দারিদ্র্য বিমোচন এবং ক্ষুধা ও দারিদ্র্যমুক্ত দেশ গড়ার লক্ষ্যে পাঁচ কোটি মানুষকে প্রতি মাসে ভাতা প্রদান করছে সরকার। এতে সরকারের ব্যয় হচ্ছে বছরে ৫৭ হাজার ২২৩ কোটি টাকা। বর্তমানে সামাজিক সুরক্ষা কার্যক্রমের ২৫টি নগদ সহায়তা কর্মসূচির মধ্যে ২২টির অর্থ সরকার থেকে ব্যক্তি (জিটুপি) পদ্ধতিতে দেওয়া হচ্ছে। সমাজকল্যাণ মন্ত্রণালয় ছাড়াও মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক মন্ত্রণালয়, খাদ্য মন্ত্রণালয়, দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ও ত্রাণ মন্ত্রণালয় এবং বিভাগ নানা কর্মসূচির মাধ্যমে এসব ভাতা ও খাদ্য সহায়তা দিচ্ছে।
সরকারি তথ্য মতে, বর্তমানে ৫৭ লাখ এক হাজার বয়স্ক মানুষ প্রতি মাসে ৫০০ টাকা করে ভাতা পাচ্ছেন। আগামী অর্থবছর থেকে বয়স্ক ভাতা ১০০ টাকা বাড়িয়ে ৬০০ টাকা করা হচ্ছে। একই সঙ্গে উপকারভোগীর সংখ্যা বাড়ানো হয়েছে এক লাখ। বর্তমানে ২৪ লাখ ৭৫ হাজার বিধবা ও নির্যাতিতা নারীও মোবাইল ব্যাংকিংয়ের মাধ্যমে মাসিক ৫০০ টাকা সরকারি ভাতা পাচ্ছেন।
২০২৩-২৪ অর্থবছর থেকে ভাতার পরিমাণ ৫০ টাকা বাড়িয়ে ৫৫০ টাকা করা হচ্ছে এবং উপকারভোগীর সংখ্যা বাড়ছে এক লাখ। ২৩ লাখ ৬৫ হাজার শারীরিক প্রতিবন্ধী প্রতি মাসে ৮৫০ টাকা করে ভাতা পাচ্ছেন। পাঁচ লাখ ৩৫ হাজার বাড়িয়ে আগামী অর্থবছর থেকে ভাতা পাবেন ২৯ লাখ প্রতিবন্ধী। বর্তমানে এক লাখ প্রতিবন্ধী শিক্ষার্থী প্রতি মাসে উপবৃত্তি পাচ্ছেন।
প্রাথমিক স্তরের একজন শারীরিক প্রতিবন্ধী শিক্ষার্থী প্রতি মাসে ৭৫০ টাকা মাসিক উপবৃত্তি পাচ্ছেন এবং এই ভাতার পরিমাণ মাধ্যমিক স্তরের ক্ষেত্রে ৮০০ টাকা, উচ্চ মাধ্যমিক স্তরে ৯০০ টাকা, উচ্চশিক্ষা স্তরে এক হাজার ৩০০ টাকা। আগামী অর্থবছর থেকে প্রাথমিক স্তরের উপবৃত্তি ৭৫০ টাকা থেকে বাড়িয়ে ৯০০ টাকা, মাধ্যমিক স্তরে ৮০০ টাকা থেকে বাড়িয়ে ৯৫০ টাকা ও উচ্চ মাধ্যমিক স্তরে ৯০০ টাকা থেকে ৯৫০ টাকা করা হচ্ছে। মাধ্যমিক ও উচ্চ মাধ্যমিক স্তরের ভাতা এখন সমান, অর্থাৎ ৯৫০ টাকা হচ্ছে। চার হাজার ৮১৫ জন হিজড়া প্রতি মাসে ৬০০ টাকা করে ভাতা পাচ্ছেন। উপকারভোগীর সংখ্যা দুই হাজার ৬৫ জন বাড়িয়ে ছয় হাজার ৮৮০ করা হচ্ছে।
পাঁচ হাজার ৬৬ জন বেদে প্রতি মাসে ৬০০ টাকা করে ভাতা পাচ্ছেন। অনগ্রসর জনগোষ্ঠী থেকে উপকারভোগী ৬৯ হাজার ৫৭৩ থেকে বাড়িয়ে ৮২ হাজার ৫০৩ জন করা হচ্ছে। গ্রামীণ এলাকার দরিদ্র গর্ভবতী মায়ের জন্য বিদ্যমান মাতৃত্বকালীন ভাতা এবং শহর অঞ্চলের কম আয়ের কর্মজীবী মায়েদের জন্য ল্যাকটেটিং ভাতা দুটিকে সমন্বিত করে ‘মা ও শিশু সহায়তা কর্মসূচি’ নামে কার্যক্রম শুরু করে সরকার। এ কর্মসূচির আওতায় চলতি অর্থবছরে দেশের ১২ লাখ ৫৪ হাজার জনকে মাসে ৮০০ টাকা করে ভাতা দেওয়া হচ্ছে। এ খাতে বরাদ্দ রয়েছে এক হাজার ২৪৩ কোটি টাকা। পাশাপাশি দেশের হিজড়া, বেদে ও অনগ্রসর জনগোষ্ঠীর জীবনমান উন্নয়নে ভাতা দেওয়া হচ্ছে ৮৬ হাজার জনকে। চলতি অর্থবছর এ খাতে সরকারের বরাদ্দ রয়েছে ৪৬ কোটি ৩১ লাখ টাকা। এ ছাড়া ৪৫ হাজার ২৫০ সুবিধাবঞ্চিত মানুষকে একই অঙ্কের মাসিক ভাতার আওতায় আনা হয়েছে। প্রত্যেক চা-শ্রমিক বছরে পাঁচ হাজার টাকা করে ভাতা পাচ্ছেন এবং চা-শ্রমিকের সংখ্যা বেড়ে দাঁড়িয়েছে ৬০ হাজারে। জানা গেছে, শেখ রাসেল শিশু প্রশিক্ষণ ও পুনর্বাসন কেন্দ্রে প্রতিজনের জন্য সরকার তিন হাজার ৫০০ টাকা ব্যয় করছে এবং বেসরকারি খাতের এতিমখানার প্রত্যেক অনাথ শিশু মাসিক দুই হাজার টাকা ক্যাপিটেশন গ্রান্ট হিসেবে পাচ্ছে। সরকার ক্যান্সার, কিডনি, লিভারসিরোসিস, হৃদরোগ, থ্যালাসেমিয়া, জন্মগত হৃদরোগসহ পক্ষাঘাতগ্রস্তে আক্রান্ত ব্যক্তি অথবা স্ট্রোকের চিকিৎসার জন্য বার্ষিক ৫০ হাজার টাকা আর্থিক সহায়তা দিচ্ছে। এ ছাড়া সরকার বিভিন্ন কর্মসূচি, যেমন কক্লিয়ার ইমপ্লান্ট প্রদান এবং দগ্ধ ও শারীরিক প্রতিবন্ধীদের পুনর্বাসনে প্রান্তিক জনগোষ্ঠীকে নিয়মিত নগদ সহায়তা প্রদান করে যাচ্ছে। নতুন অর্থবছরে সরকার সামাজিক নিরাপত্তার আওতায় তিন লাখ শারীরিক প্রতিবন্ধী সুবিধাভোগীকে যুক্ত করতে যাচ্ছে।
চলতি অর্থবছর (২০২২-২৩) দেশের দুই লাখ এক হাজার ৫৯৩ বীর মুক্তিযোদ্ধাকে ২০ হাজার টাকা হারে মাসিক সম্মানী ভাতা দিচ্ছে সরকার। এ খাতে সরকারের বরাদ্দ রয়েছে চার হাজার ৬৫৩ কোটি ৩৫ লাখ টাকা। আগে এ ভাতার পরিমাণ ছিল ১২ হাজার টাকা। সম্মানী ভাতার পাশাপাশি দুটি উৎসব ভাতা, জীবিত বীর মুক্তিযোদ্ধাদের জন্য বিজয় দিবস ভাতা এবং সবার জন্য বৈশাখী ভাতাও চালু রয়েছে। সাধারণ মুক্তিযোদ্ধার পাশাপাশি দেশের প্রায় ১৩ হাজার খেতাবপ্রাপ্ত, শহীদ পরিবার ও যুদ্ধাহত বীর মুক্তিযোদ্ধাদের চিকিৎসা এবং সম্মানী ভাতা দিচ্ছে সরকার। ছয় হাজার ১৭৪ যুদ্ধাহত বীর মুক্তিযোদ্ধাকে পঙ্গুত্বের ধরনভেদে ২৫ হাজার থেকে ৪৫ হাজার টাকা মাসিক সম্মানী ভাতা দেওয়া হচ্ছে। এ ছাড়া পাঁচ হাজার ৮১৬টি শহীদ পরিবারকে মাসিক ৩০ হাজার, মৃত ও যুদ্ধাহত মুক্তিযোদ্ধার পরিবারকে মাসিক ২৫ হাজার, সাত বীরশ্রেষ্ঠ শহীদ পরিবারকে মাসিক ৩৫ হাজার, বীর-উত্তম খেতাবধারীদের মাসিক ২৫ হাজার, বীরবিক্রম খেতাবধারীদের মাসিক ২০ হাজার ও বীরপ্রতীক খেতাবধারীদের মাসিক ১৫ হাজার টাকা হারে ভাতা দেওয়া হচ্ছে।
এ ছাড়া সরকারি কর্মচারীদের অবসর ও পারিবারিক অবসর ভাতাও দেওয়া হচ্ছে। এসব কর্মসূচির সুবিধাভোগীর সংখ্যা এক কোটি ২৮ লাখ ৪৭ হাজার। এসবের বাইরে ১১টি কর্মসূচির মাধ্যমে এক কোটি ৬২ লাখ ৯৭ হাজার মানুষকে বিভিন্নভাবে খাদ্য সহায়তা দেওয়া হচ্ছে। নগদ অর্থ ও খাদ্য সহায়তার সুবিধাভোগীর সংখ্যা চার কোটি ৯১ লাখ ৪৪ হাজার। এর মধ্যে ভিজিএফে এক কোটি ৮০ লাখ, খাদ্যবান্ধব কর্মসূচিতে ৬২ লাখ ৫০ হাজার, ওএমএসে ৩৭ লাখ ৩৫ হাজার, জিআরে (খাদ্য) ৩৩ লাখ, কাবিটায় ১৮ লাখ ২০ হাজার, কাবিখায় এক লাখ ৮০ হাজার এবং ভিডাব্লিউবি কার্যক্রমে সাড়ে ১০ লাখ মানুষ খাদ্য সুবিধা পাচ্ছেন। বর্তমানে সরকারের ২৪টি মন্ত্রণালয় ও বিভাগের মাধ্যমে দেশে সামাজিক নিরাপত্তাবেষ্টনী খাতের আওতায় ১২৩টি কর্মসূচি চলমান।
সমাজকল্যাণসচিব মো. জাহাঙ্গীর আলম গতকাল গণমাধ্যমকে বলেন, ‘বঙ্গবন্ধুর সুযোগ্য কন্যা দুস্থ, বয়স্ক, অসহায়, প্রতিবন্ধী, বিধবা, নির্যাতিতা নারী ও অসচ্ছল শিক্ষার্থীদের জন্য ভাতা চালু করেছেন।’ তিনি বলেন, জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান গ্রামীণ ও দুস্থ মানুষের ভাগ্য ও জীবন-জীবিকার পরিবর্তনের জন্য ‘সেফটি নেট কর্মসূচি’র সূচনা করেছিলেন। এখন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা জনকল্যাণে বঙ্গবন্ধুর সেই অসমাপ্ত কর্মসূচি এগিয়ে নিয়ে যাচ্ছেন।