বাংলাদেশ সংবিধান মেনেই গণতন্ত্র, আইনের শাসন ও মত প্রকাশের স্বাধীনতা নিশ্চিত করে যাবে বলে জাতিসংঘে জানিয়েছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদের অধিবেশনে তিনি মানবাধিকারের প্রতি বাংলাদেশের অঙ্গীকার তুলে ধরেছেন। একই সঙ্গে প্রধানমন্ত্রী বিশ্বনেতাদের যুদ্ধ ও সংঘাতের পথ পরিহার করে জনগণের শান্তি, কল্যাণ ও অর্থনৈতিক সমৃদ্ধির জন্য সম্মিলিতভাবে কাজ করার আহ্বান জানিয়েছেন। ভাষণে তিনি তাঁর সরকারের বিভিন্ন অর্জন ও উদ্যোগ তুলে ধরেন।
প্রধানমন্ত্রী বলেন, ‘প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে প্রায় সাড়ে চার কোটি মানুষ সামাজিক নিরাপত্তা বেষ্টনীর সুবিধা পাচ্ছে। চলতি অর্থবছরে সামাজিক নিরাপত্তা খাতে এক লাখ ২৬ হাজার ২৭২ কোটি টাকা (প্রায় ১২ বিলিয়ন মার্কিন ডলার) বরাদ্দ দেওয়া হয়েছে। এ বছর আমরা সর্বজনীন পেনশন স্কিম চালু করেছি। ১৮ থেকে ৫০ বছর বয়সী যেকোনো নাগরিক এই পেনশন সুবিধা গ্রহণ করতে পারবে।’
শেখ হাসিনা বলেন, ‘এসডিজি অর্জনে আমরা নারীর প্রতি বৈষম্যের অবসানকে গুরুত্বের সঙ্গে বিবেচনা করেছি। নির্ধারিত সময়ের মধ্যে নারীর ক্ষমতায়ন এবং লিঙ্গসমতা নিশ্চিতকরণ ও প্রত্যাশা পূরণে বাংলাদেশ প্রতিশ্রুতিবদ্ধ। আমরা নারীশিক্ষাসহ সার্বিক শিক্ষার ক্ষেত্রে বিশেষ গুরুত্ব দিয়েছি।’
প্রধানমন্ত্রী বাংলাদেশের জাতীয় বাজেটের মোট ৩০ শতাংশ নারীর সামাজিক ও অর্থনৈতিক ক্ষমতায়নের জন্য বরাদ্দ এবং রাজনৈতিক ক্ষেত্রে সরকারের শীর্ষ থেকে সর্বনিম্ন সব স্তরে নারীর প্রতিনিধিত্ব নিশ্চিত করার কথা উল্লেখ করেন।
শেখ হাসিনা বলেন, ২০৩০ সালের মধ্যে বাংলাদেশ তার প্রতিটি খাতে ৫০ শতাংশ নারীর অংশগ্রহণ নিশ্চিত করার লক্ষ্য নিয়েছে। তিনি জলবায়ু সংকট সমাধানের লক্ষ্যে জরুরি, সাহসী ও উচ্চাভিলাষী সম্মিলিত পদক্ষেপ নেওয়ার আহ্বান জানান।
প্রধানমন্ত্রী জানান, ভূমিহীন ও গৃহহীন মানুষের জন্য তাঁর সরকারের যুগান্তকারী উদ্যোগ ‘আশ্রয়ণ’ প্রকল্পের আওতায় এ পর্যন্ত প্রায় আট লাখ ৪০ হাজার পরিবারের ৫০ লাখ মানুষকে বিনা মূল্যে ঘর দেওয়া হয়েছে। বাংলাদেশের ৬০ লাখেরও বেশি মানুষ সোলার হোম সিস্টেম ব্যবহার করছে। তিনি আশা করেন, ২০৪১ সালের মধ্যে বাংলাদেশের বিদ্যুতের ৪০ শতাংশ পুনর্নবায়নযোগ্য উৎস থেকে পাওয়া যাবে।
প্রধান কার্বন নির্গমনকারী দেশগুলোকে জলবায়ু পরিবর্তন মোকাবেলায় উচ্চাভিলাষী উদ্যোগ নেওয়ার আহ্বান জানিয়েছেন শেখ হাসিনা। তিনি বলেন, ‘উন্নত দেশগুলোকে অবশ্যই ১০০ বিলিয়ন ডলারের প্রতিশ্রুতি পূরণ করতে হবে। জলবায়ু ঝুঁকিপূর্ণ দেশের উন্নয়ন চাহিদার কথা বিবেচনা করতে হবে। আমরা ২৭তম জলবায়ু সম্মেলনে গৃহীত ক্ষয়ক্ষতি সংক্রান্ত তহবিলের জরুরি বাস্তবায়ন চাই।’
প্রধানমন্ত্রী সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা, লবণাক্ততা, নদীক্ষয়, বন্যা ও খরাজনিত কারণে জলবায়ু অভিবাসীদের দায়িত্ব ভাগাভাগির ক্ষেত্রে আন্তর্জাতিক সংহতির আহ্বান জানান। তিনি বলেন, ‘গত কয়েক বছরের আন্ত সংযুক্ত সংকটগুলো বিশ্বব্যাপী খাদ্য, জ্বালানি ও পণ্য মূল্য বৃদ্ধি করেছে। জ্বালানি ও খাদ্য আমদানিকারক দেশ হিসেবে আমাদের আমদানি ব্যয় উল্লেখযোগ্যভাবে বেড়েছে। এটি আমাদের বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভের ওপর নেতিবাচক প্রভাব ফেলেছে।’ প্রধানমন্ত্রী বলেন, চ্যালেঞ্জ সত্ত্বেও তাঁর সরকার প্রতিটি মানুষের জন্য খাদ্য নিশ্চিত করেছে। নিম্ন আয়ের এক কোটি মানুষকে সাশ্রয়ী দামে চাল ও অন্যান্য সামগ্রী সরবরাহ করা হচ্ছে। মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে রাখতে বিভিন্ন উদ্যোগ নেওয়া হচ্ছে। ‘কৃষ্ণ সাগর খাদ্যশস্য উদ্যোগ’ অকার্যকর হয়ে পড়ায় প্রধানমন্ত্রী উদ্বেগ জানান। তিনি দ্রুত এই ব্যবস্থা চালুর ওপর জোর দেন।
প্রধানমন্ত্রী রূপকল্প ২০৪১-এর আওতায় ‘স্মার্ট বাংলাদেশ’ বিনির্মাণে সরকারের বিপুল বিনিয়োগের কথা উল্লেখ করেন। তিনি বলেন, দক্ষিণ-দক্ষিণ ও ত্রিপক্ষীয় সহযোগিতার মাধ্যমে ডিজিটাল প্রযুক্তির প্রসার এবং এর সুফলগুলোর সমতাভিত্তিক বণ্টন নিশ্চিত করা সম্ভব হবে।
প্রধানমন্ত্রী নিরাপদ, সুশৃঙ্খল ও নিয়মিত অভিবাসনের জন্য প্রণীত আন্তর্জাতিক কম্প্যাক্ট বাস্তবায়নের আহ্বান জানান। বাংলাদেশে কমিউনিটি ক্লিনিক প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে প্রাথমিক স্বাস্থ্য পরিষেবা তৃণমূল পর্যায়ে পৌঁছে দিতে বাংলাদেশের অভাবনীয় সাফল্যের কথা তিনি উল্লেখ করেন।
প্রধানমন্ত্রী সামুদ্রিক সম্পদের টেকসই ব্যবহারকে কাজে লাগানোর জন্য সমুদ্রের আইন সম্পর্কিত জাতিসংঘ কনভেনশনের বিধানগুলোর কার্যকর বাস্তবায়নে জোর দেন। তিনি বলেন, বাংলাদেশের ইন্দো-প্যাসিফিক রূপরেখায় অন্তর্ভুক্তিমূলক, টেকসই এবং সহযোগিতার মাধ্যমে সমুদ্রপথ ও সামুদ্রিক সম্পদের ব্যবহারের ওপর গুরুত্ব দেওয়া হয়েছে।
শেখ হাসিনা অনতিবিলম্বে আন্তর্জাতিক নিরস্ত্রীকরণ এবং অস্ত্রের প্রসারণ বন্ধ বিষয়ক চুক্তিগুলোর পূর্ণ বাস্তবায়ন দাবি করেন। এর পাশাপাশি তিনি জাতিসংঘ শান্তিরক্ষা কার্যক্রমে বাংলাদেশের অবদান এবং বিশ্বশান্তি ও নিরাপত্তার প্রতি অঙ্গীকারের কথা জানান।
প্রধানমন্ত্রী তাঁর সরকারের সন্ত্রাসবিরোধী অবস্থান তুলে ধরে বলেন, ‘আমরা কখনোই সন্ত্রাসবাদ কার্যক্রম সংঘটনে বা অন্যের ক্ষতিসাধনে আমাদের ভূমি ব্যবহৃত হতে দিই না।’ যোগাযোগ প্রযুক্তি ব্যবহার করে অস্থিরতা, বিদ্বেষমূলক ও উগ্রপন্থী বক্তব্য ছড়িয়ে পড়ায় উদ্বেগ জানান প্রধানমন্ত্রী।
তিনি বলেন, ‘সাম্প্রতিককালে পবিত্র কোরআন শরিফ পোড়ানোর মতো জঘন্য অপরাধ আমাদের বিবেককে নাড়া দিয়েছে। এ ধরনের জঘন্য অপরাধ শুধু মুসলিম সম্প্রদায়ের ধর্মীয় অনুভূতিকেই আঘাত করে না, এটি অস্থিরতাকে উসকে দেয় এবং বিভিন্ন ধর্মীয় বিশ্বাসের মানুষের মধ্যে বিদ্যমান সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি ও শান্তিপূর্ণ সহাবস্থানকে ক্ষতিগ্রস্ত করে।’ প্রধানমন্ত্রী ফিলিস্তিনের প্রতি বাংলাদেশের সমর্থন ব্যক্ত করেন।
রোহিঙ্গাদের প্রসঙ্গে শেখ হাসিনা বলেন, ‘সম্পূর্ণ মানবিক কারণে আমরা অস্থায়ীভাবে তাদের আশ্রয় দিয়েছি। কিন্তু পরিস্থিতি এখন আমাদের জন্য সত্যিই অসহনীয় হয়ে উঠেছে।’ তিনি বলেন, ‘বাংলাদেশে রোহিঙ্গাদের দীর্ঘায়িত উপস্থিতি বাংলাদেশের অর্থনীতি, পরিবেশ, নিরাপত্তা ও সামাজিক-রাজনৈতিক স্থিতিশীলতার ওপর মারাত্মক প্রভাব ফেলেছে। প্রত্যাবাসন নিয়ে অনিশ্চয়তা রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠীর মধ্যে ব্যাপক হতাশার জন্ম দিয়েছে। এই পরিস্থিতি সম্ভাব্য মৌলবাদকে ইন্ধন দিতে পারে। এই অবস্থা চলমান থাকলে এটি আমাদের আঞ্চলিক এবং আন্তর্জাতিক নিরাপত্তা ও স্থিতিশীলতাকে প্রভাবিত করতে পারে।’
প্রধানমন্ত্রী রোহিঙ্গাদের নিজ দেশে ফিরে যাওয়া নিশ্চিত করার আহ্বান জানান। বঙ্গবন্ধু হত্যাকাণ্ড, মুক্তিযুদ্ধে ৩০ লাখ শহীদ ও দুই লাখ নারীর নির্মম নির্যাতনের শিকার হওয়ার তথ্য তুলে ধরে তিনি বিশ্বনেতাদের যুদ্ধ ও সংঘাতের পথ পরিহার করার আহ্বান জানান।