অনলাইন ডেস্ক:
জাতীয় সংসদে প্রস্তাবিত ২০২২-২৩ অর্থবছরের বাজেটের ওপর সাধারণ আলোচনায় বিদেশে পাচারকৃত অর্থ দেশে ফেরত আনতে ‘দায়মুক্তি’র বিধানের কঠোর সমালোচনা করেছে বিরোধী দলের সংসদ সদস্যরা। সরকারি দলের সদস্যরা ৭ ভাগের পরিবর্তে ১০ ভাগ ট্যাক্স দিয়ে এই সুযোগ বহাল রাখার কথা বললেও বিরোধী দলের সংসদ সদস্যরা বলেছেন, এই প্রস্তাব দেশের প্রচলিত আইনের পরিপন্থী ও সংবিধানের সঙ্গে সাংঘর্ষিক। এই সুযোগ রাখা হলে দুর্নীতি ও অর্থপাচারকারীরা আরো উৎসাহিত হবে। তাই দায়মুক্তি নয়, আইনের আওতায় পাচারকৃত অর্থ ফেরত আনতে হবে।
বৃহস্পতিবার (১৬ জুন) প্রথমে স্পিকার ড. শিরীন শারমিন চৌধুরী ও পরে প্যানেল সভাপতি শামসুল হক টুকুর সভাপতিত্বে অনুষ্ঠিত সাধারণ আলোচনায় অংশ নিয়ে এসব কথা বলেন তারা। এই আলোচনায় অংশ নেন সরকারি দলের উপাধ্যক্ষ আবদুস শহীদ, নূর মোহাম্মদ, শাহে আলম, দীপংকর তালুকদার, নুরুউদ্দিন চৌধুরী, জাকিয়া পারভীন খানম, খোদেজা নাসরিন আক্তার হোসেন, শিবলী সাদিক, আঃ কাঃ মঃ সরওয়ার জাহান. ডা. সামিল উদ্দিন আহমেদ শিমুল, অপরাজিতা হক, মামুনুর রশীদ কিরন, ওমর ফারুক চৌধুরী ও মোছাম্মাৎ খালেদা খানম এবং বিরোধী দল জাতীয় পার্টির মহাসচিব মুজিবুল হক চুন্নু ও বিএনপির মোশারফ হোসেন।
আলোচনায় অংশ নিয়ে জাতীয় পার্টির মুজিবুল হক চুন্নু প্রস্তাবিত বাজেটে অর্থ পাচারকারীদের ‘দায়মুক্তি’ দেওয়ার কঠোর সমালোচনা করেন। তিনি বলেন, এটি দেশের সংবিধানের পরিপন্থী ও দেশের প্রচলিত আইনের সঙ্গে সাংঘর্ষিক। অতীতে অনেকবার কালো টাকা সাদা করার সুযোগ দেওয়া হয়েছে, কিন্তু তাতে কোন সুফল আসেনি। ৭ ভাগ ট্যাক্স দিয়ে বিদেশে পাচারকৃত অর্থ দেশে ফেরত আনতে বাজেটে দেওয়া প্রস্তাব কোনভাবেই সমর্থনযোগ্য নয়।
যারা দেশের বিপুল অর্থ পাচার করে কানাডার বেগম পাড়ায়, যুক্তরাষ্ট্রে, সিঙ্গাপুর, মালয়েশিয়ায় বাড়ি-ব্যবসা প্রতিষ্ঠান গড়ে তুলেছে, তারা কী এই সুযোগ নিয়ে পাচারকৃত অর্থ ফেরত আনবে? আর আইনের তিনটি ধারা সংশোধন না করলে বিদেশে পাচারকৃত অর্থ ট্যাক্স দিয়ে দেশে ফেরত আনার কোন সুযোগ নেই। বরং এই সুযোগ দেওয়া হলে দুর্নীতিবাজ-অসাধু ব্যক্তিরা বিদেশে অর্থ পাচারে আরো উৎসাহিত হবে।
অর্থমন্ত্রীর একটি মন্তব্যের সমালোচনা করে সাবেক প্রতিমন্ত্রী বলেন, অর্থমন্ত্রী বলেছেন, ঢাকায় যার ফ্ল্যাট-প্লট আছে সে কালো টাকার মালিক। আমি ৫ বার এমপি ও ৩ বার মন্ত্রী হয়েছি। আমার ঢাকায় কোন বাড়ি নেই। ২০১১ সালে পূর্বাচলে প্লট পেয়েছিলাম। তার মানে অর্থমন্ত্রীর নতুন সঙ্গা অনুযায়ী আমি কালো টাকার মালিক হয়ে গেছি। তাহলে মহামান্য রাষ্ট্রপতি, স্পিকার সকলেই কি কালো টাকার মালিক? আমি আইন লঙ্ঘন করে কালো টাকার মালিক হয়েছি কি-না সংসদে এর ব্যাখা চাই।
প্রয়াত রাষ্ট্রপতি এইচ এম এরশাদকে স্বৈরাচার বলার প্রতিবাদ জানিয়ে জাপা মহাসচিব বলেন, যার লগে চুরি করলাম সেই যদি চোর বলে তাহলে কোথায় যাই। আওয়ামী লীগের সঙ্গে নির্বাচন করলাম, ক্ষমতায় আনলাম, আসলাম। তবে এভাবে যদি গালি দেওয়া হয় তাহলে তো নতুন করে ভাবতে হবে- কী করব, কোথায় যাব। সামনে তো দিন আসছে।
সাবেক চিফ হুইপ আব্দুস শহীদ বলেন, সরকারের দুরদর্শী চিন্তার কারণে করোনাকালে দেশের অর্থর্নীতির অগ্রগতি হয়েছে। যুগোপযোগী বাজেটের কারণে এটা সম্ভব হয়েছে। অথচ যারা বাজেটের সমালোচনা করছেন, সেই বিএনপি’র দুঃশাসনের কথা দেশবাসী ভুলে যায়নি। তারা দেশের ধ্বংসের দ্বারপ্রান্তে নিয়ে গিয়েছিলো। ক্ষমতার বাইরে গিয়ে আগুণ সন্ত্রাসের মাধ্যমে জনজীবনকে বিপর্যস্ত করে তুলেছিলো। সরকার দক্ষতার সঙ্গে সেই পরিস্থিতি মোকাবেলা করেছে।
বিএনপির মোশাররফ হোসেন প্রস্তাবিত বাজেটকে ঋণখেলাপী ও অর্থপাচারকারীদের বাজেট আখ্যায়িত করে বলেন, দ্রব্যমূল্যের উর্ধ্বগতিতে মানুষ আজ দিশেহারা। গত ১৪ বছরে বিশাল অঙ্কের টাকা লুট করে বিদেশে পাচার করা হয়েছে। এখন মাত্র সাত ভাগ ট্যাক্স দিয়ে চোরদের সুযোগ দেওয়া হয়, এটা সম্পূর্ণ অনৈতিক। তিনি আরো বলেন, জনপ্রশাসনে বিরোধী দলের সমর্থকদের নিঃপেষণ করা হচ্ছে। নির্বাচন কমিশন একজন এমপিকে সামাল দিতে পারে না। ইভিএমকে স্বচ্ছতায় আনা না হয়, তবে দেশের মানুষ এর প্রতি আস্থা হারাবে।
প্রস্তাবিত বাজেটকে ইতিবাচক হিসেবে দেখছেন আওয়ামী লীগের সংসদ সদস্য নূর মোহাম্মদ। তিনি বলেন, বিশ্বায়নের যুগে প্রতিযোগিতায় টিকে থাকার জন্য নতুন প্রজন্মকে দক্ষ ও যোগ্য করে গড়ে তুলতে হবে। এ জন্য শিক্ষা ও প্রযুক্তিখাতে বরাদ্দ বাড়াতে হবে। তিনি সামাজিক নিরাপত্তা খাতকে আরো সম্প্রসারিত করার এবং কৃষি উৎপাদন বাড়াতে প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ গ্রহণের আহ্বান জানান।
প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার দক্ষ ও সাহসী পদক্ষেপের কারণে পাবর্ত্য চট্টগ্রামে শান্তি প্রতিষ্ঠিত হয়েছে উল্লেখ করে সরকারি দলের দীপংকর তালুকদার বলেন, একটি অপশক্তি নানা ঘটনা ঘটিয়ে পার্বত্য অঞ্চলে আশান্তি সৃষ্টির চক্রান্ত করছে। এখানে থাকা অবৈধ অস্ত্র উদ্ধার এবং অবৈধ অস্ত্রধারীদের আইনের আওতায় আনতে হবে। তিনি ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট জাতির পিতাকে সপরিবারে হত্যার পর অস্ত্রহাতে প্রতিরোধ যুদ্ধে যারা অংশ নিয়েছিল তাদের রাষ্ট্রীয়ভাবে স্বীকৃতি প্রদানের দাবী জানান।
সরকারি দলের শিবলী সাদিক বলেন, লন্ডনে পলাতক তারেক জিয়া এখনও পাকিস্তান জিন্দাবাদ বলে, লাশ ফেলার হুমকি দেয়। আরেকজন ইতিহাসে পড়া বিএনপির মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর জনগণকে বিভ্রান্ত করতে একবার বলেন- খালেদা জিয়া প্রথম মহিলা মুক্তিযোদ্ধা, তারেক রহমান শিশু মুক্তিযোদ্ধা! আবার বলেন, খালেদা জিয়া নাকি পদ্মা সেতুর ভিত্তি স্থাপন করেছেন! এদের এমন নির্লজ্জ মিথ্যাচার জনগণ আর সহ্য করতে চায় না।
সরকারি দলের সরওয়ার জাহান বাজেটে প্রস্তাবিত বিদেশে পাচারকৃত অর্থ ফেরত আনার প্রস্তাবকে সমর্থন করে বলেন, তবে ৭ ভাগ নয়, ১০ ভাগ ট্যাক্স দিয়ে বিদেশ থেকে পাচারকৃত অর্থ দেশে ফেরত আনার সুযোগ দিতে হবে। একইসঙ্গে দেশে যত কালো টাকা বা অপ্রদর্শিত অর্থ রয়েছে সেখানেও ১০ ভাগ ট্যাক্স দিয়ে সেই অর্থ সাদা করার সুযোগ প্রদানের প্রস্তাব করেন।
সূত্র: কালের কন্ঠ অনলাইন