মার্চ মাস জাতির পিতা শেখ মুজিবুর রহমানের জীবনে অত্যন্ত তাৎপর্যময়। ১৭ মার্চ তাঁর জন্মদিন বলে নয়, ১৯৭১-এর মার্চ বঙ্গবন্ধুর জীবনের সবচেয়ে ঘটনাবহুল এবং গৌরবের মাস। ১ মার্চ ১৯৭১ দুপুরে রেডিও পাকিস্তানের বিশেষ অনুষ্ঠানে পঠিত প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খানের এক বিবৃতিতে ৩ মার্চ থেকে ঢাকায় অনুষ্ঠেয় জাতীয় সংসদের অধিবেশন স্থগিত ঘোষণা করা হয়। ঘটনার এই আকস্মিকতা বদলে দেয় পূর্ব পাকিস্তানের রাজনৈতিক পরিবেশ। সৃষ্টি হয় অগ্নিগর্ভ পরিস্থিতির। আর এই মার্চ মাসজুড়ে বঙ্গবন্ধু অসীম সাহসিকতা ও রাজনৈতিক প্রজ্ঞা দিয়ে বাঙালিকে স্বাধীনতা সংগ্রামের জন্য তৈরি করেছেন। একাত্তরের মার্চের মতো কঠিন সময় বঙ্গবন্ধুর জীবনে হয়তো আর আসেনি।
জন্মদিন নিয়ে বঙ্গবন্ধুর আলাদা কোনো ভাবনা ছিল না। ফিরে যেতে চাই ১৭ মার্চ ১৯৬৭-তে। বঙ্গবন্ধু তখন ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারে বন্দি। ‘কারাগারের রোজনামচা’য় বঙ্গবন্ধু লিখছেন : “আজ আমার ৪৭তম জন্মবার্ষিকী। এই দিনে ১৯২০ সালে পূর্ব বাংলার এক ছোট্ট পল্লীতে জন্মগ্রহণ করি। আমার জন্মবার্ষিকী আমি কোনো দিন নিজে পালন করি নাই—বেশি হলে আমার স্ত্রী এই দিনটাতে আমাকে ছো্ট্ট একটি উপহার দিয়ে থাকত। এই দিনটিতে আমি চেষ্টা করতাম বাড়িতে থাকতে। খবরের কাগজে দেখলাম ঢাকা সিটি আওয়ামী লীগ আমার জন্মবার্ষিকী পালন করছে। বোধ হয়, আমি জেলে বন্দি আছি বলেই। ‘আমি একজন মানুষ, আর আমার আবার জন্মদিবস!’ দেখে হাসলাম। মাত্র ১৪ তারিখে রেণু ছেলেমেয়েদের নিয়ে দেখতে এসেছিল। আবার এত তাড়াতাড়ি দেখা করতে অনুমতি কি দিবে? মন বলছিল, যদি আমার ছেলেমেয়েরা ও রেণু আসত ভালই হতো। ১৫ তারিখেও রেণু এসেছিল জেলগেটে মনির সাথে দেখা করতে।” … …
“তখন সাড়ে চারটা বেজে গিয়েছে, বুঝলাম আজ বোধ হয় রেণু ও ছেলেমেয়েরা দেখা করার অনুমতি পায় নাই। পাঁচটাও বেজে গেছে। ঠিক সেই মুহূর্তে জমাদার সাহেব বললেন, চলুন, আপনার বেগম সাহেবা আর ছেলেমেয়েরা এসেছে। তাড়াতাড়ি কাপড় পরে রওয়ানা করলাম জেলগেটের দিকে। ছোট মেয়েটা আর আড়াই বৎসরের ছেলে রাসেল ফুলের মালা হাতে করে দাঁড়াইয়া আছে। মালাটা নিয়ে রাসেলকে পরাইয়া দিলাম। সে কিছুতেই পরবে না, আমার গলায় দিয়ে দিল। ওকে নিয়ে আমি ঢুকলাম রুমে। ছেলেমেয়েদের চুমা দিলাম। দেখি সিটি আওয়ামী লীগ একটা বিরাট কেক পাঠাইয়া দিয়াছে। রাসেলকে দিয়েই কাটালাম, আমিও হাত দিলাম। জেলগেটের সকলকে কিছু কিছু দেওয়া হলো। কিছুটা আমার ভাগ্নে মনিকে পাঠাতে বলে দিলাম জেলগেট থেকে। ওর সাথে তো আমার দেখা হবে না, এক জেলে থেকেও। আর একটা কেক পাঠাইয়াছে বদরুন, কেকটার ওপর লিখেছে ‘মুজিব ভাইয়ের জন্মদিনে’। বদরুন আমার স্ত্রীর মারফতে পাঠাইয়াছে এই কেকটা। নিজে তো দেখা করতে পারল না, আর অনুমতিও পাবে না। ছয়টা বেজে গিয়াছে, তাড়াতাড়ি রেণু ও ছেলেমেয়েদের বিদায় দিতে হলো। রাসেলও বুঝতে আরম্ভ করেছে, এখন আর আমাকে নিয়ে যেতে চায় না। আমার ছোট মেয়েটা খুব ব্যথা পায় আমাকে ছেড়ে যেতে, ওর মুখ দেখে বুঝতে পারি। ব্যথা আমিও পাই, কিন্তু উপায় নাই। রেণুও বড় চাপা, মুখে কিছুই প্রকাশ করে না। ফিরে এলাম আমার আস্তানায়। ঘরে ঢুকলাম, তালা বন্ধ হয়ে গেল বাইরে থেকে। ভোর বেলা খুলবে।”
১৭ মার্চ ১৯৭১ ছিল বঙ্গবন্ধুর ৫২তম জন্মদিন। প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়ার সঙ্গে দ্বিতীয় দফা বৈঠকের পর বঙ্গবন্ধু তাঁর বাসভবনে সাংবাদিকদের সঙ্গে আলাপকালে বলেছিলেন, ‘আমি আমার জন্মদিনের উৎসব পালন করি না। এই দুঃখিনী বাংলায় আমার জন্মদিনই বা কি আর মৃত্যুদিনই বা কি?’
বঙ্গবন্ধু কি সেদিন কল্পনা করতে পেরেছিলেন, তিনি চলে যাবার পর তাঁর এই বাংলাদেশে তাঁর জন্মদিন আর মৃত্যুদিন কত তাৎপর্যপূর্ণ হয়ে উঠতে পারে? প্রায় দুই বছরব্যাপী তাঁর জন্মশতবর্ষ পালন ছিল তাঁর প্রতি বাঙালির কৃতজ্ঞতার অর্ঘ্য। এ আয়োজনটা তাঁর জন্য না যতটা, আমাদের নিজেদের জন্য অনেক অনেক বেশি প্রয়োজনীয় ছিল।
যদি একাত্তরের মার্চে ফিরে যাই, তবে দেখব প্রতিদিনই তাঁকে নতুন নতুন পরিস্থিতির মোকাবেলা করতে হচ্ছে। ২ মার্চ, ১৯৭১ ঢাকায় ১০ ঘণ্টার জন্য সান্ধ্য আইন জারি করা হয়। কিন্তু জনগণ তা অগ্রাহ্য করে রাস্তায় রাস্তায় মিছিল করে বাংলাদেশের স্বাধীনতার পক্ষে সোচ্চার হয়। সেনাবাহিনী সান্ধ্য আইন ভঙ্গকারীদের লক্ষ্য করে গুলি ছোড়ে এবং বহু হতাহত হয়। সংবাদপত্রে সংবাদ ও ছবি ছাপার ওপর কড়াকড়ি আরোপ করে নতুন সামরিক বিধি জারি করা হয়। ৩ মার্চ সারা বাংলাদেশে পূর্ণ হরতাল পালিত হয়। পূর্ব পাকিস্তান ছাত্রলীগ আওয়ামী লীগের গৃহীত কর্মসূচির সমর্থনে পল্টন ময়দানে এক বিশাল জনসভার আয়োজন করে। এ জনসভা ছিল সাম্প্রতিককালে সবচেয়ে জঙ্গি সমাবেশ। অসংখ্য নারী-পুরুষের হাতে বাঁশের লাঠি, লোহার রড, বল্লম, টেঁটা আর তলোয়ার ছিল। বঙ্গবন্ধু সভাস্থলে আগমন করলে জনতা লাঠির ওপর লাঠির আঘাতে এক অপূর্ব ঝনঝনায় নেতাকে স্বাগত জানায়। মঞ্চে বুলেটবিদ্ধ কর্মীদের লুঙ্গি ও জামা পতাকার মতো উড়িয়ে রাখা হয়েছে। কালো পতাকার সঙ্গে সবুজের ওপর লাল বৃত্তের মধ্যে বাংলাদেশের মানচিত্রখচিত একটি নতুন পতাকাও ছিল। উল্লেখ্য, ছাত্রসমাজ আগে থেকেই বাংলাদেশের স্বাধীনতা ঘোষণার জন্য বঙ্গবন্ধুকে চাপ দিচ্ছিল। পূর্ব পাকিস্তান ছাত্রলীগের সভাপতি নূরে আলম সিদ্দিকী সভায় সভাপতিত্ব করেন। বঙ্গবন্ধু তাঁর ভাষণে জনগণকে শান্তিপূর্ণভাবে আন্দোলন চালিয়ে যাওয়ার আহ্বান জানান।
৭ মার্চ ঢাকার রেসকোর্সে যে অভূতপূর্ব জনসমাগম হয়, তাতে বঙ্গবন্ধু মাত্র ১৮ মিনিটের যে ভাষণ দিয়েছিলেন, তা বোধ হয় তাঁর জীবনের শ্রেষ্ঠ ভাষণ। কোনো লিখিত নোট ছাড়া তিনি বর্তমান আন্দোলনের ঐতিহাসিক প্রেক্ষাপট অসাধারণ দক্ষতার সঙ্গে একের পর এক বর্ণনা করে যান। তাঁর ওপর চাপ ছিল স্বাধীনতা ঘোষণার। কিন্তু বঙ্গবন্ধু জানতেন, এ সময়ে স্বাধীনতা ঘোষণা করলে তাঁকে বিচ্ছিন্নতাবাদী হিসেবে আখ্যায়িত করা হবে। কিন্তু তাঁর জাদুকরী কথামালার মধ্যে ‘স্বাধীনতা’ শব্দটি এমনভাবে উচ্চারণ করেছিলেন যে কেউ তাকে সরাসরি স্বাধীনতার ঘোষণা হিসেবে নিতে পারবে না। আইনের দৃষ্টিতে তিনি নিরপরাধ, যখন বলেন, ‘এবারের সংগ্রাম আমাদের মুক্তির সংগ্রাম, এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম।’
আজ বিশ্বের সেরা ভাষণগুলোর মধ্যে ৭ মার্চের ভাষণ স্থান করে নিয়েছে। ইউনেসকো ভাষণটিকে বিশ্ব ঐতিহ্যের স্বীকৃতি দিয়েছে। আজও যখনই ভাষণটি আমরা শুনি, আমরা শিহরিত হই, তাঁর প্রতি শ্রদ্ধায় অবনত হই।
মার্চ মাসজুড়ে বঙ্গবন্ধু যে অসহযোগ আন্দোলনের সূচনা করেছিলেন, তার নজির দ্বিতীয়টি পাওয়া যাবে কি না সন্দেহ। সারা পূর্ব পাকিস্তানের প্রশাসন বঙ্গবন্ধুর নির্দেশে পরিচালিত হয়েছে। ২৫ মার্চ যখন পাকিস্তান বাহিনী নিরস্ত্র বাঙালিদের ওপর গণহত্যা শুরু করে, তার পরই ২৬ মার্চের প্রথম প্রহরে বঙ্গবন্ধু বাংলাদেশের স্বাধীনতা ঘোষণা করেন। মার্চ মাসেই আমরা পাই বঙ্গবন্ধুর জীবনের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ঘোষণা। তাই মার্চ মাস কেবল বঙ্গবন্ধুর জীবনে নয়, আমাদের জীবনেও অত্যন্ত তাৎপর্যপূর্ণ ও গৌরবদীপ্ত।
লেখক : সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্ব, অনারারি প্রেসিডেন্ট (ওয়ার্ল্ড ওয়াইড),