঁর পরিবারের সদস্যদের অবৈধ সম্পদ অনুসন্ধানের সিদ্ধান্ত নেয়।
সূত্রঃ কালের কন্ঠ অনলাইন