অনলাইন ডেস্ক:
রাষ্ট্রপতির কাছে ক্ষমা চাওয়া, নাকি নির্বাহী আদেশে সাজা মাফ—এই আলোচনায় আটকে আছে চিকিৎসার জন্য বিএনপি চেয়ারপারসন খালেদা জিয়ার বিদেশ যাওয়ার বিষয়টি। বিএনপি নেতারা গতকাল শনিবার বলেছেন, ক্ষমা চাওয়া হবে না। ক্ষমা চাওয়া মানে দুর্নীতির দায় স্বীকার করা। সরকারি দল আওয়ামী লীগের পক্ষ থেকে বলা হচ্ছে, রাষ্ট্রপতির কাছে ক্ষমা চাইলে প্রধানমন্ত্রী বিষয়টি মানবিকভাবে দেখবেন।
তবে নির্ভরযোগ্য একটি সূত্র জানিয়েছে, চিকিৎসার বিষয়টি নিয়ে খালেদা জিয়ার পরিবারের এক বা একাধিক সদস্য আইনমন্ত্রী আনিসুল হকের সঙ্গে যোগাযোগ রক্ষা করছেন। সেখানে ক্ষমার বিষয়টি প্রাধান্য পাচ্ছে কি না তা জানা সম্ভব হয়নি।
বিএনপির স্থায়ী কমিটির অন্যতম সদস্য নজরুল ইসলাম খান গতকাল বলেছেন, বিদেশে উন্নত চিকিৎসার জন্য খালেদা জিয়ার পরিবারের পক্ষ থেকে সরকারের কাছে কিছুদিন আগে একটি আবেদন করা হয়েছে। আবেদনটি এখনো বাতিল হয়নি। সরকার বলছে এটি বিবেচনাধীন। গতকাল মতিঝিলে জোটের শরিক এনপিপি আয়োজিত দোয়া মাহফিলে প্রধান অতিথির বক্তব্যে এ কথা বলেন তিনি।
খালেদা জিয়ার পরিবারের ঘনিষ্ঠ একটি সূত্র জানায়, বিএনপি বা খালেদা জিয়ার শুভাকাঙ্ক্ষীরা নানাভাবে চেষ্টা করছেন। এর মধ্যে কয়েকজন বুদ্ধিজীবী ও কূটনীতিক রয়েছেন।
গত বছরের এপ্রিলে নির্বাহী আদেশে সাজা স্থগিত করে খালেদা জিয়াকে বাসায় নিয়ে আসার বিষয়ে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছিলেন তাঁর পরিবারের সদস্যরাই। সে সময় খালেদা জিয়ার ভাই শামীম এস্কান্দার নির্বাহী আদেশে সাজা স্থগিত চেয়ে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় ও আইন মন্ত্রণালয়ের মাধ্যমে প্রধানমন্ত্রীর কাছে আবেদন করেছিলেন। পরবর্তী সময়ে বোন সেলিমা ইসলাম ও বোনের স্বামী রফিকুল ইসলামসহ তিনি প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সঙ্গে সাক্ষাৎ করেন। এর ধারাবাহিকতায় জেলখানা থেকে বাসায় থাকার অনুমতি পান খালেদা জিয়া।
দুই দলের সূত্রগুলো জানায়, নির্বাহী আদেশে খালেদা জিয়ার মুক্তির বিষয়ে বিএনপির নেতারা গুরুত্বপূর্ণ কোনো ভূমিকায় ছিলেন না। এবার চিকিৎসার বিষয়ে কোনো প্রক্রিয়া থাকলে তাতেও দল যুক্ত থাকবে কি না সন্দেহ।
গত মঙ্গলবার জাতীয়তাবাদী আইনজীবী ফোরামের একটি প্রতিনিধিদল আইনমন্ত্রীর সঙ্গে দেখা করতে গেলে তিনি বলেছিলেন, ‘আপনাদের আবেদন আমি পরীক্ষা করে দেখব।’ তিনি বলেন, ‘আমি শুধু স্মরণ করিয়ে দিতে চাই, যখন খালেদা জিয়াকে মুক্ত করা হয় তখন কিন্তু উনার পরিবারের যে আবেদন ছিল, সেটাকে মানবিক দিক থেকে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা দেখেছেন। তখন কিন্তু কোনো দাবি তুলতে হয়নি। প্রধানমন্ত্রী নিজেই উনাকে মুক্ত করেছিলেন। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা নিশ্চয়ই মানবিকতা দেখাতে জানেন।’
আইনমন্ত্রী আরো বলেন, ‘আমি মনে করি, বিষয়টি এখনো প্রিম্যাচিউর (পূর্ণতা পায়নি)। আপনাদের যদি কিছু বলে দিই, তা ঠিক হবে না। আমাকে একটু সময় দিন।’
জিয়া অরফানেজ ট্রাস্ট দুর্নীতির মামলায় সাজা পান খালেদা জিয়া। আওয়ামী লীগের নীতিনির্ধারণী পর্যায়ের একাধিক নেতা জানান, আওয়ামী লীগ চায়, রাজনৈতিকভাবে নয়, আইনের পথেই খালেদা জিয়ার বিদেশে চিকিৎসার বিষয়টি সুরাহা হোক। এই আইনি পথ হলো, দোষ স্বীকার করে রাষ্ট্রপতির কাছে নিঃশর্ত ক্ষমার আবেদন। তাতেই খালেদা জিয়ার বিদেশে চিকিৎসার পথ সুগম হতে পারে। সে ক্ষেত্রে খালেদা জিয়ার পরিবারের কোনো সদস্য বা বিএনপির পক্ষ থেকে আবেদন করতে হবে। এই নেতারা মনে করছেন, রাষ্ট্রপতির কাছে ক্ষমা চাওয়া ছাড়া খালেদা জিয়াকে বিদেশে পাঠানো হলে বিএনপি একে তাদের রাজনৈতিক বিজয় বলে প্রচার করবে।
আওয়ামী লীগের সভাপতিমণ্ডলীর সদস্য কাজী জাফর উল্যাহ বলেন, ‘বিএনপি বারবার নির্বাহী আদেশের কথা কেন বলছে জানি না। রাষ্ট্রপতির কাছে ক্ষমা চাওয়ার আইনি যে পথ, সে পথে তো তারা যাচ্ছে না।’
আওয়ামী লীগের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক আ ফ ম বাহাউদ্দিন নাছিম বলেন, সরকারের কোনো উদ্যোগে খালেদা জিয়া মুক্তি পেলে বিএনপি বলবে, আন্দোলনের ভয়ে সরকার পিছু হটেছে। তাই রাষ্ট্রপতির কাছে ক্ষমা চাওয়ার কোনো বিকল্প নেই।
খালেদা জিয়ার চিকিৎসার জন্য বিএনপির পক্ষ থেকে প্রধানমন্ত্রী বা রাষ্ট্রপতির সঙ্গে দেখা করার কোনো পরিকল্পনা আছে কি না জানতে চাইলে গতকাল রাতে বিএনপির মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর বলেন, ‘আনুষ্ঠানিকভাবে তো আমরা প্রতিটি অনুষ্ঠান থেকে বলছি। সেগুলো তো সরকারের কাছে যাচ্ছে। কিন্তু রাষ্ট্রপতির কাছে ক্ষমা ভিক্ষা চাওয়ার কোনো সিদ্ধান্ত আমাদের নেই। কারণ আমরা মনে করি, চেয়ারপারসনের বিরুদ্ধে যে মামলা এবং মামলার রায়, সবই রাজনৈতিক।’
বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য খন্দকার মোশাররফ হোসেনও একই কথা বলেছেন। তিনি বলেন, রাষ্ট্রপতির কাছে ক্ষমা চাওয়া মানে হলো দায় স্বীকার করে মার্জনার আবেদন করা। এটা বেগম জিয়া চাইলে অনেক আগেই দায়মুক্তি নিতে পারতেন।
খন্দকার মোশাররফ হোসেন বলেন, প্রধানমন্ত্রী চাইলে আরেকটি নির্বাহী আদেশ দিয়ে বলতে পারেন, দণ্ডবিধির ৪০১ ধারায় বেগম জিয়াকে যে শর্তে সাজা স্থগিত করে চিকিৎসার সুযোগ দেওয়া হয়েছিল, সেই শর্তগুলো বাতিল করা হলো। তিনি এখন শর্তহীনভাবে যেকোনো স্থানে চিকিৎসা নিতে পারবেন। অর্থাৎ তাঁরা চাইলে আরেকটি নির্বাহী আদেশে খালেদা জিয়াকে বিদেশে চিকিৎসার ব্যবস্থা করতে পারেন। ৪০১ ধারায় স্পষ্ট বলা আছে ‘শর্তসাপেক্ষে অথবা শর্তহীনভাবে’।
গতকাল রাতে খালেদা জিয়ার বোন সেলিমা ইসলাম বলেন, ‘আমরা তো আবেদন করেছি তাঁকে মুক্তি দিয়ে বিদেশে চিকিৎসার জন্য প্রেরণ করতে। সরকারের পক্ষ থেকে আজ পর্যন্ত এ বিষয়ে কোনো অগ্রগতি আমাদের জানানো হয়নি।’
রাষ্ট্রপতির কাছে ক্ষমা চাওয়ার কোনো সিদ্ধান্ত পরিবারের পক্ষ থেকে নেওয়া হয়েছে কি না—এমন প্রশ্নের জবাবে গত শুক্রবার সেলিমা ইসলাম সাংবাদিকদের বলেছিলেন, ‘ওরা (আওয়ামী লীগ নেতারা) কেন ভুলে যায়, খালেদা জিয়া ৯ বছর স্বৈরাচারবিরোধী আন্দোলন করে দেশে গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠা করেছিলেন। প্রয়োজনে খালেদা জিয়া মারা যাবে, তবু ক্ষমা চেয়ে আবেদন করা হবে না।’
খালেদা জিয়ার ছোট ভাই শামীম এস্কান্দার গত ১১ নভেম্বর সর্বশেষ স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে খালেদা জিয়াকে বিদেশে নিয়ে চিকিৎসার জন্য আবেদন করেন। পরদিন তিনি যুক্তরাষ্ট্রে চলে যান। গত ১৬ নভেম্বর সোমবার আবেদনটির বিষয়ে সাংবাদিকদের জানান খালেদা জিয়ার ব্যক্তিগত চিকিৎসক প্রফেসর ডা. এ জেড এম জাহিদ হোসেন। তিনি বলেন, পরিবারের পক্ষে এটি পঞ্চম আবেদন। ম্যাডামকে বিদেশে উন্নত চিকিৎসার জন্য তাঁর জামিন এবং বিদেশে পাঠানোর জন্য সরকারের কাছে এই আবেদন করা হয়।
খালেদা জিয়ার পরিপাকতন্ত্রে রক্তক্ষরণ হচ্ছে : ফখরুল
বিএনপি চেয়ারপারসন খালেদা জিয়ার পরিপাকতন্ত্রে রক্তক্ষরণ হচ্ছে। সেটি বন্ধ করতে তাঁকে বিদেশে নেওয়া অতি জরুরি বলে জানিয়েছেন দলটির মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর। গতকাল ডা. মিলনের মৃত্যুবার্ষিকী উপলক্ষে আয়োজিত আলোচনাসভায় খালেদা জিয়ার স্বাস্থ্যের সর্বশেষ অবস্থা তুলে ধরেন তিনি।
মির্জা ফখরুল বলেন, খালেদা জিয়ার নানা জটিলতা আছে। প্রধানত, পরিপাকতন্ত্র থেকে রক্তক্ষরণ হচ্ছে। এটা বন্ধ করাই মূল কাজ। কোন জায়গা থেকে রক্তপাত হচ্ছে, তা বের করার জন্য দেশের শ্রেষ্ঠ চিকিৎসকরা চেষ্টা করছেন। কিন্তু এটা চিহৃিত করার প্রযুক্তি বাংলাদেশে নেই। যে কারণে চিকিৎসকরা বারবার বলছেন, তাঁকে (খালেদা জিয়া) একটি উন্নত চিকিৎসাকেন্দ্রে নেওয়া দরকার, যেখানে যন্ত্রপাতিগুলো আছে।