এবারের জেলা প্রশাসক (ডিসি) সম্মেলনে ২৪৫টি প্রস্তাব এসেছিল। এর মধ্যে তিনটি মন্ত্রণালয় ও বিভাগসংশ্লিষ্ট। প্রস্তাবগুলো বিশ্লেষণ করে দেখা যায়, মোট ২৭ প্রস্তাবের সব কটিই ডিসি ও ইউএনওদের ক্ষমতা বা দায়িত্বের পরিধি বাড়ানো ও সুযোগ-সুবিধা বৃদ্ধিসংক্রান্ত। নাগরিকদের সেবা সহজলভ্য করা, সরকারঘোষিত ডিজিটাল বাংলাদেশ থেকে স্মার্ট বাংলাদেশে উত্তরণ উপযোগী প্রশাসন গঠন কিংবা দুর্নীতি বন্ধে কার্যকর ব্যবস্থা নেওয়ার মতো সুনির্দিষ্ট প্রস্তাব ছিল না বললেই চলে।
তিন দিনব্যাপী ডিসি সম্মেলন গত বৃহস্পতিবার শেষ হয়েছে। এবারের প্রস্তাবগুলোর মধ্যে উল্লেখযোগ্য ছিল জেলা পর্যায়ে রাজস্ব আদায়, উন্নয়ন প্রকল্পে আর্থিক ক্ষমতা বৃদ্ধি, জেলা ও উপজেলা স্বাস্থ্য কমিটি করা এবং এ ধরনের কমিটিতে ডিসি বা ইউএনওদের প্রধান হওয়া। ছিল শিক্ষা এবং প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয় থেকে জারি করা সব চিঠি ডিসি-ইউএনওদের বরাবর পাঠানো, ইউএনওদের আবাসিক ভবনে সন্ধ্যাকালীন অফিস পরিচালনার জন্য নতুন কর্মচারী নিয়োগ করাসহ ক্ষমতা বৃদ্ধির প্রস্তাব। এর মধ্যে রাজস্ব আদায় ও উন্নয়ন প্রকল্পের দায়িত্ব তাঁরা আগের সম্মেলনেও চেয়েছিলেন।
২০১১ সালে ডিসিদের জন্য ৬২টি দায়িত্ব নির্দিষ্ট করে দেওয়া হয়। সরকারের রুলস অব বিজনেস অনুযায়ী প্রতিটি ক্যাডার ও বিভাগের জন্য পৃথক দায়িত্ব রয়েছে। সংশ্লিষ্ট কাজের ক্ষমতাসংক্রান্ত একাধিক আইন ও বিধি রয়েছে। এর পরও ডিসিরা বিভিন্ন সময়ে অন্য ক্যাডার ও বিভাগের দায়িত্ব চেয়েছেন। এর ফলে অন্য ক্যাডারের কর্মকর্তারা একাধিকবার প্রতিবাদ জানিয়েছেন।
করোনার কারণে ২০২০ ও ২০২১ সালে ডিসি সম্মেলন হয়নি। ২০২২ সালের ডিসি সম্মেলনে উন্নয়ন প্রকল্প তদারকির ক্ষমতা চাওয়া হয়। গত সম্মেলনের এই প্রস্তাবে ক্ষুব্ধ হয়েছিলেন প্রকৌশলীরা।
এবারের সম্মেলনে ফের জেলা পর্যায়ে রাজস্ব আদায় সম্পর্কিত সমন্বয় কমিটি গঠনের প্রস্তাব আসে। প্রস্তাব তুলে ধরেন গোপালগঞ্জের ডিসি। এতে জেলা ও উপজেলা পর্যায়ে রাজস্ব আদায়ের নতুন নতুন উৎস চিহ্নিত করা সম্ভব হবে বলে তিনি মত দেন।
পটুয়াখালীর ডিসি সরকারি রাজস্ব প্রশাসনের উন্নয়ন প্রকল্প বাস্তবায়নের ক্ষেত্রে ডিসিদের আর্থিক ক্ষমতা প্রদানের প্রস্তাব দেন। বর্তমানে ভূমি মন্ত্রণালয় তাদের বরাদ্দ করা অর্থ সরাসরি গণপূর্ত ও এলজিইডি বিভাগের প্রকৌশলীদের অনুকূলে বরাদ্দ দেয়। প্রকৌশলীরা প্রকল্পের তদারকিসহ সব কাজ করেন।
পিরোজপুর ও ঝালকাঠির ডিসি সরকারি অর্থের উপযুক্ত ব্যবহার নিশ্চিত করতে উন্নয়ন প্রকল্পে ডিসিদের আর্থিক ক্ষমতা দেওয়ার প্রস্তাব করেন। তাঁদের যুক্তি, প্রকৌশলীদের মাধ্যমে প্রকল্পের প্রাক্কলন, ডিজাইন, মনিটরিং এবং গুণগত মান বজায় রেখে প্রকল্প বাস্তবায়নে সমস্যা হয়। এসব কাজের আর্থিক ক্ষমতা ডিসিদের দেওয়া হলে কঠোর মনিটরিংয়ের মাধ্যমে যথাযথভাবে কাজ সমাপ্ত করা সম্ভব হবে।
তিন মন্ত্রণালয় ও বিভাগ নিয়ে প্রস্তাব
ভূমি মন্ত্রণালয়ের ১৫টি প্রস্তাবের মধ্যে চারটি ডিসিদের আর্থিক ক্ষমতা বৃদ্ধিসংক্রান্ত। সাতটি প্রস্তাব আইন সংশোধনের মাধ্যমে তাঁদের কর্তৃত্ব বৃদ্ধি করা। আর বাকি চারটি প্রস্তাব জনবল বৃদ্ধির বিষয়ে।
জনপ্রশাসন বিশেষজ্ঞ ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের লোকপ্রশাসন বিভাগের অধ্যাপক মুসলেহ উদ্দীন আহমেদ বলেন, ডিসিদের বেশির ভাগ প্রস্তাব ক্ষমতা বৃদ্ধির বিষয়ে; নাগরিকদের সেবা সহজলভ্য করার কোনো প্রস্তাব নেই। অবশ্য এর বেশির ভাগ প্রস্তাব বাস্তবায়ন করা হয় না।
মুসলেহ উদ্দীন আহমেদ বলেন, ‘এখন ডিজিটাল ব্যবস্থা ও প্রশাসনিক উদ্যোগের কারণে বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্ররা বেতন, ভর্তি, ফরম পূরণসহ সব ধরনের সেবা যত সহজে পাচ্ছে নাগরিকরা কিন্তু তাদের সেবাগুলো তত সহজে পায় না। বিদেশি নাগরিকরাও এখন বিডা থেকে সব সেবা একসঙ্গে পাচ্ছে। ইউরোপ-আমেরিকায়ও এক স্থান থেকে সব সেবা দেওয়া হচ্ছে। আমাদের দেশেও জেলা প্রশাসনের অফিস থেকে সব সেবা দেওয়া যায়। ডিজিটাল থেকে স্মার্ট বাংলাদেশ হওয়ার জন্য ডিসি সম্মেলনে পরিকল্পিত প্রস্তাব আসা উচিত ছিল।’
ঢাকা, রংপুর, দিনাজপুর, খুলনা ও বরিশাল জেলার ১৫টি উপজেলায় খোঁজ নিয়ে জানা যায়, ইউনিয়ন ভূমি অফিস, এসি ল্যান্ড (সহকারী ভূমি কমিশনার), সাবরেজিস্ট্রার কার্যালয়ে নাগরিকরা প্রায় প্রতিনিয়তই হয়রানির শিকার হচ্ছে। সাধারণ মানুষ থানায় জিডি থেকে শুরু করে প্রায় সব ধরনের সেবা নিতে ভোগান্তির শিকার হচ্ছে। এসব হয়রানি বন্ধে ডিসিদের সুনির্দিষ্ট কোনো প্রস্তাব ছিল না।
প্রস্তাবের ভিত্তিতে ক্ষমতার পরিধিও বাড়ে
বিভিন্ন সম্মেলনে তোলা প্রস্তাবের পরিপ্রেক্ষিতে জেলা ও উপজেলার বেশির ভাগ সরকারি অফিস নিয়ন্ত্রণের ক্ষমতা আগেই পেয়েছেন ডিসি ও ইউএনওরা। উপজেলার ত্রাণ, স্থানীয় সরকারসহ ১৭টি বিভাগের সভাপতি ইউএনওরা। আইনে না থাকলেও পরিপত্রের মাধ্যমে তাঁদের এ দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে। আরো কিছু প্রস্তাব বাস্তবায়নের অপেক্ষায় আছে।
সাবেক মন্ত্রিপরিষদসচিব আলী ইমাম মজুমদার বলেন, ডিসিরা কাজ করার ক্ষেত্রে যেসব বিষয়কে প্রতিবন্ধকতা মনে করেছেন, সেগুলোর বিষয়ে প্রস্তাব দিয়েছেন। তবে নাগরিকদের জন্য যেসব সেবা প্রয়োজন, সেই বিষয়গুলো আলোচনায় আনতে নীতি নির্ধারণের সঙ্গে যাঁরা জড়িত, তাঁদেরও ভূমিকা প্রয়োজন। গণমাধ্যমকেও এ বিষয়ে ভূমিকা রাখতে হবে। বিষয়গুলো আলোচনার মাধ্যমে সমাধান হবে এবং নাগরিকদের সেবা আরো সহজ করা যাবে।
সূত্র: কালের কন্ঠ অনলাইন