বঙ্গবন্ধুকে সপরিবারে হত্যা করার পর বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর উপপ্রধান জিয়াউর রহমান ক্ষমতা দখল করার পর তাঁর ক্ষমতাকে স্থায়ী করার জন্য যে রাজনৈতিক দলটি গঠন করেন সেটি আজকের বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দল বা বিএনপি। বলা যেতে পারে হঠাৎ করে ব্যক্তি ও গোষ্ঠীর প্রয়োজনে গড়ে ওঠা একটি বহুমত ও পথের ধারণ করা একটি রাজনৈতিক ক্লাব, দল নয়। একটি স্বাভাবিক রাজনৈতিক দল গড়ে উঠতে কিছু প্রক্রিয়া অতিক্রম করে, যা বিএনপির ক্ষেত্রে ঘটেনি। সেই বিএনপি এখন দেশের অন্যতম বৃহত্তম রাজনৈতিক দল।
জিয়া সঠিক অর্থে মুক্তিযোদ্ধা ছিলেন কি ছিলেন না সেই বিতর্ক অনেক পুরনো। কারণ ২৫-২৬ মার্চ ১৯৭১ সালে রাত ১০টা পর্যন্ত তিনি পাকিস্তান সেনাবাহিনীর একজন অফিসার হিসেবে চট্টগ্রাম বন্দরে পশ্চিম পাকিস্তান থেকে বাঙালি নিধনের জন্য আনা অস্ত্র খালাসের চেষ্টায় লিপ্ত ছিলেন। একই সময় ক্যাপ্টেন আবু ওসমান চৌধুরী, মেজর সফিউল্লাহ, মেজর খালেদ মোশাররফ, ক্যাপ্টেন রফিকসহ আরো অনেকে দেশের বিভিন্ন অংশে পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করেছেন। শেষতক জিয়া চট্টগ্রাম শহরের বাইরে সেনাবাহিনীর অস্থায়ী ক্যাম্প ষোলশহরে ফিরে গিয়ে তাঁর ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তার বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করেন। অন্যদের মতো জিয়া কতটুকু নিজের বিশ্বাস থেকে মুক্তিযোদ্ধা ছিলেন আর কতটুকু বাধ্য হয়ে মুক্তিযুদ্ধে গিয়েছিলেন সেই বিতর্ক বহু পুরনো। তবে এটি ঠিক, বঙ্গবন্ধু তাঁকে বীর-উত্তম খেতাবে ভূষিত করেছিলেন এবং সেনাবাহিনীতে উপপ্রধানের একটি পদ সৃষ্টি করে তাতে তাঁকে পদায়ন করেছিলেন।
বঙ্গবন্ধু নিহত হওয়ার পর দেশের প্রথম সেনাশাসক হিসেবে জিয়া ক্ষমতা দখল করলে তাঁর আসল রূপ প্রকাশিত হতে শুরু করে। তিনি ফরমান জারি করে বঙ্গবন্ধুর নাম নেওয়া নিষিদ্ধ করেন। নিষিদ্ধ হয় বাঙালির প্রাণের স্লোগান ‘জয় বাংলা’। একাত্তরে পাকিস্তানি সেনাবাহিনী বাঙালিদের ওপর গণহত্যা চালিয়েছিল না বলে বলা ও লেখা শুরু হয় হানাদার বাহিনীর। এই হানাদার বাহিনী কারা ছিল তা পরবর্তী ২১ বছর নতুন প্রজন্ম জানতে পারেনি। জিয়া বাহাত্তরের সংবিধানের প্রাণ তার প্রস্তাবনা থেকে ‘জাতীয় মুক্তির জন্য ঐতিহাসিক সংগ্রাম’ শব্দগুলোর পরিবর্তে ‘জাতীয় স্বাধীনতার জন্য ঐতিহাসিক যুদ্ধের’ শব্দগুলো প্রতিস্থাপন করে পাকিস্তানের ২৩ বছরে বাঙালির বিভিন্ন পর্যায়ের মুক্তিসংগ্রামকে অস্বীকার করেন। এই প্রস্তাবনাই ছিল বাংলাদেশের স্বাধীনতার মূল ঘোষণাপত্র, আর এই ঘোষণাপত্রের ওপর ভিত্তি করে বাংলাদেশের প্রথম সরকার ১৯৭১ সালের ১৭ এপ্রিল শপথ গ্রহণ করে। বাহাত্তরে সংবিধান রচিত না হওয়া পর্যন্ত এই প্রস্তাবনাকেই সংবিধান হিসেবে গণ্য করা হতো। জিয়া এখানেই থেমে থাকেননি। মোশতাকের জারি করা ইনডেমনিটি অধ্যাদেশ তিনি সংসদে জায়েজ করেন। সংবিধান ও দেশ থেকে মুক্তিযুদ্ধের চেতনাকে বিতাড়িত করতে যত রকমের অপকর্ম করা প্রয়োজন তা করতে বিন্দুমাত্র দ্বিধা করেননি তিনি। সংবিধান থেকে ‘ধর্মনিরপেক্ষতা’ বাতিল করে দেশকে একটি সাম্প্রদায়িক রাষ্ট্রে পরিণত করার সব দ্বার উন্মুক্ত করে দেন। সাংবিধানিকভাবে নিষিদ্ধ একাত্তরে পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর দোসর জামায়াত, মুসলিম লীগ, পিডিপির মতো ধর্মভিত্তিক দলগুলোকে প্রকাশ্যে রাজনীতি করার সুযোগ করে দেন। একাত্তরের ঘাতক শিরোমণি গোলাম আযমকে তিনি পাকিস্তানি পাসপোর্ট নিয়ে বাংলাদেশে প্রবেশ করতে দেন। জামায়াতের হাল ধরেন এই গোলাম আযম।
১৯৮১ সালে এক ব্যর্থ সেনা অভ্যুত্থানে জিয়া নিহত হলে প্রায় ৯ বছর আরেক সেনাশাসক জেনারেল এরশাদ একই ভাবধারায় দেশ শাসন করেন। ১৯৯১ সালের নির্বাচনে জিয়ার স্ত্রী খালেদা জিয়া জয়ী হয়ে সরকার গঠন করলে ধারণা করা হয়েছিল পরিস্থিতির কিছুটা উন্নতি হবে। হলো হিতে বিপরীত। একাত্তরের ঘাতকদের তিনি পুরোপুরিভাবে পুনর্বাসনের কর্মসূচি হাতে নিলেন এবং ২০০১ সালে ক্ষমতায় এসে তা পূর্ণাঙ্গতা লাভ করে। তাঁর মন্ত্রিসভায় জামায়াতিদের ঠাঁই হয়। দেশ হয়ে উঠে জঙ্গিবাদের অভয়ারণ্য। রাষ্ট্রের প্রতিটি ক্ষেত্রে দুর্নীতি হয়ে ওঠে একটি সূক্ষ্ম শিল্প।
জিয়ার প্রতিষ্ঠিত বিএনপি ২০০৬ সাল থেকে ক্ষমতার বাইরে। দলটির চেয়ারপারসন খালেদা জিয়া দুর্নীতির দায়ে সাজাপ্রাপ্ত হয়ে এখন দীর্ঘ কারাদণ্ড ভোগ করছেন। এই মুহূর্তে অবশ্য তিনি প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নির্বাহী আদেশে মুক্ত মানুষ হিসেবে নিজ পরিজনদের সঙ্গে বাস করছেন। দলের ভারপ্রাপ্ত চেয়ারপারসন খালেদা জিয়ার জ্যেষ্ঠ পুত্র তারেক রহমান দুর্নীতি, অস্ত্র চোরাচালান, ২১ আগস্টের গ্রেনেড হামলা মামলায় যাবজ্জীবন কারাদণ্ডে দণ্ডিত হয়ে বর্তমানে আইনের দৃষ্টিতে লন্ডনে পলাতক। তিনি তাঁর বাংলাদেশি পাসপোর্টও সারেন্ডার করেছেন। দেশের ভেতর দল অনেকটা কাণ্ডারিবিহীন নৌকার মতো বেঁচে থাকার চেষ্টা করছে এবং দলের নেতারা বছর শেষে সাংবিধানিকভাবে অনুষ্ঠেয় দ্বাদশ সংসদ নির্বাচন বানচাল করার জন্য নানাভাবে চেষ্টা করে যাচ্ছেন। দল হয়ে পড়েছে নানা উপদলে বিভক্ত। যদিও প্রকাশ্যে তারা জনগণকে দেখানোর চেষ্টা করছে তাদের লক্ষ্য এক ও অভিন্ন, বর্তমান সরকারকে নির্বাচনের মাধ্যমে নয়, অসাংবিধানিকভাবে উত্খাত করে নিজেরা ক্ষমতা দখল করা। সঙ্গে জুটেছে কিছু রাজনৈতিক পরগাছা। আছে ওয়ান ম্যান পার্টি, মৌলবাদী ও বামপন্থী। বিএনপির একটি বড় কীর্তি হচ্ছে তারা নিজেদের স্বার্থে বাম-ডানকে এক ঘাটে পানি খাওয়াতে পারে।
আওয়ামী লীগ সরকারকে উত্খাতের নামে সম্প্রতি দলের নেতারা এতই বেপরোয়া হয়ে উঠেছেন যে তাঁরা দেশ, মুক্তিযুদ্ধ ও ৩০ লাখ শহীদের রক্ত দিয়ে লিখিত সংবিধান নিয়ে প্রলাপ বকা শুরু করেছেন। দলের শীর্ষ নেতা গয়েশ্বর চন্দ্র রায় একাধিকবার দলের সভায় বলেছেন, বাংলাদেশের স্বাধীনতা অ্যাক্সিডেন্টাল বা হঠাৎ পাওয়া। এটি ৩০ লাখ শহীদের গালে থাপ্পড় মারার শামিল। এর আগে তিনি শহীদ বুদ্ধিজীবীদের সম্পর্কে বলতে গিয়ে বলেছেন, তাঁরা বোকা ছিলেন, না হলে তাঁদের বিপদ অবধারিত জেনেও কেন তাঁরা ১৪ ডিসেম্বর নিজ বাসভবনে অবস্থান করছিলেন? দলের আরেক নেতা আবদুল আউয়াল মিন্টু, যিনি একসময় আওয়ামী লীগ ঘনিষ্ঠ ছিলেন, তিনি অবলীলাক্রমে বলেন, বাহাত্তরের সংবিধান যাঁরা রচনা করেছিলেন তাঁদের নাকি সংবিধান রচনা করার যোগ্যতা ছিল না। মিন্টু সাহেবের জ্ঞাতার্থে বলি, বাহাত্তরে সংবিধান যাঁরা রচনা করেছিলেন, তাঁদের মতো বিচক্ষণ, শিক্ষিত ও অভিজ্ঞ ব্যক্তি তখনো ছিল না, এখনো নেই। এমন মন্তব্য করে মিন্টু দেশের মানুষের কাছে নিজের মূর্খতাই শুধু জাহির করেছেন। একই কথা দলের আরেক সভায় গত শুক্রবার দলের নেতা মির্জা আব্বাস পুনরুক্তি করেছেন। উভয়েই এক নিঃশ্বাসে বলেছেন, ক্ষমতায় এলে এই সংবিধানকে ছুড়ে ফেলে তাঁরা নতুন সংবিধান রচনা করবেন। বলতে বাকি রেখেছেন সেই সংবিধানে জিয়াকে করা হবে জাতির পিতা আর জিয়া পরিবারের বাইরে কেউই দেশের রাষ্ট্রপতি বা প্রধানমন্ত্রী হতে পারবেন না তেমন ব্যবস্থা করা হবে। এর আগে দলের মহাসচিব মির্জা ফখরুল ঘোষণা করেছেন, বাংলাদেশের চেয়ে পাকিস্তান আমল ভালো ছিল। তাঁদের এসব এজেন্ডা বাস্তবায়ন করার জন্য তাঁদের সঙ্গে যোগ দিয়েছে এ দেশেরই কিছু মিডিয়া, কিছু সুধীজন আর একটি আন্তর্জাতিক গোষ্ঠী, যার সঙ্গে ইসরায়েলের সম্পৃক্ততা এখন ওপেন সিক্রেট। ইসরায়েলের এজেন্ট মেন্দি সাফাদির সঙ্গে দুবাই, লন্ডন, সিঙ্গাপুরে দলের নেতাদের নিয়মিত বৈঠকের সংবাদ মিডিয়ায় ভাইরাল হয়েছে। কোটি ডলার ব্যয় করে দলের পক্ষ থেকে বিদেশে লবিস্ট নিয়োগ করা হয়েছে।
ক্ষমতাচ্যুত বিএনপি ক্ষমতায় যেতে চাইবে তাতে দোষের কিছু নেই। তা তো হতে হবে নিয়মতান্ত্রিক ও সাংবিধানিকভাবে। তার আগে তাদের দেশের প্রতি, দেশের সংবিধান ও মুক্তিযুদ্ধের আদর্শের প্রতি অনুগত ও অঙ্গীকারবদ্ধ হতে হবে। নয়তো তাদের দীর্ঘদিন ক্ষমতার বাইরে থাকতে হবে। করতে হবে বিরামহীন পদযাত্রা।