Thursday , 21 November 2024
E- mail: news@dainiksakalbela.com/ sakalbela1997@gmail.com
ব্রেকিং নিউজ
ভোগ যখন ভোগায়
--ফাইল ছবি

ভোগ যখন ভোগায়

অনলাইন ডেস্ক:
গল্পে আছে, এক লোকের হাতের মধ্যমায় ছিল সোনার আংটি। তার খুব শখ মানুষ জানুক যে সে সোনার আংটি পরেছে। একবার বাজারে গিয়ে পছন্দের জিনিস দোকানদারকে দেখাতে গিয়ে সে বারবার মধ্যমা দিয়ে নির্দেশ দিচ্ছিল, আরে, এইটা না ওইটা, ওইটার দাম কত ভাই? তার উদ্দেশ্য যে সোনার আংটি দেখানো, তা টের পেয়ে দোকানদার মুখ খিঁচিয়ে সোনার দাঁত দেখিয়ে বলল, ওইটার দাম ছে টাকা।নিজের অর্থনৈতিক তাকত, বেশভূষা, পাণ্ডিত্য, পছন্দ প্রভৃতি প্রদর্শন করে নিজেকে আলাদা ভাবার মানসিকতা মানুষের চিরায়ত অভ্যাস।

যাক সে কথা। আমরা যে প্রতিনিয়ত দ্রব্য এবং সেবা গ্রহণ করে থাকি, অর্থনীতির ভাষায় যাকে বলে ভোগ করে থাকি, তা নিতান্তই উপযোগিতা বা তৃপ্তি পাওয়ার জন্য। যে জিনিসের তৃপ্তি বা আনন্দ নেই, বাজারে তার চাহিদা বা দামও নেই। এই ভোগ নিত্যপ্রয়োজনীয় কিংবা একটু-আধটু আমোদ-আহ্লাদের জন্য হতে পারে। আমাদের ভোগ আমাদের আয় বা বাজেট দ্বারা সীমিত। সুতরাং ভোগের আকাশে তুমি যে গো শুকতারা বলার ভাগ্য খুব কম লোকের, বিশেষত বাংলাদেশে।মার্কিন অর্থনীতিবিদ ও সমাজবিজ্ঞানী থরস্টন ভেবলেন ২০০ বছর আগে দৃষ্টি আকর্ষক বা দর্শনীয় ভোগের কথা বলেছেন (Conspicuous consumption)| এই ধরনের ভোগের নাম দেওয়া যায় ফুটানি। সরাসরি উপযোগিতা বা তৃপ্তি নেই, তবে এ ধরনের ভোগ পরোক্ষভাবে ‘আমি আলাদা’ জাতীয় হামবড়া মার্কা তৃপ্তির ঢেকুর তুলতে সাহায্য করে। আর সেই সূত্রে সমাজের উঁচু আয়ের এক অংশ ক্ষমতার দাপট কিংবা সামাজিক অবস্থান তুলে ধরার জন্য বিলাসবহুল গাড়ি, বাড়ি, মদ, জুয়া, জুয়েলারি, এমনকি নারী ভোগ করে থাকে।
তবে স্বীকার্য যে অতি উঁচু মাত্রায় ভোগবিলাস তথা দৃষ্টি আকর্ষণীয়/দর্শনীয় ভোগ সমাজে প্রকট আয়বৈষম্যের নির্দেশক। এটা মোটেও গ্রহণযোগ্য নয়। এ ধরনের ভোগে সরাসরি উপযোগিতা থাকলে কথা ছিল না। কিন্তু দুর্ভাগ্যবশত দর্শনীয় ভোগ বা ফুটানি তা দেয় না। তৃপ্তি এটুকুই যে অন্যরা দেখছে আমার বিলাসবহুল বাড়ি-গাড়ি, গলায় সোনার চেইন কিংবা হাতের আঙুলে হীরার আংটি এবং হয়তো বঞ্চিত হয়ে হায় আফসোস করছে। অন্যের আফসোসে আমার খুব তৃপ্তি লাগে! অধিক গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হলো, প্রায়ই এর পেছনে কাজ করে কালো অর্থনীতি থেকে প্রাপ্ত আয় যথা খাজনা (নিখাদ দালালি), ভূমি, নদী, জলাশয় জবরদখল, দুর্নীতিসমেত নিয়মবহির্ভূত কর্মকাণ্ড—এককথায় যা আঙুল ফুলে কলাগাছ হতে সাহায্য করে। এই ধরনের ভোক্তারা ট্যাক্স ফাঁকি দেয়, প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে খুনাখুনিতে জড়ায়, অর্থ ও মানবপাচারে লিপ্ত থাকে, পর্নোশিল্প খুলে বসে, টাকা উড়িয়ে রাজনীতি তথা ক্ষমতায় আসীন হতে হাঁকডাক করে। বলার অপেক্ষা রাখে না যে এসব কর্মকাণ্ডে সমাজ ও সরকারের সায় নেই বিধায় তা বেআইনি উপার্জন বা কালো টাকা হিসেবে বিবেচিত।এর সবচেয়ে ক্ষতিকারক দিক হচ্ছে, জেমস ডুসেনবেরির মতে, এই ধরনের ভোগ সমাজে ‘প্রদর্শন-প্রভাব’(Demonstration Effect)  সৃষ্টি করে, যেখানে একজনের ব্যয় তার প্রতিবেশীর ব্যয় দ্বারা প্রভাবিত হয়। কার্ল মার্ক্স একজন গরিব মানুষের কথা লিখেছেন, যে একদা এক ছোট কুটিরে বাস করত এবং বলা যেতে পারে সে বেশ সুখী ছিল। কিন্তু যখনই তার প্রতিবেশী প্রাসাদ নির্মাণ করল, লোকটির সুখের নদীতে ভাটা পড়ল, কারণ কুটিরটি (এবং তার মালিক) তখন বঞ্চনা অনুভব শুরু করে দিল। এর নাম আপেক্ষিক বঞ্চনা। সামাজিক মর্যাদা রক্ষায় মানুষ যখন ভোগ করে তখন আপেক্ষিক বঞ্চনার সৃষ্টি করে, যা প্রকারান্তরে দারিদ্র্য। সুতরাং এটা কোনো অস্বাভাবিক নয় যে একটা দরিদ্র খানার সন্তান বাবার কাছে কোনো এক নির্দিষ্ট নায়িকার পরনে দেখা জামা কিনে দেওয়ার আবদার নিয়ে হাজির হয়, একটা রঙিন টিভি বা স্মার্টফোন দাবি করে এবং বিফলে আত্মহত্যার হুমকি দেয়। সমাজের ভোগান্তি ওখানটায়, আজ কিংবা কাল।

নিঃসন্দেহে প্রয়োজনীয় ভোগের মতো দর্শনীয় ভোগ অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির চাকায় জ্বালানি জোগায়। এগুলোর উৎপাদন কারখানায় লাখ লাখ শ্রমিক কাজ করে, বেতন পায় এবং বাজারে কার্যকর চাহিদা সৃষ্টি করে। পৃথিবীতে নাকি বিলাসজাতীয় পণ্যের বাজার সাত ট্রিলিয়ন ডলার।

দুই.

ইদানীং আমাদের আইন-শৃঙ্খলা রক্ষা বাহিনীর বেশ কয়েকটা ধরপাকড়ে কেঁচো খুঁড়তে সাপ বেরিয়ে এসেছে। অভিযুক্তের খোঁজে তাদের বাসায় গেলে যে ধরনের দর্শনীয় ভোগের সন্ধান মিলল তা দেখে রীতিমতো আক্কেলগুড়ুম; চোখ যেন চড়কগাছ। বিলাসবহুল বাড়ি, গাড়ি, ভ্রমণ, লাইফস্টাইল, ক্ষমতার দাপট, মদ, ইয়াবা—এ সবই তাদের হাতের মোয়া যেন। বলা চলে, সমাজের অন্যদের তুলনায় নিজেকে বড় করে তোলার জন্য নিবেদিত মানসিকতার নগ্ন রূপের বহিঃপ্রকাশ। অবশ্য মনে রাখতে হবে যে এ ধরনের হাতে গোনা কয়েকটা ঘটনা বরফের উপরিখণ্ড বা টিপ অব আইসবার্গ। বাংলাদেশে এই গোষ্ঠীর সংখ্যা কয়েক লাখ হতেও পারে। ব্যতিক্রম তো আছেই—পৃথিবীর সবচেয়ে ধনীদের মধ্যে অনেকে আছেন যাঁরা এমনতর ভোগের ধারে-কাছে নেই, যেমন—বিল গেটস, ওয়ারেন বাফেট প্রমুখ। বাংলাদেশেও এমন লোক আছেন, তবে খুব সীমিতসংখ্যক বলেই ধারণা।

পশ্চিমাজগতে ফুটানিজাতীয় ভোগ হৈচৈ ফেলে না। কারণ কিছু ব্যতিক্রম বাদে ভোগকারী প্রচলিত আইনের প্রতি শ্রদ্ধা রেখেই ফুটানি মেরে থাকে। যদি অন্যথা হয়, আইন সবার জন্য সমান। তা ছাড়া ওসব দেশে ধনী হওয়া খুব কঠিন কাজ—কয়েক যুগ লেগে যেতে পারে। প্রতি পদে নিয়মের বেড়াজাল, আইনের রক্তচক্ষু, পূর্ণ প্রতিযোগিতা ইত্যাদি কাটিয়ে সেখানে স্বাভাবিক মুনাফা ঘরে আসে। এর বিপরীতে বাংলাদেশে ধনী হওয়া যায় কয়েক বছরেই, এমনকি কয়েক মাসে। পদে পদে অর্থের বিনিময়ে নিয়মের প্রাচীর ভেঙে ফেলা সহজ। এক টাকার জিনিস এক হাজার টাকায় সরবরাহ করা, কাজ শেষ না করেই পাওনা আদায়, ভূতুড়ে প্রকল্প বানিয়ে অর্থ লোপাট, মানুষকে বোকা বানিয়ে অর্থ আত্মসাৎ, ব্যাংকঋণ নিয়ে সটকে পড়া এবং সর্বোপরি রাজনৈতিক পৃষ্ঠপোষকতা ক্রয় বাবদ বাংলাদেশে এখন কালো অর্থনীতির জয়জয়কার চলছে বলে বিজ্ঞজনের মত।তিন.মোটকথা ফুটানি-ভোগ নিয়ে আপত্তি নেই, যদি দেশে যথাযথ আইনের শাসন থাকে। নিন্দুকেরা বলে, দেশে আইন আছে, শাসনও আছে; কিন্তু নেই শুধু আইনের শাসন। তা নেই বলেই নাকি ফুটানি নিয়ে এত হৈচৈ। চ্যানেলগুলোর ক্যামেরা এমন তাক করে থাকে যেন মঙ্গল গ্রহ থেকে কেউ ধরাতলে এসে ধরা পড়েছে। ফুটানি ছেড়ে ফুটতে পারলে বাঁচোয়া।

একমাত্র আইনের শাসন তথা সুশাসনই পারে এই ‘বিকৃত ভোগ’ বন্ধ করতে। তা না হলে অর্থনীতির প্রবৃদ্ধির গল্পটা যে গোলমেলে থেকে যাচ্ছে। আরেকটা কথা, পাপীকে নয়, বরং পাপকে ঘৃণা করে সামনের দিকে এগোনোই ভালো।

গিন্নি : তাহলে এই কথাই রইল, তুমি আমার বাসায় কাজ করে খাবারদাবারসমেত প্রতি মাসে ৭০০ টাকা পাবে।কাজের মেয়ে : তার আগে কন, আফনের বাড়িতে কি ওয়াই-ফাই আছে?লেখক : সাবেক উপাচার্য, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়

About Syed Enamul Huq

Leave a Reply