আজ থেকে ৫০ বছর আগে ইসরায়েলের ওপর আকস্মিক আক্রমণ চালিয়েছিল মিসর ও সিরিয়া। যা ইওম কিপুর যুদ্ধ নামে পরিচিতি পায়। এবার একই উপায়ে ফিলিস্তিনের সশস্ত্র গোষ্ঠী হামাস ইসরায়েলের ওপর বড় ধরনের আক্রমণ শুরু করেছে। এবারও ইহুদিদের ছুটির সময়ে এই অপ্রত্যাশিত হামলার ঘটনা ঘটে।
সাম্প্রতিক সময়ে গাজা উপত্যকায় উত্তেজনা ঘনীভূত হচ্ছিল। তবে সেখানকার ইসলামপন্থী শাসক দল হামাস অথবা ইসরায়েল কেউই সেই উত্তেজনা আর বাড়াতে চায়নি। তবে হামাস একটি গোছানো আর সমন্বিত অভিযান চালানোর পরিকল্পনা করেছিল। রবিবার সকালে তারা জেরুজালেম ও তেল আবিব পর্যন্ত একের পর এক রকেট নিক্ষেপ শুরু করে।
ইসরায়েলের হাইয়োম পত্রিকায় কিবুতজ বেইরি শহরের এক বাসিন্দাকে উদ্ধৃত করা হয়। যিনি তার বাবাকে নিয়ে খুব চিন্তায় ছিলেন। রকেট হামলার সতর্কীকরণ সাইরেন বেজে ওঠার পর তার বাবা একটি নিরাপদ আশ্রয়ে চলে গিয়েছিলেন। তিনি বলেন, ‘তিনি আমাকে লিখেছিলেন, অস্ত্রধারীরা আশ্রয়ের মধ্যে ঢুকে পড়েছে। আমি গাজার ভেতর থেকে টেলিগ্রামে তার ছবি দেখছিলাম। আমি এখনো গুলির শব্দ শুনতে পাচ্ছি।’
এমন পরিস্থিতিতে ইসরায়েলি নিরাপত্তা বাহিনীর সাধারণ মানুষের সাহায্যে যত দ্রুত এগিয়ে আসার কথা ছিল তারা সেভাবে আসেনি। এতে অনেক ইসরায়েলি তাদের ক্ষোভ প্রকাশ করেন।
এদিকে হামাস চ্যানেলে শেয়ার করা ফুটেজে দেখা গেছে, সশস্ত্র যোদ্ধারা ইসরায়েলি সেনাবাহিনীর ঘাঁটি ও একটি সাঁজোয়া যানে থাকা সেনাদের বন্দি করছে এবং হত্যা করছে।
শুরুতে গাজায় উৎসব উদযাপনের বেশ কিছু ছবি দেখা যায়। সেখানে ছিনিয়ে নেওয়া কয়েকটি ইসরায়েলি সামরিক যান রাস্তা দিয়ে চালিয়ে নিতে দেখা যায়।
গাজা শহরের এক যুবক বলেন, ‘আল-আকসায় ইসরায়েলি অভিযানের প্রতিশোধ নিতে হামাস এখন পর্যন্ত যা যা করেছে তাতে আমি খুশি।’ ইসরায়েল অধিকৃত পূর্ব জেরুজালেমের আল-আকসায় ইহুদিদের সাম্প্রতিক উৎসবের সময় ইহুদি দর্শনার্থীদের সংখ্যা বেড়ে যাওয়ার কথা উল্লেখ করে তিনি এসব কথা বলেন। আল-আকসা মসজিদ ইসলামের তৃতীয় পবিত্র স্থান এবং এটি ইহুদিদের জন্য সবচেয়ে পবিত্রতম স্থান, যা টেম্পল মাউন্ট নামেও পরিচিত।
তবু এই যুবক ওই হামলার ঘটনায় তার উদ্বিগ্ন হওয়ার কথাও জানিয়েছেন। ইসরায়েলি সামরিক বাহিনী, গাজার কাছাকাছি কোথাও হামলা চালাতে পারে, এ নিয়ে সতর্কবার্তা পাওয়ার পর তিনি তার বাড়ি ছেড়ে যান। হামাসের হামলার প্রতিক্রিয়ায় পরবর্তী সময়ে কী ঘটবে তার জন্য আতঙ্কে থাকার কথা জানান তিনি। তিনি বলেন, ‘আমরা উদ্বিগ্ন, ২০২১ সালের যুদ্ধে ইসরায়েলের হামলার কারণে শোরুক টাওয়ার ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছিল। এতে আমার পরিবার একটি দোকান হারায়। এবার হামাস অনেক বড় আকারে হামলা চালিয়েছে, তাই ইসরায়েলের প্রতিক্রিয়া আরো বড় হবে।’
ইসরায়েলি বিমান হামলায় আহতদের ভিড়ে ফিলিস্তিনি হাসপাতালগুলো ইতিমধ্যে সয়লাব হয়ে গেছে। গাজা উপত্যকা—উপকূলীয় এই ক্ষুদ্র ভূখণ্ডে প্রায় ২৩ লাখ ফিলিস্তিনি বসবাস করে। হামাস, পার্লামেন্ট নির্বাচনে জয়ী হওয়ার এক বছর পর ২০০৭ সালে এই গাজা উপত্যকা দখল করে। ইসরায়েল ও মিসর তখন তাদের ভূখণ্ডের অবরোধ আরো কঠোর করে তোলে। এই অঞ্চলের প্রায় ৫০ শতাংশ মানুষ বেকারত্ব আর দারিদ্র্যের সঙ্গে লড়াই করছে।
সর্বশেষ ২০২১ সালে ইসরায়েল ও হামাসের মধ্যে বড় ধরনের সংঘাত হয়। এরপর মিসর, কাতার ও জাতিসংঘের মধ্যস্থতায় পরোক্ষ আলোচনার মাধ্যমে গাজার বাসিন্দাদের ইসরায়েলে কাজ করার জন্য হাজার হাজার কাজের অনুমোদনের ব্যবস্থা করা হয়। সেই সঙ্গে পরিস্থিতি শান্ত রাখার বিনিময়ে অন্যান্য বিধি-নিষেধ শিথিল করা হয়েছিল।
গত মাসে যখন শত শত ফিলিস্তিনি পাঁচ বছর আগে শুরু হওয়া গণবিক্ষোভের স্মরণে কাঁটাতারের বেষ্টনীর পাশে বিক্ষোভে যোগ দিতে শুরু করে, তখন ধারণা করা হয়েছিল, এটি হামাসের প্ররোচনায় হয়েছে। এর উদ্দেশ্য ছিল ইসরায়েলের কাছ থেকে আরো সুবিধা আদায় করা এবং কাতারের থেকে অর্থ সাহায্য পাওয়া।
ছোট ছোট সমাবেশকেও এখন ভিন্নভাবে দেখা হচ্ছে। অনেকে সন্দেহ করছেন, আক্রমণ শুরুর আগে ইসরায়েলের সুরক্ষা বেষ্টনী সম্পর্কে তথ্য সংগ্রহের জন্যই ওই সমাবেশ হয়েছে।
সর্বশেষ এই অভিযানের মাধ্যমে, হামাস আবারও একটি সশস্ত্র সংগঠন হিসেবে নিজেদের নতুনভাবে জাহির করতে চাইছে বলে মনে করা হচ্ছে। যারা ইসরায়েলের ধ্বংসের জন্য প্রতিশ্রুতিবদ্ধ। আক্রমণের শুরুতে হামাসের কমান্ডার মোহাম্মদ দেইফ ফিলিস্তিনি ও অন্য আরবদের ‘ইসরায়েলি দখলদারিত্ব দূর করার’ অভিযানে যোগ দেওয়ার আহ্বান জানান।
এখন একটি বড় প্রশ্ন হলো, অধিকৃত পশ্চিম তীর ও পূর্ব জেরুজালেম বা এই অঞ্চলের অন্য জায়গায় বসবাসকারী ফিলিস্তিনিরা তার আহ্বানে সাড়া দেবে কি না। ইসরায়েল নিঃসন্দেহে একাধিক ফ্রন্ট থেকে যুদ্ধের আশঙ্কা করছে।
সবচেয়ে খারাপ পরিস্থিতি যা হতে পারে তা হলো, এটি শক্তিশালী লেবানিজ সশস্ত্র গোষ্ঠী হিজবুল্লাহর দৃষ্টি আকর্ষণ করতে পারে।
এদিকে ইসরায়েলি সামরিক বাহিনী ব্যাপকভাবে সেনা মোতায়েনের নির্দেশ দিয়েছে। গাজায় তীব্র বিমান হামলার পাশাপাশি তারা সেখানে স্থল অভিযানের পরিকল্পনা করছে বলে আভাস পাওয়া যাচ্ছে।
তবে এই ফিলিস্তিনি সশস্ত্র গোষ্ঠী যেসব ইসরায়েলি সেনা ও বেসামরিক নাগরিকদের আটক করেছে তাদেরকে তারা মানবঢাল বা দর-কষাকষির অনুষঙ্গ হিসেবে ব্যবহার করবে বলে ধারণা করা হচ্ছে। যা পরিস্থিতিকে আরো জটিল করে তুলবে।
ইসরায়েলের প্রতিরক্ষা বাহিনী আইডিএফের মুখপাত্র রিয়ার অ্যাডমিরাল ড্যানিয়েল হাগারি বলেন, ‘আমরা বর্তমানে এই অঞ্চলের নিয়ন্ত্রণ পুনরুদ্ধার করতে ব্যস্ত। আমরা ব্যাপকভাবে হামলা চালাচ্ছি, বিশেষ করে গাজা উপত্যকার আশপাশের এলাকার নজরে রাখছি। আমরা খুব তীক্ষ্ণ এবং পুঙ্খানুপুঙ্খ পর্যালোচনা করব।’
এসংক্রান্ত পর্যালোচনা সম্পন্ন না হলেও, এতে কোনো সন্দেহ নেই যে ইসরায়েলের গোয়েন্দা এবং নিরাপত্তা সংস্থাগুলো নিজেরাই যাচাই করতে শুরু করেছে, কিভাবে তারা এই হামলার বিষয়ে আগে থেকে জানতে পারেনি এবং কেন তারা এই বিশাল হামলা প্রতিরোধ করতে পারেনি।
সূত্র : বিবিসি