রাজধানীর পুরান ঢাকার শাঁখারীবাজার কালীমন্দিরের পাশেই শিমুলিয়া ভাস্কর শিল্পালয়। দোকানের ঝাঁপ বন্ধ। দরজাটাই শুধু খোলা। ফলে বাইরে থেকে বোঝার উপায় নেই ভেতরে কী কর্মযজ্ঞ চলছে।
আগন্তুক দেখে একবার ফিরে তাকালেন। পলকেই আবার কাজে মন দিলেন। মিনিট দশেক পর হাসিমুখে বললেন, ‘কিছু মনে করবেন না। আসলে কাজে ডুবে গেলে দুনিয়াদারির খেয়াল থাকে না।
তারুণ্যে যখন যেখানে ডাক পড়েছে চলে গেছেন হরিপদ। নারায়ণগঞ্জ, মুন্সীগঞ্জ, গোপালগঞ্জ, ফরিদপুর, সিলেটসহ দেশের বিভিন্ন জায়গায় গিয়ে প্রতিমা গড়েছেন। কাজ শিখিয়েছেন শতাধিক তরুণকে। নরম গলায় বললেন, ‘এখন ঢাকায় প্রতিমাশিল্পী হিসেবে যাঁদের দেখেন তাঁদের প্রায় সবাই কোনো না কোনো সময় আমার সঙ্গে কাজ করেছেন। শাঁখারীবাজার কালীমন্দিরের ভেতরে-বাইরে যত ধরনের বিগ্রহ দেখছেন, সবই আমার করা।’
প্রতিমা গড়ার নেশা হরিপদকে পেয়ে বসেছিল কৈশোরেই। একবার এক আত্মীয়ের সঙ্গে গিয়েছিলেন নরসিংদী; সরস্বতীর প্রতিমা বানাতে। হরিপদের গড়া প্রতিমা সেবার পাতিলপাড়ায় সেরা হয়েছিল। নগদ পুরস্কার পেয়েছেন ৪৫০ টাকা, সঙ্গে গোল্ড মেডেলও। বছর দুয়েকের মতো নরসিংদীতে ছিলেন। সেখান থেকে ঢাকার তাঁতীবাজারে। ১৯৬৩ সালে বুলবুল ললিতকলা একাডেমিতে ভর্তি হয়েছিলেন। আরো ভালোমতো কাজ শিখবেন বলে মাঝখানে একবার কলকাতাও গিয়েছিলেন। সেখানে বছরখানেক রাখাল পালের শিষ্য হয়েছিলেন। এর পরের ঠিকানা ৫২ শাঁখারীবাজার, ঢাকা।
সব ভুলে কাজে মন
হরিপদের বয়স এখন আশির কোঠায়। ডায়াবেটিসসহ নানা রোগ বাসা বেঁধেছে শরীরে। আগের মতো খাটতে পারেন না। এখন নকশাটা এঁকে দেন। কারিগররা তা ধরে কাজ করেন। তবে চূড়ান্ত ধাপের কাজটা তিনি করেন। বয়স হয়েছে, কিন্তু এখনো একবার কাজে মগ্ন হয়ে গেলে নাওয়াখাওয়ার খবর থাকে না। দুর্গাপূজায় আগে প্রায় ১০টির মতো প্রতিমার ফরমাশ নিতেন। এখন দু-তিনটির বেশি নেন না। বললেন, ‘আগে তো অনেক জায়গা থেকে অর্ডার নিতাম। এবারও প্রচুর অর্ডার এসেছিল। কিন্তু শরীরটা ভালো না। তাই সবার কথা রাখতে পারিনি। এবার কেবল দুটি প্রতিমা করছি।’
দুজন কারিগর তাঁকে সহযোগিতা করেন। লক্ষ্মী, সরস্বতী, কালী, বিশ্বকর্মাসহ বছরভর বাঙালি হিন্দু সম্প্রদায়ের নানা পূজা-পার্বণ লেগেই থাকে। ফলে বছরজুড়েই কমবেশি ফরমাশ থাকে হরিপদের। তবে দুর্গাপূজা এলে ব্যস্ততা কয়েক গুণ বেড়ে যায়। সকালের নাশতা খেয়ে কাজ শুরু করেন। শেষ হতে রাত ১২টা বেজে যায়। পূজা ঘনিয়ে এলে রুটিন বদলে যায়। কাজ চলে রাতভর।
১৯৭৮ সালে মালবিকা পালের সঙ্গে গাঁটছড়া বাঁধেন হরিপদ। স্ত্রী মালবিকা পাল বললেন, ‘সারা দিন কাজ নিয়েই থাকেন। এর বাইরে যেন সংসারে আর কিছুই দেখার নেই।’
যেভাবে প্রতিমা বানান
হরিপদ পাল জানালেন, প্রথমে প্রতিমার নকশা করে সে অনুযায়ী কাঠামো বানানো হয়। প্রতিমা বানাতে মাটি, পানি, বাঁশ, খড়, পাট লাগে। বেশি লাগে এঁটেল মাটি। বেলে মাটি, দো-আঁশ মাটিও লাগে পরিমাণমতো। মাটিতে পাটের আঁশ দেওয়া হয় বন্ধনটা শক্ত করার জন্য। মূল কাঠামোর সঙ্গে হাত, মাথা ইত্যাদি জোড়া লাগানোর কাজে খড় ব্যবহার করেন। কাঠামো বানানোর পর তাতে মাটির প্রলেপ দেওয়া হয়। এরপর সপ্তাহখানেক লাগে শুকানোর জন্য। এবার রং করার পালা। একেকটি প্রতিমা বানাতে ১৫ থেকে ২০ দিনের মতো লাগে। পূজার দুই থেকে তিন মাস আগে ফরমাশ নেওয়া হয়। আকার, নকশা ও মানভেদে একেকটি প্রতিমার দাম ২০ হাজার থেকে এক লাখ টাকা ছাড়িয়ে যায়।
তাঁর কথা লেখা আছে
আমেরিকার ইন্ডিয়ানা ইউনিভার্সিটির অধ্যাপক ও ফোকলোর গবেষক হেনরি গ্লাসি। গবেষণার কাজে বাংলাদেশে এসেছিলেন ১৯৯৮ সালে। সেবার হরিপদের কাজ দেখে মুগ্ধ হন। তাঁর কাছ থেকে বেশ কিছু মডেলও কিনেছিলেন। পরে গ্লাসির মাধ্যমেই ২০০২ সালের জুন-জুলাইয়ে যুক্তরাষ্ট্রের ওয়াশিংটন ডিসিতে অনুষ্ঠিত ‘স্মিথসোনিয়ান ফোকলাইফ ফেস্টিভাল’-এ অংশ নিয়েছিলেন হরিপদ। হেনরি গ্লাসির লেখা ‘দ্য পটারস আর্ট’ বইয়ে হরিপদ পালের ছবিসহ তাঁর কাজের বিবরণ আছে। একই লেখকের ‘দ্য স্পিরিট অব ফোক আর্ট’ বইয়েও হরিপদের কথা উল্লেখ আছে।
মাগো, তুমি সাজো
হরিপদ বললেন, ‘অনেকের চোখে আমি হয়তো সুন্দর প্রতিমা গড়ি। কিন্তু আমি জানি, মা তার চেয়েও সুন্দর। প্রতিমা বানানোর সময় মনে মনে বলি—মাগো, তুমি সাজো। সুন্দর হও।’
হরিপদের টানাটানির সংসার। পরিবারে একমাত্র উপার্জনক্ষম ব্যক্তি বলতে তিনি। বয়সের ভারে ন্যুব্জ হরিপদ বললেন, ‘মাটি নিয়েই তো জীবনটা পার করে দিলাম। সংসারে টানাটানি হলে মনে দুঃখ আসে। তখন শিল্পকর্মে ডুব দিই। এটাই আমার আশ্রয়।’ বলতে বলতে চোখজোড়া ভিজে ওঠে তাঁর।
বিসর্জনের দিনেও মনটা কেঁদে ওঠে হরিপদের। তাঁর জীবনে সবচেয়ে কষ্টের দিন সেটা। ভুলতে পারলে যেন বাঁচেন। বিসর্জনের সময় কখনো উপস্থিত থাকেন না তিনি। বললেন, ‘আপনার সন্তানকে কেউ চোখের সামনে থেকে ছোঁ মেরে নিয়ে গেলে আপনার খারাপ লাগবে না? প্রতিমা বিসর্জনের সময় আমারও তেমন লাগে। প্রতিমা নয়, ভালো হতো যদি সংসারের কষ্টগুলো বিসর্জন দিতে পারতাম।’