১৯৭১ সালে তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানে আওয়ামী লীগ ও সমমনার পাশাপাশি ভিন্ন মতাদর্শের বিভিন্ন রাজনৈতিক পক্ষ ছিল। আন্দোলনে সক্রিয় ছাত্রসমাজের পাশাপাশি ছিল সাংবাদিক, অধ্যাপক, কবি, সাহিত্যিকসহ বুদ্ধিজীবীমহল। স্বাধীনতার সংগ্রাম বা তার প্রক্রিয়া প্রশ্নে এসব পক্ষের চিন্তা-ভাবনায় ভিন্নতা ছিল। সাধারণ মানুষেরও কারো কারো মধ্যে ছিল প্রশ্ন বা সংশয়। কিন্তু বঙ্গবন্ধুর ৭ই মার্চের ঐতিহাসিক ভাষণের পর প্রায় সবার ভাবনা একটি বিন্দুতে এসে মেলে।
বিশ্ব ইতিহাসের অন্যতম উল্লেখযোগ্য ভাষণের স্বীকৃতি পাওয়া ৭ই মার্চের বত্তৃদ্ধতায় বঙ্গবন্ধু সব শ্রেণির মানুষের সঙ্গে সফলভাবে যোগাযোগ স্থাপন করতে পেরেছিলেন। এ কারণেই বিভিন্ন পক্ষের মধ্যে থাকা যোগাযোগের অস্পষ্টতা ও ভিন্নতা দূর হয়েছিল।
সহজ-সাধারণ ভাষা
৭ই মার্চের ভাষণে বঙ্গবন্ধু শব্দচয়ন ও ভাষার ক্ষেত্রে সবার আগে সাধারণ মানুষের কথা মাথায় রেখেছেন বলে মনে করেন শামীম রেজা। তিনি বলেন, ‘যাদের সঙ্গে সবচেয়ে বেশি যোগাযোগ স্থাপনের দরকার ছিল, তারা হলো সাধারণ জনগণ। সাড়ে সাত কোটি মানুষের বেশির ভাগই সাধারণ বা কমবেশি আঞ্চলিক ভাষায় কথা বলত। সাধারণ মানুষের সঙ্গে সফলভাবে যোগাযোগ করতে গেলে তাদের ভাষায়ই তা করতে হবে।’
ভাষণটিকে নদীর সঙ্গে তুলনা করে শামীম রেজা বলেন, ‘বঙ্গবন্ধুর আগের বক্তব্যগুলো ছিল ছোট ছোট প্রবাহের মতো। ৭ই মার্চের এই ভাষণ প্রবাহ থেকে নদীতে রূপ নেয়।’
শ্রোতার মন বোঝা
যোগাযোগবিজ্ঞানের দিক থেকে দেখলে, একটা ভাষণ তখনই কার্যকর হয় যখন বক্তা শ্রোতারা কী শুনতে চায় তা বুঝতে পারেন। ১০ লাখ মানুষের সেদিনের সমাবেশে বঙ্গবন্ধু তা সঠিকভাবেই বুঝতে পেরেছেন বলে মনে করেন আরেফিন সিদ্দিক। তিনি বলেন, বঙ্গবন্ধুর ছোট ছোট বাক্যে জনগণকে নির্দেশনা দেওয়ার বিষয়টি অত্যন্ত কার্যকর ছিল। যোগাযোগবিজ্ঞানে বলা হয়, ছোট বাক্য শক্তিশালী বাক্য। যেমন, বঙ্গবন্ধু বলেছেন, ‘প্রত্যেক ঘরে ঘরে দুর্গ গড়ে তোল।’
কাব্যধর্মিতা
তুলনামূলক অনন্যতা
বিশ্বের অন্যান্য বিখ্যাত ভাষণের তুলনায় ৭ই মার্চের ভাষণের অনন্যতা সম্পর্কে বলতে গিয়ে আরেফিন সিদ্দিক বলেন, “বঙ্গবন্ধুর এই ভাষণ ছিল ‘উপস্থিত বত্তৃদ্ধতা’। তিনি লিখিত কিছু না নিয়ে এসে প্রথম থেকে শেষ পর্যন্ত তাত্ক্ষণিকভাবে বলে গেছেন। এ রকম ভাষণ খুব একটা দেখা যায় না।”
অন্যদিকে মুক্তিযুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়ার জন্য যে কৌশলী আহ্বান জানানো হয়েছে, তা-ই এ ভাষণকে অনন্যসাধারণ করেছে বলে মনে করেন অধ্যাপক শামীম রেজা। তিনি বলেন, ‘যুদ্ধের আহ্বান সত্ত্বেও এই ভাষণে একটা মার্জিত ভাব ও পবিত্রতা আছে। পরের দিনই জঙ্গিভাবে ঝাঁপিয়ে পড়তে বলা হয়নি। দীর্ঘ ইতিহাসের বয়ান দিয়ে জাতির ক্ষোভ, বঞ্চনা, যন্ত্রণা প্রকাশ করেছেন। কাউকে তিনি কোনো ভর্ত্সনাও করেননি। এমন মার্জিত ভাব বজায় রেখে এ রকম একটা ভাষণ দেওয়া অসাধারণ ব্যাপার।’
এ সময়ে প্রাসঙ্গিকতা
আরেফিন সিদ্দিক বলেন, ‘বঙ্গবন্ধুর ভাষণ এখনো প্রতি মুহূর্তে আমাদের জন্য প্রাসঙ্গিক। এই ভাষণের আবেদন সব সময় থেকে যাবে।’ তিনি বলেন, বঙ্গবন্ধু নিজেই বলেছেন, ‘এবারের সংগ্রাম আমাদের মুক্তির সংগ্রাম।’ মুক্তির সংগ্রাম শেষ হবে না কখনো। অশিক্ষা, কুশিক্ষা, অপসংস্কৃতি, অপরাজনীতি থেকে মুক্তিসহ জীবনের নানা ক্ষেত্রে মানুষের মুক্তির প্রয়োজন এখনো আছে।
অধ্যাপক শামীম রেজা বলেন, ‘একটা ভাষণকে কেন্দ্র করে বড় একটা মুক্তিযুদ্ধের কৌশল ও রাজনৈতিক কৌশল তৈরি করা হয়েছে। এ রকম একটা বিষয় কখনো তো আমাদের স্মৃতি থেকে যাবে না। বঙ্গবন্ধুর এই ভাষণে এই স্বাধীনতার সংগ্রাম ও রাজনীতির বাইরেও আলাদা একটা আবেদন, কাব্যময়তা আছে।’
শামীম রেজা আরো বলেন, ‘নতুন প্রজন্ম এটাকে অন্য রকম বিস্ময়ের সঙ্গে শুনছে। তারা এটা নতুনভাবে আবিষ্কার করছে। এই ভাষণ নিয়ে নতুন প্রজন্মের বিস্ময় ও কৌতূহল আছে। এর সঙ্গে যুক্ত হয়েছে বক্তার ব্যক্তিত্ব ও অসাধারণ বত্তৃদ্ধতা দেওয়ার ক্ষমতা।’
সীমানা পেরিয়ে আগ্রহ
বিশ্বের বিভিন্ন দেশে বঙ্গবন্ধুর ৭ই মার্চের ভাষণ নিয়ে গবেষণা ও আগ্রহ বেড়েছে বলে মনে করেন অধ্যাপক আরেফিন সিদ্দিক ও অধ্যাপক শামীম রেজা। আরেফিন সিদ্দিক বলেন, ইউরোপের কোনো কোনো দেশে পাবলিক স্পিকিং বা জনবত্তৃদ্ধতা কোর্সে ভাষণটি শোনানো হয় ছাত্র-ছাত্রীদের।
অধ্যাপক শামীম রেজা বলেন, ‘৭ই মার্চের ভাষণ নিয়ে বাইরে আগ্রহ ও গবেষণা অনেক বেড়েছে। এর মধ্যে নতুনত্ব ও বৈচিত্র্য দেখছি। কেউ হয়তো এর ভাষা, কেউ প্রভাব, কেউ সমসাময়িক প্রেক্ষাপট নিয়ে কাজ করছেন। একাডেমির বাইরেও অনেক গবেষক উঁচু মানের কাজ করেছেন।’
সূত্র: কালের কন্ঠ অনলাইন