অনলাইন ডেস্ক:
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর থেকে ইউরোপে সবচেয়ে বড় সমরকাণ্ড ইউক্রেন যুদ্ধ ১১ মাসে পড়ল। অথচ অনেকেই মনে করেছিলেন, দিন কয়েকের মধ্যেই অনেক গুণ শক্তিশালী রাশিয়ার হামলার মুখে গুটিয়ে যাবে ইউক্রেনের প্রতিরোধ। সর্বাত্মক যুদ্ধের আশঙ্কায় যুক্তরাষ্ট্র তথা ন্যাটো শেষ পর্যন্ত সেভাবে এগোবে না। কিন্তু অনেকটা ‘ধরি মাছ না ছুঁই পানি’ করেও পশ্চিমারা এখনো ভালোভাবেই ইউক্রেনের পাশে আছে।
আবার পশ্চিমাদের কঠিন অর্থনৈতিক ও অন্যান্য নিষেধাজ্ঞা সেভাবে দাঁত বসাতে না পারায় রাশিয়ার দিকেও ক্ষান্ত দেওয়ার লক্ষণ নেই। সব মিলিয়ে ‘ইস্টার্ন ফ্রন্ট কোয়ায়েট’ হওয়া দৃশ্যত দূর অস্ত!
আক্ষরিক অর্থেই গোটা বিশ্বকে নাড়া দিয়েছে ইউক্রেন যুদ্ধ। যুদ্ধের কারণে বিশ্বের অন্যতম প্রধান খাদ্যশস্যের ভাণ্ডার ইউক্রেনের গম রপ্তানি দীর্ঘদিন সম্পূর্ণ বন্ধ ছিল। রাশিয়া নিষেধাজ্ঞার জবাবে পশ্চিম ইউরোপমুখী গ্যাস পাইপলাইনের ছিপি এঁটে দেওয়ায় বিকল্পের জন্য হাহাকার ওঠে। খাদ্য আর জ্বালানি উভয়ের দাম হয় আকাশচুম্বী। বিশ্বের সর্বত্র তা ডেকে আনে অভূতপূর্ব মূল্যস্ফীতি। এ ক্ষেত্রে একটা উদাহরণই হয়তো যথেষ্ট। বিশ্বের অন্যতম শীর্ষ অর্থনীতি যুক্তরাজ্যে দেখা দিয়েছে চার দশকের মধ্যে সর্বোচ্চ মুদ্রাস্ফীতি। বলা হচ্ছে, দেশটির রাজনৈতিক অস্থিরতা ও অর্থনৈতিক পরিকল্পনার কথিত ত্রুটিও এ জন্য দায়ী। বছরের মাঝামাঝি এক জরিপে দেখা গিয়েছিল, একটা বড় অংশের সাধারণ ব্রিটিশ নাগরিক দিনের খাবার গ্রহণের পরিমাণ পর্যন্ত কমিয়ে দিয়েছে।
ইউক্রেন যুদ্ধকে কেন্দ্র করে ওই অঞ্চলে যে সমরসজ্জা হয়েছে তাকে অনেকে বলেছেন, দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর থেকে ইউরোপে সবচেয়ে বড় সামরিক তৎপরতা। দুই পক্ষের যুদ্ধংদেহি কথাবার্তায় তৃতীয় বিশ্বযুদ্ধের আশঙ্কা পর্যন্ত জেগেছে জনমনে। এক পর্যায়ে রাশিয়া তার কৌশলগত পরমাণু বাহিনী সক্রিয় করার ঘোষণা দেয়। পশ্চিমারাও নেয় পাল্টা ব্যবস্থা। উত্তেজনা তাতে তুঙ্গে ওঠে। বলা হয়, গত শতকের ষাটের দশকের ‘কিউবান মিসাইল ক্রাইসিসের’ পর থেকে বিশ্ব পরমাণু যুদ্ধের সবচেয়ে কাছে এসে গিয়েছিল এবার। পশ্চিমা বিশ্লেষকরা অবশ্য পরমাণু অস্ত্র ব্যবহার নিয়ে রুশ হুমকির বিষয়টিকে মূলত বাগাড়ম্বর বলেই উড়িয়ে দিয়েছে।
এই মুহূর্তে পরস্পরের ‘জানের শত্রু’ হলেও ইউক্রেনের সঙ্গে রাশিয়ার রয়েছে গভীর ঐতিহাসিক এবং সামাজিক-সাংস্কৃতিক সম্পর্ক। রাশিয়া যার উত্তরসূরি সেই সোভিয়েত ইউনিয়নেরই অংশ ছিল ইউক্রেন। এখন এটি ইউরোপের দ্বিতীয় বৃহত্তম দেশ। ইউক্রেনে রুশভাষীর সংখ্যা অনেক। সোভিয়েত ইউনিয়নের শস্যভাণ্ডার হিসেবে বিশ্বজুড়ে ইউক্রেনের পরিচিতি তখন থেকেই।
সোভিয়েত ইউনিয়ন ভেঙে যাওয়ার পর ১৯৯১ সালে স্বাধীনতা ঘোষণা করে ইউক্রেন। তখন থেকে দেশটি তার সীমান্তের পশ্চিমে ইউরোপের সঙ্গে ঘনিষ্ঠতা আর পূর্বের রাশিয়ার প্রভাব বলয়ে থাকা—এ দুইয়ের মধ্যে ছিল দোদুল্যমান। ২০১৪ সালে ইউক্রেনে বিক্ষোভের মুখে রুশপন্থী প্রেসিডেন্ট ভিক্তর ইয়ানুকোভিচের পতনের পর রাশিয়ার সঙ্গে ইউক্রেনের টানাপড়েন ক্রমশ বাড়তে থাকে। ইউক্রেনের নতুন সরকার পাশ্চাত্যের সঙ্গে ঘনিষ্ঠ হতে সচেষ্ট হয়। বিশেষ করে যুক্তরাষ্ট্রের নেতৃত্বাধীন সামরিক জোট ন্যাটোতে যোগ দেওয়ার আগ্রহ প্রকাশ করে। ন্যাটোও পূর্বমুখী সম্প্রসারণ আরো বাড়াতে উন্মুখ। কিন্তু নিজের ঘাড়ের কাছে পশ্চিমাদের নিঃশ্বাস ফেলার উপক্রম হওয়াটা মেনে নিতে পারেননি রাশিয়ার একালের ‘জার’ প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিন। বিষয়টাকে তাঁর মনে হয়েছিল রাশিয়ার ঐতিহ্যগত প্রভাব বলয়ে পশ্চিমাদের বিপজ্জনক অনুপ্রবেশ। তাঁর এ মনোভাব অবশ্য ইউক্রেন ও পশ্চিমাদের পরস্পরের দিকে ঝুঁকে পড়া ঠেকাতে পারেনি। এমন প্রেক্ষাপটেই ২০২২ সালের গোড়ার দিকে মহড়ার কথা বলে ইউক্রেন সীমান্তে ব্যাপক অস্ত্র ও সেনা সমাবেশ করতে থাকে রাশিয়া। ইউক্রেনে সেনা পাঠানো তাদের লক্ষ্য নয়—এ কথা বারবার বলার পরও ২৪ ফেব্রুয়ারি ‘বিশেষ সামরিক অভিযান’ নাম দিয়ে ঠিক সেটাই করেন পুতিন। এর আগে কয়েক দিনের মধ্যে দুই দফা জ্বালাময়ী ভাষণ দেন। এতে ছিল ন্যাটো জোট বড় করার মাধ্যমে পূর্ব ইউরোপে পশ্চিমাদের ক্রমবর্ধমান ‘নাকগলানো’ আর রাশিয়ার প্রতি বৈরিতার সবিস্তার বিবরণ। পূর্ব ইউক্রেনে রুশভাষীদের ওপর ইউক্রেনের দমন-পীড়ন থামানোই রাশিয়ার উদ্দেশ্য ছিল বলে দাবি করেছেন পুতিন। অন্যদিকে পশ্চিমাদের দাবি, ইউক্রেনকে সমর্থন করার মাধ্যমে তারা শামিল হয়েছে মানবাধিকার ও গণতন্ত্র রক্ষার লড়াইয়ে।
রাশিয়ার হামলা শুরু হয়ে যাওয়ার পর অবশ্য সবাইকে চমকে দিয়ে ইউক্রেন শক্ত প্রতিরোধ গড়ে তোলে। ক্রমে পশ্চিমা মিত্ররা অস্ত্র ও অর্থ সাহায্য নিয়ে এগিয়ে আসে। যুক্তরাষ্ট্র ও তার ন্যাটো মিত্ররা এখন পর্যন্ত ইউক্রেনের হাত শক্তিশালী করে চলেছে। এক পর্যায়ে গত সেপ্টেম্বরে রাশিয়া কথিত গণভোট দিয়ে ইউক্রেনের চারটি অঞ্চল নিজের সঙ্গে যুক্ত করে নেওয়ার ঘোষণাও দেয়। যুদ্ধের কয়েক মাসের মাথায় হারানো কিছু ভূখণ্ড ফিরে পেয়েছে ইউক্রেন। ইউক্রেনের পূর্ব ও দক্ষিণাঞ্চলে এখনো চলছে জোর লড়াই।
সামরিক দিক থেকে রাশিয়া ইউক্রেনের তুলনায় বহুগুণ বেশি শক্তিশালী (হিসাব থাকা ১৪০ দেশের মধ্যে রাশিয়া দ্বিতীয় ইউক্রেন ২২তম)। ইউক্রেনে তারা ব্যাপক ধ্বংস ও প্রাণহানি ঘটাতে পেরেছে। কিন্তু দেশটিকে পর্যুদস্ত করতে পারেনি। তার পেছনে রাশিয়ার সেনাদের অনীহা ও নৈতিক দুর্বলতা থেকে শুরু করে প্রচলিত সমরাস্ত্রের সীমাবদ্ধতা ও কৌশলগত ত্রুটির কথা আলোচনায় এসেছে।
১১ মাসে পড়লেও দুনিয়াজুড়ে সংকট সৃষ্টি করা ইউক্রেন যুদ্ধের শেষ নজরে পড়ছে না। সত্যি বলতে ঝানু সমরবিদ বা রাজনৈতিক ভাষ্যকাররাও কেউই সুনির্দিষ্ট করে এ যুদ্ধাবসানের সম্ভাব্য সময় নিয়ে জোরের সঙ্গে কিছু বলেননি। তুরস্কের মধ্যস্থতায় প্রকাশ্যে ও গোপনে শান্তি আলোচনার কিছু উদ্যোগ থাকলেও তার দৃশ্যমান ফল খাদ্যশস্যবাহী জাহাজের নিরাপদ যাত্রা নিশ্চিত করাতেই সীমাবদ্ধ রয়েছে। রুশ সেনা প্রত্যাহারের বিনিময়ে দেওয়া ইউক্রেনীয় প্রেসিডেন্ট জেলেনস্কির প্রস্তাব ক্রেমলিন ডিসেম্বরের মাঝামাঝি নাকচ করে দিয়েছে। বছর শেষেও রুশ পররাষ্ট্রমন্ত্রী বল কিয়েভের কোর্টে ছুড়ে দিয়ে বলেছেন, ইউক্রেনকে ‘বেসামরিকীকরণ ও নাসিবাদ ত্যাগের পথে’ যেতেই হবে। না হলে বিষয়টা রাশিয়ার সেনাবাহিনীই বুঝবে। ইউক্রেনেরও আশঙ্কা, রাশিয়া নতুন বছরের শুরুর দিকে নতুন উদ্দীপনায় জোরেশোরে হামলার পরিকল্পনা করছে।
ইউক্রেন যুদ্ধ চলাকালে ইতিহাসের চর্চা হয়েছে বিস্তর। চায়ের কাপে ঝড় উঠেছে নানাবিধ তুলনায়। আলোচনায় এসেছে ইউক্রেনের মাটিতে ঠিক ১০০ বছর আগে ১৯২১ সালে লালফৌজের প্রবেশের ঘটনা, পূর্ব-পশ্চিমের দশকের পর দশক ধরে চলা স্নায়ুযুদ্ধের কথা। ঝুঁকি নিয়ে আটলান্টিক পাড়ি দিয়ে ইউক্রেনের প্রেসিডেন্ট জেলেনস্কির মার্কিন কংগ্রেসে ভাষণ দেওয়ার সঙ্গে তুলনা হয়েছে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী চার্চিলের সেখানে দেওয়া ভাষণের। নিয়ন্তা ইতিহাসকেই যদি আলোচনার কেন্দ্রে রাখতে হয় তাহলে মানতে হবে, রাশিয়া ও পশ্চিমাদের লাভ-লোকসানের হিসাব, সমরসম্ভার ও কৌশল আর সহ্যক্ষমতার ওপর নির্ভর করছে ইউক্রেন যুদ্ধের আয়ু। সব কিছুর ওপর ছড়ি ঘোরানো অভ্যন্তরীণ ও বৈশ্বিক রাজনীতির বিষয়টি তো আছেই।
সূত্র: কালের কন্ঠ অনলাইন