অনলাইন ডেস্ক:
২০০৭ সাল। সে এক দুঃসহ সময়। বাংলাদেশে তখন চলছে চেপে বসা অপশক্তির দুঃশাসন। দেশের রাজনীতিকে নতুন করে কলুষিত করার প্রয়াস হয়েছে ২০০৭ ও ২০০৮ সালে।
গণতন্ত্র নির্বাসনে পাঠিয়ে চেপে বসা শাসকগোষ্ঠী তখন রাজনীতিবিদদের চরিত্র হননে ব্যস্ত। রাজনীতি তখন যেন গর্হিত অপরাধ। রাজনীতিক পরিচয়টিও যেন হানিকর। শাসনের নামে ত্রাসের রাজত্ব। ওয়ান-ইলেভেন নামের পটপরিবর্তনের পর চেপে বসা তত্ত্বাবধায়ক নামের অপব্যবস্থায় জনজীবনে নাভিশ্বাস। বাংলাদেশের রাজনৈতিক আকাশকে সত্যিকার অর্থেই দুর্যোগের মেঘে আচ্ছন্ন করে রেখেছিল। সেই দুর্বিষহ দিনে, ২০০৭ সালের ১৬ জুলাই জননেত্রী শেখ হাসিনাকে গ্রেপ্তার করা হয়। আলোয় উদ্ভাসিত একটি ভোর যেন অন্ধকারে ঢেকে গিয়েছিল সেদিন। একসময় তো রাজনীতি থেকেই তাঁকে নির্বাসনে পাঠানোর অপচেষ্টা করা হয়।
টেলিভিশনের পর্দায় সেই গ্রেপ্তার-নাটক চাক্ষুষও করে বাংলাদেশের মানুষ। তত্ত্বাবধায়ক সরকারের নিরাপত্তারক্ষীদের অপ্রয়োজনীয় অথচ অতিনাটকীয়তায় শেখ হাসিনাকে গ্রেপ্তারের সেই বার্তা দেশ থেকে বিদেশে প্রচার হতেও সময় লাগেনি। অস্ট্রিয়ার রাজধানী ভিয়েনায় তখন মাঝরাত। সেলফোনে আওয়ামী লীগের তৎকালীন পরিবেশবিষয়ক সম্পাদক, বর্তমান তথ্য ও সম্প্রচার মন্ত্রী ড. হাছান মাহ্মুদ জানালেন, এইমাত্র আপাকে গ্রেপ্তার করে নিয়ে যাচ্ছে—মাত্র একটি বাক্যেই কথা শেষ। ফোন করি লন্ডনে বঙ্গবন্ধুর কনিষ্ঠ কন্যা শেখ রেহানাকে। ফোনের ওপারে তাঁর কণ্ঠেও হতাশা। তিনি তাত্ক্ষণিকভাবে ‘শেখ হাসিনা মুক্তি সংগ্রাম পরিষদ’ গঠনের পরামর্শ দেন। পরদিন অস্ট্রিয়া সময় সকাল ৮টায় বিপুলসংখ্যক বাঙালি নারী-পুরুষের উপস্থিতিতে বিক্ষোভ সমাবেশ করি। অস্ট্রিয়াপ্রবাসী সর্বস্তরের বাঙালিকে নিয়ে ‘শেখ হাসিনা মুক্তি সংগ্রাম পরিষদ’ গঠিত হয়।
তবে সবাইকে ছাপিয়ে যায় শেখ পরিবারের সদস্যদের প্রয়াস। প্রিয়জনের মুক্তির চেষ্টায় সম্ভাব্য সব পথে হেঁটেছেন এই পরিবারের প্রত্যেক সদস্য। শেখ হাসিনাকে গ্রেপ্তারের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ গড়ে তুলে তাঁকে মুক্ত করতে তাঁর যুক্তরাজ্যপ্রবাসী ছোট বোন শেখ রেহানা এবং যুক্তরাষ্ট্রপ্রবাসী ছেলে সজীব ওয়াজেদ জয় টেলিফোনে সব সময় আমাদের সঙ্গে যোগাযোগ করেছেন। বিভিন্ন নির্দেশনা দিয়েছেন। শেখ রেহানার দুই কন্যা টিউলিপ সিদ্দিক ও আজমিনা সিদ্দিক রুপন্তি, ছেলে রাদওয়ান মুজিব সিদ্দিক ববি সব সময় শেখ হাসিনার মুক্তির লক্ষ্যে কাজ করেছেন। তাঁর মুক্তির ব্যাপারে আইনি লড়াই করতে সুদূর কানাডা থেকে আন্তর্জাতিক আইনজীবী অধ্যাপক ড. পায়াম আকাভান ও আন্তর্জাতিক মানবাধিকার আইনজীবী উইলিয়াম স্লোন ওই সময় বাংলাদেশে আসেন। এই দুই আইনজীবীর সঙ্গে যোগাযোগ এবং তাঁদের দেশে পাঠানোর ব্যাপারে ভূমিকা রেখেছিলেন শেখ রেহানার ছোট মেয়ে আজমিনা সিদ্দিক রুপন্তি।
আজকের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার চরিত্রের যে বিষয়টি সবার আগে দৃষ্টি কাড়ে তা হচ্ছে তাঁর গভীর প্রত্যয়। দেশ ও মানুষের কল্যাণে তিনি সব সময় নিবেদিত। গভীর সংকটেও তিনি জনগণের কল্যাণ চিন্তা করেন। তাঁর সেই চিন্তার প্রতিফলন বাংলাদেশের উল্লেখযোগ্য সব অর্জনে। ২০০৭ সালে জেলখানায় বসেই এই উত্তরণের পরিকল্পনা করে রেখেছিলেন শেখ হাসিনা। সম্প্রতি এক বক্তৃতায় তিনি সে কথা উল্লেখ করেছেন। জানিয়েছেন, বাংলাদেশকে উন্নয়নশীল দেশে উন্নীত করার যে পরিকল্পনা, তা সেনা নিয়ন্ত্রিত তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সময় কারাগারে নিঃসঙ্গ দিনগুলোতেই তৈরি করেছিলেন তিনি। সেই পরিকল্পনা বাস্তবায়নে গত ১৩ বছরে তাঁরই নেতৃত্বে অনেকটাই এগিয়েছে বর্তমান সরকার। বাকি সময়ের আগেই কাঙ্ক্ষিত লক্ষ্যে পৌঁছানোর ব্যাপারেও তো আশাবাদী জননেত্রী শেখ হাসিনা।
২০০৭ সালের ১৬ জুলাই গ্রেপ্তারের পর নিঃসঙ্গ কারাবাসে কেবল শুয়ে-বসেই কাটেনি তাঁর। সৃজনশীল জননেত্রী সেই নিঃসঙ্গ-একাকিত্বের দিনগুলোতে দেশ ও জনগণের কল্যাণে ভবিষ্যৎ পথপরিক্রমার পরিকল্পনা করেছেন।
রাজনীতির ইতিহাসে কিছু কিছু ঘটনা ঘুরে ঘুরে আসে। যদি বলা হয় ইতিহাসের পুনরাবৃত্তি, খুব একটা বাড়িয়ে বলা হবে না। আমাদের দেশের রাজনীতি থেকে বঙ্গবন্ধুকে কোনো দিন মুছে ফেলা যাবে না। যদিও তাঁকে হেয়প্রতিপন্ন করার অনেক চেষ্টাই হয়েছে। বঙ্গবন্ধুকে তাঁর দীর্ঘ রাজনৈতিক জীবনে অনেক চড়াই-উতরাই পেরিয়ে আসতে হয়েছে। বঙ্গবন্ধুকন্যা শেখ হাসিনার রাজনীতিতে অভিষেক যেমন তাঁর জন্য সুখকর অভিজ্ঞতা ছিল না, তেমনি মসৃণ নয় তাঁর রাজনৈতিক চলার পথটিও। পায়ে পায়ে পাথর ঠেলে শেখ হাসিনাকে আজকের অবস্থানে আসতে হয়েছে। জীবনের ঝুঁকি নিতে হয়েছে। কিন্তু জনগণকে আস্থায় নিয়ে রাজনৈতিক কল্যাণের যে পথযাত্রা শুরু হয়েছিল তাঁর, তা থেকে তাঁকে বিচ্যুত করা যায়নি। তাঁর দীর্ঘ রাজনৈতিক যাত্রাটি একেবারেই কুসুমাস্তীর্ণ বলা যাবে না। বরং কণ্টকাকীর্ণ দীর্ঘ পথ পাড়ি দিয়েছেন তিনি। বাবার মতোই অনেক চড়াই-উতরাই পেরিয়ে এসেছেন। দীর্ঘদিন কাটাতে হয়েছে নিঃসঙ্গ পরবাস। ১৯৮১ সালে দেশে ফিরে আসার পরও ছায়ার মতো তাঁকে অনুসরণ করেছে ঘাতক। একাধিকবার হত্যার চেষ্টা করা হয়েছে।
২০০৮ সালের নির্বাচনে জনগণের ভোটে জয়ী হয়ে সরকার গঠন করেন শেখ হাসিনা। রাজনীতির জটিল পথে সাফল্যের ধারাবাহিকতায় টানা তৃতীয় মেয়াদের সরকার নিয়ে চলছেন তিনি। নিঃসঙ্গ কারাগারে বসে দিনের পর দিন যে উন্নয়ন পরিকল্পনা করেছেন, দেশ ও জাতির অগ্রগতির যে চিন্তা করেছেন, তারই প্রতিফলন আজ আমরা দেখতে পাচ্ছি প্রতিটি স্তরে। সরকারপ্রধান হিসেবে শেখ হাসিনার নেতৃত্বে গত ১৩ বছরের আর্থ-সামাজিক ও মানব উন্নয়নসহ বিভিন্ন ক্ষেত্রে বাংলাদেশের অগ্রগতি আন্তর্জাতিক মহলেও প্রশংসিত হচ্ছে। মানুষকে সঙ্গে নিয়ে এই উন্নয়নের পথে অগ্রযাত্রায় যিনি নেতৃত্ব দিয়েছেন, তিনি শেখ হাসিনা।
অনেকের ধারণা ছিল ২০০৭ সালের ১৬ জুলাই গ্রেপ্তারের পর শেখ হাসিনা আঁতাতের পথে যাবেন। কিন্তু কল্যাণমন্ত্রে দীক্ষা যাঁর, তাঁকে জনকল্যাণের পথ থেকে বিচ্যুত করা যায় না। জনকল্যাণকে ব্রত করে তাই পথ চলেছেন জনগণের নেত্রী, গণতন্ত্রের মানসকন্যা শেখ হাসিনা।
জনগণের জয় হোক—১৬ জুলাই এই মন্ত্রে নতুন করে উজ্জীবিত হই আমরা।
লেখক : সর্বইউরোপীয় আওয়ামী লীগের সভাপতি
এবং অস্ট্রিয়াপ্রবাসী মানবাধিকারকর্মী
nazrul@gmx.at