দাগী অপরাধী ও রোহিঙ্গাদের অবৈধভাবে জন্ম সনদ, জাতীয় পরিচয়পত্র ও পাসপোর্ট বানিয়ে দেওয়ার একটি চক্রের ২৩ সদস্যকে গ্রেপ্তার করেছে পুলিশ। তারা ইচ্ছামতো বয়স বাড়াত-কমাত আর ঠিকানা পরিবর্তন করত বলে জানিয়েছে পুলিশ। এ পর্যন্ত গত তিন মাসে ১৪৩টি পাসপোর্ট বানানোর তথ্য পেয়েছে গোয়েন্দা পুলিশ। তবে ২০১৯ সাল থেকে এ রকম হাজার হাজার পাসপোর্ট বানানো হয়েছে বলে পুলিশের ধারণা।
গ্রেপ্তারকৃতরা হলেন উম্মে ছলিমা ওরফে ছমিরা, মরিজান ও রশিদুল, এই তিনজন রোহিঙ্গা নাগরিক আর রোহিঙ্গা দালাল আইয়ুব আলী, মোস্তাকিম, আনসার সদস্য জামসেদুল ইসলাম ও মো. রায়হান।
আজ সোমবার দুপুরে ডিএমপি মিডিয়া সেন্টারে এক সংবাদ সম্মেলনে এ কথা বলেন ঢাকা মহানগর পুলিশের অতিরিক্ত কমিশনার (গোয়েন্দা) মোহাম্মদ হারুন অর রশীদ।
সম্মেলনে তিনি বলেন, শক্তিশালী এই চক্রটি মিয়ানমার থেকে আসা রোহিঙ্গা শিশু, নারী ও পুরুষদের লক্ষাধিক করে টাকার বিনিময়ে জন্ম সনদ, জাতীয় পরিচয়পত্র ও পাসপোর্ট বানিয়ে দেয়।
ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা লালবাগ বিভাগের একাধিক দল রাজধানীর আগারগাঁও, মোহাম্মদপুর, যাত্রাবাড়ী, বাড্ডায় ধারাবাহিক অভিযান চালিয়ে ২৩ ফেব্রুয়ারি কয়েকজনকে গ্রেপ্তার করা হয়। বর্তমানে তারা পাঁচ দিনের পুলিশ হেফাজতে রয়েছেন।
তাদের দেওয়া তথ্য সংগৃহীত ডকুমেন্টস বিশ্লেষণ করে রবিবার দিনে ও রাতে কক্সবাজার, টাঙ্গাইল ও ঢাকায় ধারাবাহিক অভিযান চালিয়ে দুই আনসার সদস্যসহ রোহিঙ্গা ও বাঙালি দালাল আটজনকে গ্রেপ্তার করা হয়।
তাদের কাছে ১৭টি পাসপোর্ট, ১৩টি এনআইডি কার্ড, পাঁচটি কম্পিউটার, তিনটি প্রিন্টার, ২৪টি মোবাইল ফোন এবং পাসপোর্ট তৈরির সংশ্লিষ্ট শত শত দলিলপত্র জব্দ করা হয়েছে।
তিনি বলেন, চক্রটির একটি দল কক্সবাজার, বান্দরবান, খাগড়াছড়ি থেকে রোহিঙ্গাদের ঢাকায় নিয়ে আসে। আরেকটি দল এদের জন্য জন্ম সনদ, জাতীয় পরিচয়পত্র বানিয়ে দেয়। সর্বশেষে অন্য দলটি ঢাকাসহ বিভিন্ন আঞ্চলিক পাসপোর্ট অফিসে আনসার সদস্যদের মাধ্যমে ব্যাংকে এক্সপ্রেস, সুপার এক্সপ্রেস ধরনের টাকা জমা দেওয়া, বায়োমেট্রিকস করা ও ছবি তোলার ব্যবস্থা করে দেয়।
তিনি বলেন, চক্রটি ছয় ঘণ্টার মধ্যে জন্ম সনদের জন্য এরা পাঁচ হাজার থেকে ১২ হাজার টাকা নেয়। তিন দিনের মধ্যে এনআইডি করে নেওয়ার জন্য ২৫ হাজার টাকা এবং পাসপোর্ট তৈরি করার জন্য এক লাখ ২০ হাজার টাকা নিয়ে থাকে বলে প্রাথমিকভাবে স্বীকার করেছে।
দালালদের মোবাইলে শত শত পাসপোর্ট করে দেওয়ার প্রাসঙ্গিক সফট ডকুমেন্টস, ডেলিভারি স্লিপ পাওয়া গেছে, যার মধ্যে গত তিন মাসে রোহিঙ্গাদের জন্য করা ১৪৩টি পাসপোর্টের সন্ধান পাওয়া গেছে।
তিনি বলেন, ২০১৯ সাল থেকে চক্রটি রোহিঙ্গাদের, বাংলাদেশি দাগী অপরাধীদের ভিন্ন নাম ও ঠিকানায় পাসপোর্ট করে দিচ্ছে বলে স্বীকার করেছে। তারা ঢাকা, নারায়ণগঞ্জ, ময়মনসিংহ, রংপুর, শরীয়তপুর, গোপালগঞ্জ ও বরিশাল জেলার ঠিকানা ব্যবহার করে জন্ম সনদ ও এনআইডি বানিয়ে তার ভিত্তিতে পাসপোর্ট বানিয়ে থাকে।
প্রযুক্তি অনুশীলনে অনেক দূর এগিয়ে যাওয়া বাংলাদেশে রোহিঙ্গা ডাটা, ডিজিটাল জন্ম সনদ ডাটা, স্মার্ট এনআইডি ডাটা ব্যাংক আছে যেখানে বিভিন্ন বায়োমেট্রিকস, ছবিসহ নানা তথ্য সংরক্ষিত। এ সকল তথ্য কোনো রকম ভেরিফাই না করেই ইচ্ছামতো তৈরি করা কাগজপত্রের ভিত্তিতে পাসপোর্ট অফিসে যে কেউ দালালদের মাধ্যমে টাকা জমা দিতে, বায়োমেট্রিকস দিতে এবং পাসপোর্টের জন্য ছবি তুলতে পারে।
রাষ্ট্রীয় সার্বভৌমত্বের স্মারক পাসপোর্ট তৈরির জন্য তাৎক্ষণিকভাবে রোহিঙ্গা ডাটা, ডিজিটাল জন্ম সনদ ডাটা এবং স্মার্ট এনআইডি ডাটা ভেরিফাই করলেই রোহিঙ্গাসহ নন-বাংলাদেশিদের শনাক্ত করা সম্ভব।
তিনি বলেন, এই চক্রটি ইচ্ছামতো বয়স বাড়াত-কমাত আর ঠিকানা পরিবর্তন করে দিত। একটি চক্র রয়েছে, যারা গ্রামে গ্রামে ঘুরে বেড়াত আর এমন মানুষ খুঁজে নিত, যারা কখনো পাসপোর্ট করবে না। সেই ব্যক্তির বা নারীর নাম-ঠিকানা ব্যবহার করে পাসপোর্ট করে দিত দালাল চক্র।