অব্যাহত উন্নয়ন ও অগ্রগতির লক্ষ্যে বাংলাদেশ, ভারতসহ পুরো দক্ষিণ এশিয়ায় শান্তি ও স্থিতিশীলতা চায় নয়াদিল্লি। গতকাল শুক্রবার সন্ধ্যায় নয়াদিল্লিতে ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির সরকারি বাসভবনে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সঙ্গে দ্বিপক্ষীয় বৈঠকে এ বিষয়ে আলোচনা করা হয়েছে।
বৈঠকের পর ভারতের প্রধানমন্ত্রী বাংলায় এক টুইট বার্তায় বলেন, ‘প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সঙ্গে ফলপ্রসূ আলোচনা হয়েছে। গত ৯ বছরে ভারত-বাংলাদেশ সম্পর্কের অগ্রগতি খুবই সন্তোষজনক।
জি২০ সভাপতি ভারতের আমন্ত্রণে এর সম্মেলনে যোগ দিতে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা গতকাল দুপুরে নয়াদিল্লি পৌঁছেন।
পররাষ্ট্রমন্ত্রী বলেন, উভয় প্রধানমন্ত্রী বাংলাদেশ ও ভারতের মধ্যে বিদ্যমান গভীর সম্পর্কের বিষয়ে সন্তোষ প্রকাশ করেছেন।
বাংলাদেশে আসন্ন জাতীয় সংসদ নির্বাচন নিয়ে আলোচনা করা হয়েছে কি না, জানতে চাইলে পররাষ্ট্রমন্ত্রী বলেন, ‘নির্বাচন নিয়ে আমাদের সামনে আলোচনা হয়নি।
নির্বাচন নিয়ে যুক্তরাষ্ট্রের চাপের বিপরীতে ভারতের অবস্থান কী, জানতে চাইলে পররাষ্ট্রমন্ত্রী বলেন, ‘আপনারা (সাংবাদিকরা) বলেন, অনেক চাপ। আমরা তো সে রকম টের পাই না। আপনাদের কাছ থেকে শুনি। আপনারা এ ধরনের উসকানিমূলক প্রশ্ন করেন। ’
তত্ত্বাবধায়ক সরকার ছাড়া বিএনপির নির্বাচন বর্জনের হুমকি প্রসঙ্গে ভারতীয় এক সাংবাদিকের প্রশ্নের জবাবে মোমেন বলেন, ‘তত্ত্বাবধায়ক সরকার আর নেই। বিএনপিই ওই সরকারব্যবস্থাকে নষ্ট করেছে। আমরা এটি কোনোমতেই আর গ্রহণ করব না।’
পররাষ্ট্রমন্ত্রী বলেন, ‘নির্বাচিত সরকারের অধীনেই নির্বাচন হওয়া উচিত। কোনো ব্যক্তিবিশেষ হঠাৎ এসে নির্বাচনকালীন সরকার হবেন, এটি আমরা মানব না। আমরা মানতে পারি না। এ ক্ষেত্রে আমাদের ছাড় দেওয়ার সুযোগ নেই।’
বিএনপি নির্বাচন বর্জন করলে তা গ্রহণযোগ্য হবে কি না, জানতে চাইলে পররাষ্ট্রমন্ত্রী সাংবাদিকদের বলেন, ‘আমরা চাই নির্বাচন গ্রহণযোগ্য, সহিংসতামুক্ত হোক। কোনো দল যদি নির্বাচনে না আসে তাহলে কী করবেন? আমরা বিশ্বাসযোগ্য, অহিংস নির্বাচন চাই। একা সরকার, একা নির্বাচন কমিশন সহিংসতামুক্ত নির্বাচনের নিশ্চয়তা দিতে পারে না।’
নির্বাচনে বহির্বিশ্বের হস্তক্ষেপের আশঙ্কার বিষয়ে জানতে চাইলে পররাষ্ট্রমন্ত্রী মোমেন বলেন, ‘জনগণ সঙ্গে থাকলে বহির্বিশ্ব কিছুই করতে পারবে না। আমরা বিশ্বাস করি, জনগণ আমাদের সঙ্গে আছে। আর আমাদের দল অনেক বড়। আমরা ঐকমত্যের সঙ্গে কাজ করলে বহির্বিশ্বের ওগুলোর (হস্তক্ষেপের আশঙ্কা) শুধু গল্পই শুনবেন। আর আমাদের কোনো ক্ষতি করতে পারবে না। আর আমরা তো কোনো অসৎ কাজ করছি না।’
ভারতের সঙ্গে বৈঠকে আঞ্চলিক শান্তি ও স্থিতিশীলতার প্রসঙ্গ কেন এলো, জানতে চাইলে পররাষ্ট্রমন্ত্রী বলেন, ‘শান্তি ও স্থিতিশীলতা থাকলে দেশের উন্নয়ন ত্বরান্বিত হয়। আমাদের জাতির পিতা সব সময় বলতেন, উন্নয়নের জন্য শান্তি, স্থিতিশীলতা অপরিহার্য। আমরা সে জন্য শান্তি চাই।’
পররাষ্ট্রমন্ত্রী বলেন, শেখ হাসিনার সরকারের ভূমিকার কারণে আসামে শান্তি ও উন্নয়ন হয়েছে। আসামের মুখ্যমন্ত্রী নিজেই সেটি বলেছেন। শেখ হাসিনার সরকার সন্ত্রাসকে প্রশ্রয় দেয়নি। তিনি তাঁর কথা বাস্তবে রূপ দিয়েছেন।
মোমেন বলেন, ‘ভারত মনে করে, শান্তি ও স্থিতিশীলতা সব দেশের জন্য গুরুত্বপূর্ণ। ভারত ও বাংলাদেশ—আমরা মোটামুটি মনে করি, আমরা একইভাবে চিন্তা-ভাবনা করি। আমরা এ অঞ্চলে অস্থিতিশীলতা আনতে চাই না। এর কারণ হচ্ছে আমাদের ২০০১ থেকে ২০০৬ সালের অভিজ্ঞতা।’
পররাষ্ট্রমন্ত্রী বিএনপি-জামায়াত জোট সরকারের আমলে দুর্নীতি, সন্ত্রাস, জঙ্গিবাদের উত্থান, সংখ্যালঘু নির্যাতনের তথ্য তুলে ধরে বলেন, ‘বাংলাদেশ তখন সন্ত্রাসের দেশ, জিহাদিদের দেশ, বাংলা ভাইয়ের দেশ হিসেবে পরিচিত ছিল। আমরা সেই অবস্থায় ফিরতে চাই না। আমরা চাই শান্তি, সম্প্রীতি। বঙ্গবন্ধুর স্বপ্নের সোনার বাংলা, অসাম্প্রদায়িক বাংলাদেশ। আমরা পেছনে যেতে চাই না।’
নির্বাচন সামনে রেখে বিরোধীরা যদি অস্থিতিশীলতা সৃষ্টি করে তাহলে কী হবে, সাংবাদিকরা জানতে চাইলে পররাষ্ট্রমন্ত্রী বলেন, ‘আমরা জনগণের ওপর বিশ্বাস করি। কিছু লোক যদি নির্বাচন বানচালের চেষ্টা করে, জনগণকে সঙ্গে নিয়ে আমরা মোকাবেলা করব।’
মোমেন বলেন, ভারতের প্রধানমন্ত্রী ছাড়াও পররাষ্ট্রমন্ত্রীর সঙ্গেও তাঁদের আলোচনা হয়েছে। ভারতের পররাষ্ট্রমন্ত্রীর সঙ্গে কী আলোচনা হয়েছে, জানতে চাইলে পররাষ্ট্রমন্ত্রী মোমেন বলেন, বহুপক্ষীয় অনেক ইস্যুতে আলোচনা করা হয়েছে। ভারত গ্লোবাল সাউথ লিডার। বাংলাদেশও বিভিন্ন ক্ষেত্রে গ্লোবাল সাউথের লিডার। কিভাবে একসঙ্গে কাজ করা যায়, সে বিষয়ে আলোচনা করা হয়েছে।
পররাষ্ট্রমন্ত্রী বলেন, ‘দ্বিপক্ষীয় বিভিন্ন ইস্যুতে আলোচনা করা হয়েছে। যেমন—ভারত থেকে আমরা নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্য কিনি। কখনো কখনো সেগুলো ভারত থেকে আসে না। আমরা বলেছি, আপনারা (ভারত) কতটুকু দিতে পারবেন, সেটি আগেভাগে আমাদের জন্য কোটা দিয়ে দিলে আমাদের জন্য উপকার হয়। তারা এটি গ্রহণ করেছে।’
মোমেন বলেন, ‘বিভিন্ন বাজারের অবস্থা খারাপ। সেগুলোও তারা বিবেচনা করবে। এ ছাড়া একটি নদীর কাজ বন্ধ হয়ে আছে। আমরা নীতিগতভাবে তাতে সম্মতি জানানোর পরও আটকে আছে। সেটি কর্মকর্তা পর্যায়ে আলোচনা করে সমাধান করা হবে।’
রুপি-টাকা বিনিময়ে সমঝোতা প্রসঙ্গে জানতে চাইলে পররাষ্ট্রমন্ত্রী বলেন, ‘ভারত থেকে আমরা অনেক কিছু কিনি। কোনো কোনো ক্ষেত্রে আমরা টাকা রুপির বিপরীতে ব্যবহার করব। তার ফলে ডলারের যে সমস্যা, সেটি থেকে অনেকটুকু মুক্ত হব বলে আমরা আশা করছি। ’
বাংলাদেশের ইন্দো-প্যাসিফিক রূপরেখা এবং চীনের সঙ্গে ক্রমবর্ধমান সম্পর্ক নিয়ে ভারতের সঙ্গে আলোচনা হয়েছে কি না, জানতে চাইলে পররাষ্ট্রমন্ত্রী মোমেন বলেন, ভারত এ নিয়ে কোনো প্রশ্ন করেনি। আমাদের ইন্দো-প্যাসিফিক রূপরেখার প্রশংসা ইন্দো-প্যাসিফিকের দেশগুলো করেছে। জাকার্তায় ইন্দো-প্যাসিফিকের সবাই প্রশংসা করেছে।
মোমেন বলেন, রোহিঙ্গা ইস্যুতেও ভারতের প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে আলোচনা হয়েছে। রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসনে প্রধানমন্ত্রী ভারতের সহযোগিতা চেয়েছেন।
নয়াদিল্লিতে অনানুষ্ঠানিকভাবে পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের সঙ্গে শেখ হাসিনার সাক্ষাৎ হবে—গণমাধ্যমের এমন খবরের বিষয়ে জানতে চাইলে মোমেন বলেন, ‘এগুলো মিডিয়ার কথা। আপনারা বলেছেন। আমরা কিছু বলিনি।’
পররাষ্ট্রমন্ত্রী জানান, প্রধানমন্ত্রী আজ শনিবার এবং আগামীকাল রবিবার জি২০ সম্মেলনে অংশ নেবেন। সম্মেলনের বিভিন্ন অধিবেশনে প্রধানমন্ত্রী বক্তব্য দেবেন। সম্মেলনের ফাঁকে তিনি সৌদি ক্রাউন প্রিন্স এবং প্রধানমন্ত্রী, সংযুক্ত আরব আমিরাত, দক্ষিণ কোরিয়া ও আর্জেন্টিনার প্রেসিডেন্টের সঙ্গে বৈঠক করবেন। সফর শেষে তিনি আগামীকাল বিকেলে ঢাকায় ফিরবেন।