মা-বাবার সঙ্গে শিশু পাপিয়া (৬) থাকত রাজধানীর মিরপুরে। জ্বর হওয়ার তিন দিন পর তাকে শিশু হাসপাতালে ভর্তি করা হয়। ততক্ষণে পাপিয়া শকে (মুমূর্ষু অবস্থা) চলে গেছে। আরো দুটি দিন হাসপাতালের নিবিড় পরিচর্যা কেন্দ্রে (আইসিইউ) থেকে মারা যায় সে।
চলতি বছরে পাপিয়ার মতো এভাবে আরো ১১টি শিশুর মৃত্যু হয়েছে রাজধানীর এই হাসপাতালে।
হাসপাতালের চিকিৎসক ডা. এ বি এম মাহফুজ হাসান আল মামুন বলেন, শিশুদের মারা যাওয়ার প্রথম কারণ ডেঙ্গুর শক সিনড্রোম। ডেঙ্গুর হেমোরেজিক ফিভারের সঙ্গে সারকুলেটরি ফেইলিওর হলে তাকে শক সিনড্রোম বলে। জ্বর হলে মানুষ প্রথমে মনে করে তা মৌসুমি। দু-তিন দিন পর জ্বর সেরে যাওয়ার ২৪ থেকে ৪৮ ঘণ্টা পর রোগী শক সিনড্রোমে চলে যায়। বেশির ভাগ ক্ষেত্রে রোগীর প্লাটিলেট কমে গিয়ে রক্তক্ষরণ হয়। এরপর কিডনি, লিভার ও হার্ট বিকল হয়ে রোগী মারা যায়।
চিকিৎসকের ভাষায়, এই চারটি সমস্যাকে একসঙ্গে বলা হয় মাল্টিসিস্টেম ইনফ্লেমেটরি সিনড্রোম বা এমআইএসসি। এমআইএসসি আক্রান্ত শিশুর রক্তপ্রবাহ কমে যায়। এতে হার্ট, কিডনি, ফুসফুস ও যকৃতের মতো অঙ্গ ক্ষতিগ্রস্ত হয়ে রোগী মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়ে।
চিকিৎসকরা জানান, ডেঙ্গু রোগীদের পেট ও ফুসফুসে পানি আসছে। অনেকের প্রস্রাবের সঙ্গে রক্তক্ষরণ হচ্ছে, বমি হচ্ছে। বেশির ভাগ রোগী দেরি করে হাসপাতালে আসায় শকে চলে যাচ্ছে। ফলে তাদের আইসিইউ প্রয়োজন। কিন্তু আইসিইউ খালি না থাকায় অনেক রোগীকে বাঁচানো সম্ভব হচ্ছে না। চিকিৎসকরা বলছেন, ডেঙ্গু রোগীর সর্বশেষ চিকিৎসা হয় আইসিইউতে রেখে। সেখানেই বেশির ভাগ রোগীর মৃত্যু হচ্ছে। আইসিইউতে যাওয়ার পর রোগীর প্রয়োজন হয় রক্ত এবং আইভিআইজি ইনজেকশন। একজন রোগীর ওজন ও বয়স অনুযায়ী ১০ থেকে ২০ ভায়াল আইভিআইজি ইনজেকশন প্রয়োজন হচ্ছে। আইভিআইজি একেকটি ভায়ালের দাম ১৭ থেকে ২০ হাজার টাকা। কিন্তু বেশির ভাগ রোগীকে বাঁচানো যায়নি। এ ছাড়া আইসিইউসংকট তো রয়েছে।
চলতি বছরের শুরু থেকে ২৯ অক্টোবর পর্যন্ত মারা যাওয়া ১২০ জন ডেঙ্গু রোগীর তথ্য-উপাত্ত বিশ্লেষণ করে স্বাস্থ্য অধিদপ্তর বলছে, চলতি বছর মোট মৃত্যুর ৩৫ শতাংশ শিশু। এর মধ্যে এক থেকে চার বছর বয়সী শিশুর মৃত্যুর হার ৬ শতাংশ। পাঁচ থেকে ৯ বছরের শিশুর মৃত্যুহার ১০ শতাংশ। ১০ থেকে ১৮ বছর বয়সী ১৯ শতাংশ। সবচেয়ে বেশি মৃত্যু হয়েছে ১৯ থেকে ২৯ বছরের রোগীদের। এসব রোগীর মৃত্যুর হার ২৮ শতাংশ।
মারা যাওয়া ব্যক্তিদের ২০ জন ঢাকা উত্তর সিটির বাসিন্দা। ১৭ জন ঢাকা দক্ষিণ সিটির বাসিন্দা। বাকি ৮৩ জন ঢাকার বাইরে বিভিন্ন জেলার। এর মধ্যে সবচেয়ে বেশি ৩৮ জন কক্সবাজার জেলার।
স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের জরিপে পাওয়া তথ্য অনুযায়ী, হাসপাতালে ভর্তি রোগীদের তিন দিনের মধ্যে মারা গেছে ৮১ জন, তিন থেকে ছয় দিনের মধ্যে মারা গেছে ২১ জন। ছয় থেকে ৯ দিনে মধ্যে মৃত্যু ১৩ জনের। ৯ থেকে ৩০ দিনে মধ্যে মৃত্যু পাঁচজনের।
৩৬ হাজার ১৩১ জন ডেঙ্গু রোগীর ওপর করা জরিপের ফল বলছে, ডেঙ্গু রোগীদের মধ্যে ৬০ শতাংশ পুরুষ ও ৪০ শতাংশ নারী। ঢাকা উত্তরে আক্রান্তের রোগীর হার ৪৪.৩ শতাংশ। দক্ষিণে ৩৯.৫ শতাংশ। ঢাকার বাইরে ১৬.২ শতাংশ। ঢাকায় এ পর্যন্ত সবচেয়ে রোগী পাওয়া গেছে মিরপুরের। এরপর রয়েছে উত্তরা, যাত্রাবাড়ী, মুগদা, ধানমণ্ডি ও কেরানীগঞ্জ।
শিশু হাসপাতালের সহকারী অধ্যাপক ডা. মো. কামরুজ্জামান বলেন, ডেঙ্গু রোগীদের জটিল পরিস্থিতি তৈরি না হলে সাধারণত তারা হাসপাতালে আসছে না। এতে দেখা যায়, খুব অল্প সময়ে রোগী শকে চলে যাচ্ছে। রোগীদের পেটে ও ফুসফুসে পানি আসছে। অনেক সময় বমি হচ্ছে, কালো মল আসছে। এগুলো ডেঙ্গু রোগীর বিপদচিহ্ন। এসব লক্ষণ দেখা দিলে দ্রুত কাছের হাসপাতালে যেতে হবে।
তিনি বলেন, ‘ডেঙ্গু রোগীদের চিকিৎসা হলো ফ্লুইড ম্যানেজমেন্ট। স্যালাইনের মাধ্যমে ফ্লুইড সাপোর্ট দেওয়া। আমাদের মনে রাখতে হবে, জ্বর হলে কোনো অবহেলা নয়। পরীক্ষা করে জেনে নিন ডেঙ্গু পজিটিভ কি না। যত দ্রুত হাসপাতালে যাবেন, মৃত্যুঝুঁকিও কমে আসবে। একই সঙ্গে তরল খাবার খেতে হবে। ’
স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের রোগ নিয়ন্ত্রণ শাখার সাবেক পরিচালক বে-নজির আহমেদ বলেন, ২০ বছর ধরে যেহেতু ঢাকায় ডেঙ্গু হচ্ছে, কাজেই অনুমান করা যায় যে যাদের একটু বয়স হয়েছে, তারা একাধিকবার ডেঙ্গুর বিভন্ন ধরন দ্বারা আক্রান্ত হচ্ছে। এবার টাইপ-থ্রি দ্বারা মানুষ বেশি আক্রান্ত হচ্ছে। এতে দেখা গেছে, বাচ্চারা যেহেতু এই টাইপ দ্বারা আগে আক্রান্ত হয়নি, এবার তাদের মধ্যে এর লক্ষণ বেশি দেখা যাচ্ছে।
তিনি বলেন, ডেঙ্গুর কোনো কোনো ধরন আছে, যা দ্বারা প্রথমবার আক্রান্ত হলেই মারাত্মক আকার ধারণ করতে পারে। এবার সেটিই মনে হচ্ছে। যেহেতু এবার লক্ষণগুলো ভিন্ন, জ্বর সেরে যাওয়ার পরপরই জটিলতা শুরু হচ্ছে এবং শকে চলে যাচ্ছে এবং মৃত্যু বাড়ছে।
বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক উপাচার্য ও ভাইরোলজিস্ট অধ্যাপক ডা. নজরুল ইসলাম বলেন, সাধারণত শিশুরা এমন কাপড় পরে, তাদের শরীরের বেশ খানিকটা জায়গা অনাবৃত থাকে। এ ছাড়া কিছু শিশু এমন জায়গায় খেলাধুলা করে, যেখানে এডিস মশার প্রজনন রয়েছে। সেটি ঘরেও হতে পারে। এ জন্য ঘর পরিষ্কার রাখা জরুরি। এসিতে বা ফুলের টবে যেন পানি জমে না থাকে।