অনলাইন ডেস্ক:
‘বাংলা নিজের মেয়েকেই চায়’—পশ্চিমবঙ্গ বিধানসভা নির্বাচনে এই স্লোগান নিয়ে তৃণমূল কংগ্রেস নন্দীগ্রামে হোঁচট খেলেও ভবানীপুর উপনির্বাচনে তা অক্ষরে অক্ষরে ফলে গেছে। প্রায় ৬০ হাজার ভোটের ব্যবধানে ভারতীয় জনতা পার্টির (বিজেপি) প্রার্থী প্রিয়াঙ্কা টিবরেওয়ালকে পরাজিত করে মুখ্যমন্ত্রিত্ব অটুট রেখেছেন মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। সেই সঙ্গে প্রশস্ত হয়েছে তাঁর সর্বভারতীয় নেতৃত্বের পথ।
গতকাল রবিবার হাইভোল্টেজ ভবানীপুর উপনির্বাচনের ফলাফলের দিকে তাকিয়ে ছিল গোটা ভারত। এদিন রেকর্ড মার্জিনে ভবানীপুর জয় করেন মমতা। নিজের রেকর্ড নিজেই ভেঙে ধরে রাখেন মুখ্যমন্ত্রীর কুর্সি।
ফল ঘোষণা হতেই এদিন বাঁধনহারা উচ্ছ্বাসে ফেটে পড়ে তৃণমূলের কর্মী-সমর্থকরা। অতীতের প্রায় সব রেকর্ড ভেঙে এদিন ৫৮ হাজার ৮৩২ ভোটের ব্যবধানে নিকটতম বিজেপি প্রার্থী প্রিয়াঙ্কাকে পরাজিত করেন তিনি, যা তাঁর ২০১১ সালের ব্যবধানকেও ছাপিয়ে গেল। ভবানীপুরে মোট ভোটের ৭২ শতাংশের বেশি গেছে মমতার ঝুলিতে।
গতকাল ভোট গণনার দিন প্রথম রাউন্ড থেকেই ঝড়ো ব্যাটিং করেন মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। গণনার শুরুতেই খোলা পোস্টাল ব্যালট থেকেই এগিয়ে থাকেন তিনি। এরপর একেকটি রাউন্ডে নিজের ব্যবধান ক্রমশই বাড়াতে থাকেন তৃণমূল সুপ্রিমো। যত বেলা গড়াতে থাকে, ততই স্পষ্ট হয়ে যায় জয়ের রূপরেখা। মমতার উন্নয়নেই ভরসা রেখেছে ভবানীপুর। দাগ কাটতে পারেননি বিজেপির প্রিয়াঙ্কা। আর বাম প্রার্থী শ্রীজীব বিশ্বাসকে যেন খুঁজেই পাওয়া গেল না।
সকাল থেকে ফলাফলের ট্রেন্ড দেখেই কালীঘাটে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের পাড়ায় শুরু হয় উচ্ছ্বাস। সবুজ আবির উড়িয়ে উল্লাসে মাতে তৃণমূল কর্মী-সমর্থকরা। জয় স্পষ্ট বোঝার পরই কালীঘাটের বাড়িতে মমতাকে অভিনন্দন জানাতে আসেন অভিষেক বন্দ্যোপাধ্যায়। দিদির সঙ্গে দেখা করতে আসেন একে একে তাঁর ভাইয়েরা। কার্তিক ও স্বপন বন্দ্যোপাধ্যায়কে দেখা যায় সবুজ আবির মেখে কর্মীদের সঙ্গে উচ্ছ্বাসে মাতোয়ারা হতে।
মমতা ভবানীপুর উপনির্বাচনের প্রচারের সময় একাধিকবার বলেছেন, ‘বি দিয়েই ভবানীপুর আর বি দিয়েই ভারতবর্ষ।’ অর্থাৎ ভবানীপুর থেকেই যে ২০২৪ সালের লোকসভা নির্বাচনকে টার্গেটে রেখে লড়াইয়ের ময়দানে নেমে পড়েছেন তিনি, তা ঠারেঠুরে স্পষ্ট করে দেন নিজেই। সেই সূত্র ধরেই এদিন কার্তিক বন্দ্যোপাধ্যায় বলেন, ‘মিনি ইন্ডিয়া হচ্ছে ভবানীপুর। মিনি ইন্ডিয়া দেখিয়ে দিল গ্রেটার ইন্ডিয়ায় ২০২৪ সালে কী হতে চলেছে।’
অন্যদিকে মশাল জ্বালিয়ে জয় উদযাপন করতে দেখা যায় মদন মিত্রকে। কামারহাটির এই বিধায়কের কথায়, ‘মমতা রোমে যাবেন আর বিজেপি হোমে যাবে।’ সোনারপুরের বিধায়ক লাভলী মৈত্র বলেন, ‘প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি দাঁড়ালেও ভবানীপুরে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ই জিততেন। খেলা শুরু হয়ে গেছে। ২০২৪ সালে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়কে দিল্লি পাঠিয়ে এই খেলা শেষ হবে।’
গত এপ্রিল-মে মাসে পশ্চিমবঙ্গ বিধানসভা নির্বাচনে নন্দীগ্রাম আসনে তৃণমূলত্যাগী বিজেপি প্রার্থী শুভেন্দু অধিকারীর কাছে এক হাজার ৯৫৬ ভোটে হারেন মমতা। কিন্তু সেই নির্বাচনে তৃণমূলের বিপুল জয় মমতাকেই মুখ্যমন্ত্রিত্বের আসনে বসিয়ে দেয়। মুখ্যমন্ত্রিত্ব ধরে রাখার জন্য সংবিধান অনুসারে ছয় মাসের মধ্যে রাজ্যের যেকোনো আসন থেকে উপনির্বাচনে জিতে আসার বাধ্যবাধকতাও তৈরি হয় তখনই। ভবানীপুর উপনির্বাচনে সেই বাধ্যবাধকতার আনুষ্ঠানিকতাই পালন করেন মমতা। এখানকার রেকর্ডভাঙা জয়ের আনন্দ অবধারিতভাবে কেবল এখানে সীমাবদ্ধ থাকেনি। সেই নন্দীগ্রামবাসীও মমতার জয় অবশ্যম্ভাবী হতেই উল্লাসে মেতে ওঠে। সবুজ লাড্ডু একে-অপরকে খাইয়ে, সবুজ আবির মেখে উচ্ছ্বাসে মেতে ওঠে তৃণমূলের কর্মী-সমর্থকরা। তৃণমূল নেত্রীর জয় নিশ্চিত জানার পর উল্লাসে মেতে ওঠে একেবারে উত্তরবঙ্গ থেকে দক্ষিণবঙ্গ।
গতকাল সামশেরগঞ্জ ও জঙ্গিপুরেও উত্তাপ ছড়ায়। তবে ঘড়ির কাঁটা যত এগোতে থাকে, ততই বিজেপি প্রার্থীসহ সব বিরোধীকে পেছনে ফেলে এগিয়ে যান তৃণমূল প্রার্থীরা। সপ্তম রাউন্ড গণনা শেষেই বিজয় উৎসবে মেতে ওঠে জঙ্গিপুরবাসী। তৃণমূল প্রার্থী জাকির হোসেনের সমর্থকরা রাস্তায় নেমে উৎসবে মাতে। সামশেরগঞ্জেও তৃণমূল প্রার্থী আমিরুল ইসলামের সমর্থকরা আবির খেলায় মেতে ওঠে।
এদিকে লড়াইয়ের ময়দানে নেমে হুংকার দিলেও শেষ পর্যন্ত জয়ের মুখ দেখতে না পাওয়া প্রিয়াঙ্কা বলেন, ‘ভবানীপুর আমি ছাড়ব না।’ ২৪ হাজার ৩৯৬ ভোট পাওয়া এই বিজেপি নেত্রী উপনির্বাচনের ফল জানার পর মমতাকে ‘অভিনন্দন ও প্রণাম’ জানিয়ে অভিযোগ করেন, ‘এটা অস্বীকার করার জায়গা নেই যে নির্বাচনে কারচুপি হয়েছে।’ এর পরও ‘হার স্বীকার করে নিয়েছি। মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের বিরুদ্ধে আদালত বা নির্বাচন কমিশনের দ্বারস্থ হব না’, এমন মন্তব্য করেন তিনি। প্রিয়াঙ্কার এই মন্তব্য অত্যন্ত ইঙ্গিতপূর্ণ বলে মনে করা হচ্ছে।
এদিন প্রিয়াঙ্কা আরো বলেন, ‘আমিই ম্যান অব দ্য ম্যাচ। কারণ মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের নিজের এলাকায় আমি ভোটে লড়াই করেছি এবং ২৫ হাজারেরও বেশি ভোট পেয়েছি। আমি মানুষের সেবা করে যাব।’
এর আগে ভোটের দিনও কারচুপির অভিযোগ তুলেছিলেন প্রিয়াঙ্কা। গত বৃহস্পতিবার সকালে ১২৬ নম্বর বুথে ভোটগ্রহণ শুরু হতে দেরি হয়। সেই সময় প্রিয়াঙ্কা বলেন, ‘এই ওয়ার্ডের ১২৬ নম্বর বুথে ভোট শুরু করা যায়নি। এই এলাকা মদন মিত্রের এলাকা। তিনি বুথ দখল করতে চাইছেন।’ যদিও তাঁর অভিযোগ উড়িয়ে দিয়েছিল নির্বাচন কমিশন। জানানো হয়, মকপোলের জন্য ওই বুথে ভোট গ্রহণে দেরি হয়েছিল। ভোটের দিন আরো একটি বুথে গিয়ে ক্ষোভ উগরে দেন প্রিয়াঙ্কা। তিনি তখন অভিযোগ করেন, বহিরাগত নিয়ে এসে গণ্ডগোল সৃষ্টির চেষ্টা করছে তৃণমূল। তবে বেশিসংখ্যক ভোট পড়লে ফলাফল যাবে বিজেপির দিকেই, দাবি করেছিলেন তিনি।
সূত্র : আনন্দবাজার পত্রিকা, টাইমস অব ইন্ডিয়া।