উখিয়া প্রতিনিধি:
সরকারী রাজস্বের টাকা যথানিয়মে ট্রেজারিতে জমা না করে ব্যক্তিগত ব্যবসায় বিনিয়োগ করে আসছে পিয়ন আবুল। উখিয়ারঘাট কাস্টম স্টেশনে দৈনিক একশ’ টাকা বেতনে চাকরিরত অবৈধ পিয়নের শত কোটি টাকার সম্পদ অর্জনের উৎস খুঁজে বের করার দাবি তুলেছেন স্থানীয় বিভিন্ন শ্রেণী-পেশার মানুষ।
সূত্র জানায়, কক্সবাজার কাস্টম এক্সাইজ ও ভ্যাট টেকনাফ স্টেশনের সুপার শওকত আলী বলেন, সরকারী গুদামে রক্ষিত পণ্য কৌশলে চুরি হয়ে যাচ্ছে জানতে পেরে প্রায় ৮মাস আগে উখিয়ারঘাট কাস্টম স্টেশনের ওই অবৈতনিক পিয়ন আবুলকে তাড়িয়ে দিতে নির্দেশ দেয়া হয়েছিল। ভারপ্রাপ্ত গুদাম কর্মকর্তা অজিত প্রসাদ রুদ্র ওই নির্দেশ উপেক্ষা করে চলেছেন। যার কারণে রক্ষিত পণ্য চুরির বাহনায় বিক্রি হয়ে গেছে বলে অভিযোগ রয়েছে।
অফিসের যে কোন কর্মচারী নিলাম কার্যক্রমে অংশগ্রহণ করতে পারে না। তারপরও পিয়ন আবুল ভারপ্রাপ্ত গুদাম কর্মকর্তা যোগশাজস করে নিজের নামে (জেনুইন এন্টারপ্রাইজ) নিলামে পণ্য বিক্রি দেখিয়ে আত্মসাত করেছেন লাখ লাখ টাকা। স্থানীয়দের অভিযোগ মতে, সরকারকে গত কয়েক বছরে কোটি কোটি টাকার রাজস্ব আয় থেকে বঞ্চিত করা হয়েছে। একদিকে সীমান্তঘেঁষা অন্যদিকে রোহিঙ্গা অধ্যুষিত এলাকা হওয়ায় এই শুল্ক গুদামে প্রতিদিন বিপুল পরিমাণ আটক পণ্য জমা করে বিভিন্ন সংস্থা। এতে আবুল ও গুদাম কর্মকর্তার আলাদা সুযোগ সৃষ্টি হয়েছে। নিলাম অনুষ্ঠানের দিন-তারিখ প্রচার করা হয় না।
কৌশলে অন্য ডাককারীরা উপস্থিত হলেও সর্বোচ্চ ডাককারী হিসেবে বেশিরভাগ নিলাম দেয়া হয়ে থাকে পিয়নের জেনুইন এন্টারপ্রাইজের নামে। নিলামে বিক্রি পণ্যের টাকা যথানিয়মে ট্রেজারিতে জমা না করে পিয়ন আবুল নিজের ব্যবসায় লাখ লাখ টাকা ব্যবহার করে থাকে। সরকারী কাস্টম এ্যাক্ট অনুসারে নিলামে অংশগ্রহণ ও সর্বোচ্চ ডাককারী সাড়ে ১৭ পার্সেন্ট
আয়কর ও মূল্য সংযোজন করসহ সর্বোচ্চ ডাকের টাকা ট্রেজারিতে জমা করে ওই জমা রসিদটা গুদাম কর্মকর্তার কাছে দাখিল করলে তিনি তাকে নিলামে গণ্য বুঝিয়ে দিয়ে রিসিভ কপি গ্রহণ করবেন।
জেুইন এন্টারপ্রাইজকে যতটি লট নিলামে বিক্রিয় করা হয়েছে, ওসব ডেলিভারি কপিতে সর্বোচ্চ নিলামে ডাককারী (আবুল হোসেনের) দস্তখত না নিয়েই গুদাম কর্মকর্তা মালামাল ডেলিভারি করেছেন এমন বহু ডকুমেন্ট জনকণ্ঠের কাছে সংগৃহীত আছে। নিলাম অনুষ্ঠানের তারিখ থেকে ট্রেজারিতে জমা হওয়ার তারিখ পর্যন্ত খতিয়ে দেখা হলে সত্যতা উদঘাটন করা সম্ভব হবে বলে জানিয়েছেন অপর নিলামকারীরা।
কাস্টম পিয়ন আবুলের যতসব সম্পদ ॥ পিয়ন আবুল ১৮টি স্বর্ণের বার বিক্রি করে প্রায় ৩৪ কোটি টাকা আত্মসাত করেছেন। রামু উপজেলা এলাকায় মেরিচ সিগারেটের এজেন্ট নিতে জামানত দিয়েছেন ৩০লাখ টাকা। টেকনাফের শামলাপুর ও হোয়াইক্যং এলাকায় মেরিচ সিগারেটের এজেন্ট নিয়েছে।
নাইক্ষ্যংছড়িতে রয়েছে বিশাল ইলেক্ট্রনিক্সের দোকান ও রেস্ট হাইসের পাশে কালুর বিল্ডিংয়ে শাখা হিসেবে মেরিচ সিগারেটের এজেন্টের গুদাম। টিভি টাওয়ার সংলগ্ন আলু গোলা মাঠ নামের এলাকায় স্থানীয় আমির হোসেন থেকে এবং ঘুমধুমের আব্বাছ ড্রাইভারের কাছ থেকে কয়েক কোটি টাকার জমি ক্রয় করেছে। এই বিশাল ভূসম্পদের ক্রয়নামায় সাক্ষী হিসেবে দস্তখতকৃত উখিয়ারঘাট এলাকার জসিম উদ্দিন বলেন, কাস্টমে চাকরি করে আবুল হোসেন আঙ্গুল ফুলে কলাগাছ বনে গেছেন। আলাদিনের চেরাগ পাবার মতো অবস্থা।
গোপনে কাস্টমের গুদামে রক্ষিত পণ্য বিক্রি করে কোটি কোটি টাকার মালিক বনে গেছে। তার রয়েছে একটি ডাম্পার ও একটি মূল্যবান বাইক। তুমব্রু এলাকার বশির নামে এক ব্যক্তির সঙ্গে রয়েছে পার্টনারশিপ ব্যবসা। কাস্টমের অবৈধ পিয়ন আবুল হোসেনের (২৬) দুই স্ত্রীর কাছে রয়েছে কয়েক লাখ টাকার স্বর্ণালঙ্কার। নাইক্ষ্যংছড়িতে আদর্শ গ্রামে দ্বিতীয় স্ত্রীর নামে নির্মাণ করেছে বাড়ি। বালুখালীতে ফাউন্ডেশন দিয়ে দালান করার পরিকল্পনা নিলেও দুর্নীতির খবর প্রকাশ হচ্ছে জেনে দালান নির্মাণ আপাতত বন্ধ রেখেছে।
বিজিবি সদস্যরা অবৈধ পণ্যভর্তি টমটম জব্দ করে কাস্টমে জমা দিলে পিয়ন আবুল হোসেন প্রথমে ব্যাটারিগুলো বিক্রি করে দিয়ে চুরি হয়ে যাবার বাহনা তোলে। গুদামের পাহারায় কাস্টম সিপাহী নিয়োজিত রাখার সরকারী নিয়ম রয়েছে। কিন্তু ভারপ্রাপ্ত গুদাম কর্মকর্তার ব্যক্তিগত স্বার্থ হাসিলের জন্য গুদামের দায়িত্বে রাখা হয় অবৈধ পিয়ন আবুল হোসেন ও তার ভগ্নিপতি লেবার ছৈয়দকে। চাবি রাখা হয় আবুলের কাছে। এতে করে গুদামে রক্ষিত পণ্য বিক্রি করতে সুবিধা হয় তাদের।
একাধিক সূত্র থেকে অভিযোগ করা হয়েছে, বিজিবির জমা দেয়া পচনশীল পণ্য নয়-এমন বার্মিজ মূল্যবান জব্দকৃত পণ্যও সিল টেন্ডারে (বিভাগীয় দফতর) না পাঠিয়ে কাস্টম গুদাম কর্মকর্তা অজিত প্রসাদ রুদ্র ও পিয়ন আবুল হোসেন গোপনে আঁতাত করে জেনুইন এন্টারপ্রাইজ লাইসেন্সের নামে নিলামে বিক্রি দেখিয়ে লাখ লাখ টাকা হাতিয়ে নিয়েছে। এতে সরকার বিপুল পরিমাণ রাজস্ব আয় থেকে বঞ্চিত হয়েছে।আশ্চর্যজনক হলেও সত্য, উখিয়ারঘাট কাস্টম গুদাম খালি ও সেখানে রক্ষিত পণ্যাদি চুরির বাহনায় বিক্রি করে দিয়ে লাখ লাখ টাকার মালিক বনে যাওয়া ভারপ্রাপ্ত গুদাম কর্মকর্তা অজিত প্রসাদ রুদ্র অন্যত্র বদলি হয়ে যাবার তদবির চালাচ্ছেন বলে জানা গেছে। পিয়ন আবুল হোসেনও দুদকের হাতে গ্রেফতার হওয়ার ভয়ে চাকরি ছেড়ে দেয়ার চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে বলে জানিয়েছেন স্থানীয়রা।
কাস্টমের পণ্য নিলামে ক্রয়, বিক্রয় ও হিসাবের একটি ফিরিস্তি (পিয়ন আবুল হোসেনের হাতের লেখা) পাওয়া গেছে। এতে দেখা যায় কার নামে কতটাকা ঘুষের লেনদেন করা হয়েছে। এসব বিষয় খতিয়ে দেখা হলে আরও বহু গোপন তথ্য বেরিয়ে আসবে বলে মনে করেন স্থানীয়রা।
দুদকসহ কাস্টমের উর্ধতন কর্মকর্তাদের কাছে এই আবুল হোসেনের মাধ্যমে সরকারী গুদামের পণ্য গোপনে বিক্রি করার সাক্ষী দিতে কাস্টম এলাকার করিম উল্লাহ, আবদুর রহমান সিকদার, শাহজাহান, আনছার উল্লাহ, মুছা ইব্রাহিম, নুরুল ইসলাম, জসিম উদ্দিন, আমিন, মিজান, উকিল আল বেলাল, জয়নাল আবেদীনসহ অনেকে প্রস্তুত রয়েছেন বলে জানিয়েছেন।