আজ বিশ্ব শিক্ষক দিবস। ১৯৯৪ সাল থেকে প্রতিবছর ৫ অক্টোবর দিবসটি পালিত হয়। এই দিন বিশ্বের সব শিক্ষকের অবদানকে শ্রদ্ধাভরে স্মরণ করা হয়। আদর্শ সমাজ গঠনে শিক্ষকদের ভূমিকা অপরিসীম।
তাঁরা পূর্বসূরি ও উত্তরসূরির মধ্যে সংযোগ স্থাপন করেন, বিশেষত নতুন প্রজন্মের মধ্যে শিক্ষার আলো ছড়িয়ে তাঁরা অমর হয়ে থাকেন।
শিক্ষকতা সর্বোত্তম পেশা : সর্বোত্তম পেশাগুলোর অন্যতম শিক্ষকতা। তাই সুষ্ঠু সমাজ বিনির্মাণে মহান আল্লাহ সৃষ্টির সর্বোত্তম ব্যক্তি মুহাম্মদ (সা.)-কে পাঠিয়েছেন। ইরশাদ হয়েছে, ‘আল্লাহ মুমিনদের প্রতি অনুগ্রহ করেছেন যে তিনি তাদের মধ্য থেকে তাদের কাছে রাসুল পাঠিয়েছেন, যিনি তাদের কাছে তাঁর নিদর্শনগুলো পাঠ করেন, তাদের পরিশুদ্ধ করেন এবং তাদের কোরআন ও হিকমত শিক্ষা দেন, অথচ তারা আগে সুস্পষ্ট বিভ্রান্তিতে ছিল।
’ (সুরা : আলে ইমরান, আয়াত : ১৬৪)
ইসলামে শিক্ষকের মর্যাদা : ইসলামে শিক্ষা আবশ্যকীয় বিধানের অন্তর্ভুক্ত। তাই শিক্ষা বিস্তারে সম্পৃক্তদের মর্যাদা সবচেয়ে বেশি। পবিত্র কোরআনে ইরশাদ হয়েছে, ‘হে নবী আপনি বলুন, যারা জানে এবং যারা জানে না, তারা কি সমান? কেবল বিবেকবান ব্যক্তিরা উপদেশ গ্রহণ করে।’ (সুরা : জুমার, আয়াত : ৯)
অন্যত্র ইরশাদ হয়েছে, ‘তোমাদের মধ্যে যারা ঈমান এনেছে এবং যাদের জ্ঞান দেওয়া হয়েছে মহান আল্লাহ তাদের অনেক উঁচু মর্যাদা দেবেন, তোমরা যা করো তা সম্পর্কে আল্লাহ অবহিত।
’ (সুরা : মুজাদালা, আয়াত : ১১)আদর্শ শিক্ষক মুহাম্মদ (সা.) : মানুষের মধ্যে পরিশীলিত আচরণ, নৈতিকতাবোধ ও শৃঙ্খলাপূর্ণ জীবনাচার অনুশাসনে শিক্ষকদের মুখ্য ভূমিকা রয়েছে। মহানবী (সা.) ছিলেন আদর্শ শিক্ষকের উজ্জ্বলতম নমুনা। তাঁকে মানবসভ্যতার শিক্ষক হিসেবে পাঠানো হয়েছে। ইরশাদ হয়েছে, ‘তিনি সেই সত্তা, যিনি নিরক্ষরদের মধ্যে একজন রাসুল পাঠিয়েছেন, যিনি তাদের কাছে তাঁর (আল্লাহর) আয়াত পাঠ করেন, তাদের পরিশুদ্ধ করেন এবং তাদের কোরআন ও হিকমত শিক্ষা দেন, যদিও তারা আগে সুস্পষ্ট বিভ্রান্তিতে ছিল।’ (সুরা : জুমআ, আয়াত : ২)
শেখানোর গুরুত্ব সবচেয়ে বেশি : বিংশ শতাব্দীর প্রখ্যাত মুহাদ্দিস শায়খ আবদুল ফাত্তাহ আবু গুদ্দাহ (রহ.) তাঁর বিখ্যাত ‘আর-রাসুল আল-মুয়াল্লিম’ গ্রন্থে বলেছেন, ‘পবিত্র কোরআনে সুস্পষ্ট ভাষায় রাসুল (সা.)-এর শিক্ষক হওয়ার প্রমাণ রয়েছে।
’ অতঃপর তিনি সুরা জুমআর ২ নম্বর আয়াত ও সুরা বাকারার ১৫১ নম্বর আয়াত উল্লেখ করেন। এরপর তিনি বলেন, তেমনি রাসুল (সা.)-এর এই গুরুদায়িত্ব ও শিক্ষকতার গুণটি হাদিসেও স্পষ্টভাবে এসেছে। আবদুল্লাহ বিন আমর (রা.) বর্ণনা করেছেন, একদা রাসুল (সা.) তাঁর মসজিদের দুটি মজলিসের পাশ দিয়ে যান। তখন তিনি বলেন, ‘তারা উভয়ে কল্যাণের মধ্যে রয়েছে। তাদের মধ্যে একদল অন্য দলের চেয়ে মর্যাদাবান। একদল কোরআন পড়ছে এবং আল্লাহর কাছে দোয়া করছে। তিনি চাইলে তাদের দেবেন এবং চাইলে দেওয়া থেকে বিরত থাকবেন। অন্য দল শিখছে এবং অন্যদের শেখাচ্ছে। নিশ্চয়ই আমাকে শিক্ষক হিসেবে পাঠানো হয়েছে।’ অতঃপর তিনি তাদের সঙ্গে বসে পড়েন। (ইবনে মাজাহ, হাদিস : ২২৯)
ইসলামের প্রথম মাদরাসা : ইসলামের সূচনাকাল থেকেই শিক্ষার ওপর সর্বাধিক গুরুত্ব রয়েছে। তাই রাসুল (সা.) নবুয়ত লাভের পর থেকে কোরআন প্রচারে ব্যস্ত সময় কাটাতেন। প্রখ্যাত সাহাবি আরকাম বিন আবিল আরকাম (রা.)-এর ঘর ছিল ইসলামের ইতিহাসে প্রথম মাদরাসা, যা দারুল আরকাম নামে পরিচিত। ইসলামের প্রথম যুগে সাফা পাহাড়ের কাছে অবস্থিত এই ঘরে সাহাবিরা গোপনে একত্র হতেন। উসমান ইবনে আবদুল্লাহ ইবনে আরকাম তাঁর দাদা আরকাম (রা.) থেকে বর্ণনা করেন, ‘রাসুলুল্লাহ (সা.) সাফা পর্বতের কাছে অবস্থিত তাঁর বাড়িতে আশ্রয় নিয়েছিলেন। অতঃপর আমাদের মধ্য থেকে ৪০ ব্যক্তি ইসলাম গ্রহণ করেন। তাঁদের মধ্যে সর্বশেষ ইসলাম গ্রহণ করেছিলেন ওমর ইবনুল খাত্তাব (রা.)। অতঃপর ৪০ ব্যক্তি মুশরিকদের সামনে আত্মপ্রকাশ করেন।’ (মুসনাদে হাকিম, হাদিস : ৬১৩০)
মুসলিম মনীষীদের শিক্ষাবিষয়ক উক্তি : শিক্ষকতার মহত্ত্ব প্রসঙ্গে ইমাম আবু হামিদ আল-গাজালি (রহ.) বলেছেন, ‘শিক্ষকতার পেশা সর্বোত্তম পেশা, যার মাধ্যমে মানুষ উপার্জন করতে পারে। সম্মান-মর্যাদা ও আল্লাহর নৈকট্য অর্জন শিক্ষার প্রধান উদ্দেশ্য।’
ইমাম মালিক (রহ.) বলেছেন, ভালো কাজের মধ্যে সর্বোত্তম হলো জ্ঞান প্রচার করা ও শিক্ষা দেওয়া। আবদুল বাকি বিন ইউসুফ (রহ.) বলেছেন, ‘একজন শিক্ষার্থীকে একটি মাসআলা শেখানো আমার কাছে দুনিয়ার সব কিছুর চেয়ে অনেক বেশি প্রিয় কাজ।’
জুনদুব আল-বাজালি (রহ.) বলেছেন, যে ব্যক্তি মানুষকে শিক্ষা দেয় কিন্তু আমল করে না, তার উদাহরণ হলো ওই বাতির মতো, যা মানুষকে আলোকিত করে; কিন্তু নিজেকে পুড়িয়ে ফেলে।
ইমাম শাফেয়ি (রহ.) বলেছেন, ‘আমাদের শিক্ষক ইমাম মুহাম্মদ আল-হাসান (রহ.) যদি নিজ মেধা অনুসারে আমাদের সঙ্গে কথা বলতেন তাহলে আমরা তাঁর কোনো কথাই বুঝতাম না। তবে তিনি আমাদের সঙ্গে আমাদের মেধা ও বুদ্ধিমত্তা অনুসারে কথা বলতেন।’
ইমাম মুজাহিদ (রহ.) বলেছেন, ‘শিক্ষকরা সবার মধ্যে সুবিচার করবেন। এমনকি তাঁরা শিশুদের মধ্যেও ন্যায়বিচার করতে ব্যর্থ হলে তাঁরা জালিম বলে গণ্য হবেন।’