ফিলিস্তিনের স্বাধীনতা আন্দোলনের সংগ্রামে বামপন্থী পপুলার ফ্রন্ট ফর দ্য লিবারেশন অব প্যালেস্টাইনের সদস্য লেইলা খালিদের নানামুখী ভূমিকা থাকলেও তিনি বিশ্বের প্রথম নারী উড়োজাহাজ ছিনতাইকারী হিসেবেই বেশি পরিচিত। ১৯৬৯ সালের ২৯ আগস্ট ইতালির রোম থেকে তেল আবিবের উদ্দেশে রওনা হওয়া টিডাব্লিউএ ফ্লাইট-৮৪০ উড়োজাহাজটি ছিনতাইয়ে নেতৃত্ব দেন লেইলা খালিদ। একে-৪৭ হাতে ধরা তরুণ মুক্তিসংগ্রামী লেইলা খালিদের সে সময়কার একটি ছবি পরবর্তী সময়ে ফিলিস্তিনের স্বাধীনতাসংগ্রামের অন্যতম প্রতীক হয়ে ওঠে।
সম্প্রতি লেইলা খালিদের একটি সাক্ষাৎকার প্রকাশিত হয়েছে যুক্তরাজ্যভিত্তিক স্বাধীন গণমাধ্যম নিউ ইন্টারন্যাশনালিস্ট-এ।
লেইলা : ১৯৪৮ সালে আমরা যখন ফিলিস্তিন থেকে বিতাড়িত হই, তখন লেবাননের দক্ষিণাঞ্চলের তাইরে এলাকায় শরণার্থী হিসেবে জীবনের নতুন অধ্যায় শুরু হয়।
লেইলা : এর পেছনে উদ্দেশ্য ছিল মূলত আমাদের বন্দিদের মুক্ত করা। বিশেষত নারী বন্দিদের। পাশাপাশি ফিলিস্তিনের স্বাধীনতা আন্দোলনের পক্ষে আন্তর্জাতিক সচেতনতা সৃষ্টি করা। বিশ্বকে জানাতে চেয়েছিলাম যে যাদের শুধু ত্রাণ দরকার আর তাঁবুতে দিন যাপন করে, আমাদের এমন শরণার্থী হিসেবে বিবেচনা করা উচিত নয়। আমরা সেই জনগোষ্ঠী, যাদের লড়াইয়ের সুনির্দিষ্ট কারণ আছে। আমি বিশ্বের প্রথম নারী উড়োজাহাজ ছিনতাইকারী হলাম, নাকি অন্য কিছু হলাম- এ নিয়ে আমার কোনো মাথাব্যথা নেই। আমি শুধু আমাদের লক্ষ্য পূরণে কিছু একটা করতে চেয়েছিলাম। খুব ভালো করেই জানতাম যে উড়োজাহাজ ছিনতাই করার মধ্য দিয়ে আমরা ফিলিস্তিনকে দখলদারমুক্ত করতে পারব না। এ ঘটনার মাধ্যমে আমরা আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের দৃষ্টি আকর্ষণ করতে চেয়েছিলাম। আমার পকেটে তখন একটা হ্যান্ড গ্রেনেড আর একটা পিস্তল ছিল। পিএলএফপির সহযোদ্ধা কমরেড সালিম ইসাওয়ির সঙ্গে সাক্ষাৎ হলো। আমাদের ওপর স্পষ্ট নির্দেশনা ছিল যে কাউকে আঘাত করা যাবে না। আমি পাইলটকে বলেছিলাম, ‘এখন থেকে আমি নতুন ক্যাপ্টেন।’ ফিলিস্তিনের কাছাকাছি পৌঁছলে আমি পাইলটকে উড়োজাহাজ হাইফায় নিয়ে যেতে বলি। আমার সহযোদ্ধাও হাইফার ছিলেন। আমাদের কাছ থেকে কেড়ে নেওয়া মাতৃভূমি নিজের চোখে আবার দেখতে পাওয়ার অনুভূতি ঠিক কেমন ছিল- তা আপনাকে বলে বোঝাতে পারব না। এরপর আমরা উড়োজাহাজটি ঘুরিয়ে সিরিয়ার দামেস্কের দিকে চলে গেলাম। আমি যাত্রীদের কাছে ক্ষমা চেয়ে নিয়েছিলাম। আমরা কাউকে আঘাত করিনি। সব যাত্রী নিজ নিজ বাড়ি ফিরতে পেরেছেন। অথচ আমরা আমাদের বাড়িতে ফিরতে পারিনি। এখনো শরণার্থী।
মার্তা : ইসরায়েল, যুক্তরাষ্ট্র ও ইউরোপীয় ইউনিয়ন পিএলএফপিকে সন্ত্রাসী সংগঠন হিসেবে উল্লেখ করে। আপনার কাছে সন্ত্রাসবাদের মানে কী?
লেইলা : আমার কাছে সন্ত্রাসবাদের অর্থ হলো দখলদারিত্ব। ঘরবাড়ি, জমি চুরি করে আমাদের শরণার্থীতে পরিণত করা। প্রতিদিন আমরা ফিলিস্তিনে মানুষ খুন হতে দেখি। ইসরায়েলি সেনাবাহিনী হত্যার উদ্দেশ্যেই গুলি ছোঁড়ে। সাংবাদিক শিরিন আবু আকলেহর কথাই ধরুন। সত্যিকার পরিস্থিতির কথা তুলে ধরার অপরাধে তাঁকে খুন করা হয়েছে। আমরা প্রতিদিনই সহিংসতা প্রত্যক্ষ করি। তবে দখলকৃত ভূমিতে আমরা নতুনভাবে ‘ইন্তিফাদা’ ঘটতেও দেখছি।
মার্তা : একটা সুন্দর, বাসযোগ্য পৃথিবী গড়ে তোলার ক্ষেত্রে সহিংসতা কি কোনো ভূমিকা পালন করতে পারে?
লেইলা : আমাদের আর কোনো পথ নেই। বিকল্প বেছে নেওয়ার মতো বিলাসিতা করার সুযোগ নেই। দিনের পর দিন যে অন্যায়-অবিচার চলছে, তা সভা-সমাবেশ বা শান্তিপূর্ণ পদ্ধতিতে মোকাবেলা করার উপায় নেই। স্বাধীনতা আত্মত্যাগ দাবি করে। হতাহতের যে ঘটনা ঘটছে, তাঁর জন্য আমরা ব্যথিত। তবে জীবন ও মৃত্যুর মধ্যে যে সীমারেখা আছে, ফিলিস্তিনিদের জন্য তা অত্যন্ত ক্ষীণ। আমরা দেখেছি, বিশ্ববাসী কিভাবে ইউক্রেনের অধিবাসীদের প্রতি সহমর্মিতা দেখিয়েছে। অথচ তারা আমাদের কথা ভুলে গেছে।
মার্তা : আপনার কল্পনায় মুক্ত ফিলিস্তিন কেমন?
লেইলা : স্বাধীনতার প্রধান উদ্দেশ্যই হলো- হারানো ভূমি উদ্ধার এবং শরণার্থীদের নিজ ভূমে ফিরে যাওয়া। আমরা এমন একটি গণতান্ত্রিক ব্যবস্থা গড়ে তুলতে চাই, যেখানে প্রত্যেকটি মানুষের অধিকার ও কর্তব্য সমান হবে। সেখানে যেসব ইসরায়েলি নাগরিকের বাস, তাদের সঙ্গে নিয়েই আমরা এটি করতে চাই। এটি হবে একটি মানবিক ও গণতান্ত্রিক সমাধান এবং এটা প্রতিষ্ঠিত করা সম্ভব।