Thursday , 21 November 2024
E- mail: news@dainiksakalbela.com/ sakalbela1997@gmail.com
ব্রেকিং নিউজ
ঠাকুরগাঁওয়ে এক রাতেই নির্মাণ হয়েছিলো জ্বীনের মসজিদ

ঠাকুরগাঁওয়ে এক রাতেই নির্মাণ হয়েছিলো জ্বীনের মসজিদ

  ঠাকুরগাঁও প্রতিনিধিঃ
ঠাকুরগাঁওয়ে ‘জ্বীনের মসজিদ’ নামে পরিচিতি পাওয়া ধর্মীয় স্থাপনাটি দেখতে আসেন অনেকে।
এই মসজিদটি নিয়ে কথিত আছে, কোনো এক অমাবস্যার রাতে জ্বীন-পরীরা এলাকার ওপর দিয়ে উড়ে যাওয়ার সময় এলাকাটিকে পছন্দ করে। তারপর মাটিতে নেমে এসে মসজিদ নির্মাণের কাজ শুরু করে, কিন্তু গম্বুজ তৈরির আগেই ভোর হয়ে যাওয়াতে কাজ অসমাপ্ত রেখে চলে যায়। ফলে গম্বুজ ছাড়া দাঁড়িয়ে থাকে মসজিদটি। স্থানীয়দের এমন বিশ্বাসের কারণে মসজিদটি সবার কাছে জ্বীনের মসজিদ নামে পরিচিত। অসম্পূর্ণ থেকে যায় মসজিদটি- ঠাকুরগাঁওয়ের প্রাচীন মসজিদ সম্পর্কে প্রচলিত আছে এমনই লোককাহিনী।
ঠাকুরগাঁও জেলাশহর থেকে উত্তর দিকে পঞ্চগড় মহাসড়ক ধরে দশ কিলোমিটার এগিয়ে গেলেই ভুল্লি বাজার। সেখান থেকেই প্রায় তিন কিলোমিটার পূর্বে বালিয়া ‘জিন মসজিদ’ নামে এই ঐতিহাসিক মসজিদটি অবস্থিত।
মসজিদটি দেখতে দেখতে একটু ভেতরে প্রবেশ করতেই হঠাৎ রমজান আলী নামে একজন বলে উঠলেন ভাই কাউকে খুঁজছেন। এরপর তার মুখ থেকে শোনা গেলো এই জিনের মসজিদের নামকরণের গল্পটি।
তিনি জানান, কোনো এক অমাবস্যার রাতে জিন-পরীরা বালিয়া ইউনিয়নের উপর দিয়ে উড়ে যাওয়ার সময় এলাকাটি তাদের পছন্দ হয়। তারপর জিন-পরীরা মাটিতে নেমে এসে মসজিদ নির্মাণের কাজ শুরু করে। কিন্তু গম্বুজ তৈরির আগেই ভোর হয়ে যাওয়াতে কাজ অসমাপ্ত রেখে চলে যায় তারা। ফলে গম্বুজ ছাড়া দাঁড়িয়ে থাকে অসাধারণ কারুকার্যময় এই মসজিদটি। জিন-পরীরা কিছু অংশ তৈরি করেছে বলে স্থানীয়দের কাছে এটি জিনের মসজিদ নামে পরিচিত।
মসজিদটি নির্মাণের সময়
মসজিদের গায়ে খোদাই করা সন অনুসারে এটি নির্মিত হয় ১৩১৭ বঙ্গাব্দে মানে ১৯১০ খ্রিষ্টাব্দে। আবার মসজিদের নির্মাতা মেহের বকস চৌধুরীর কবরেও তার মৃত্যুর সন খোদাই করা আছে ১৩১৭ বঙ্গাব্দ। মেহের বকসের মৃত্যুর সময়েই মসজিদটির বেশির ভাগ কাজ শেষ হয়ে যায়।
মসজিদের নির্মাণের ইতিহাস
জমিদার মেহের বকস চৌধুরী উনবিংশ শতাব্দীর শেষ ভাগে বালিয়াতে এক মসজিদ তৈরির পরিকল্পনা করেন। এই জন্য দিল্লির আগ্রা মতান্তরে মুর্শিদাবাদ থেকে স্থপতি আনা হয়। মুঘল স্থাপত্যের রীতি অনুযায়ী ডিজাইনকৃত এই মসজিদ তৈরি করাটা ছিল অনেক জটিল ও সময় সাপেক্ষ ব্যাপার। হঠাৎ প্রধান স্থপতির মৃত্যুর ফলে মসজিদ নির্মাণের কাজ থেমে যায়। মেহের বকস স্থানীয় কারিগরের সহায়তায় পুনরায় মসজিদ নির্মাণের কাজ শুরু করেন। কিন্তু স্থানীয় কারিগররা মসজিদের গম্বুজ নির্মাণে ব্যর্থ হন। ১৯১০ সালে মেহের বকস চৌধুরী মৃত্যুবরণ করেন।
এরপর মেহের বকসের ছোট ভাই কয়েক বছর পর মসজিদটি নির্মাণের জন্য আবারও উদ্যোগ নেন। কিন্তু নির্মাণ কাজ সমাপ্ত না করে তিনিও মৃত্যুবরণ করেন। ফলে মসজিদটি গম্বুজ ছাড়াই দাঁড়িয়ে থাকে।
অবশেষে মেহের বকস চৌধুরীর ছেলে মরহুম বসরত আলী চৌধুরীর কন্যা বাংলাদেশের বিশিষ্ট শিল্পপতি তসরিফা খাতুন ২০১০ সালে ইনস্টিটিউটের কারিগরি সহায়তায় বালিয়া মসজিদটির সংস্কার কাজ শুরু করে। একই সঙ্গে আর্কিটেক্ট সৈয়দ আবু সুফিয়ান কুশলের নকশায় নতুন ভাবে গম্বুজ নির্মাণ করা হয়।
মসজিদটির আকার-আয়তনঃ
মসজিদটি সমতল ভূমি হতে ৫ ফুট ৩ ইঞ্চি উঁচু প্লাটফর্মের ওপর পূর্ব-পশ্চিমে ৬২ ফুট ৬ ইঞ্চি ও উত্তর-দক্ষিণে ৬৯ ফুট ২ ইঞ্চি আয়তাকার কমপ্লেক্স অবস্থিত। আয়তাকার কমপ্লেক্সটি সিঁড়িসহ প্রবেশপথ, খোলা চত্বর ও মূলভবন বা নামাজঘর এই তিন অংশে বিভক্ত। এর মধ্যে মূল ভবনটি পূর্ব-পশ্চিমে ২৫ ফুট ১১ ইঞ্চি প্রশস্ত। প্লাটফর্ম হতে মসজিদটির ছাদ ১৭ ফুট উঁচু ।
মসজিদের ছাঁদে একই সাইজের তিনটি গম্বুজ ও আটটি মিনার আছে। যার মধ্যে চার কোণের চারটি মিনার বড় এবং বাকি চারটি ছোট। ভিত্তিসহ পুরো মসজিদটিই চুন-সুরকির মর্টার এবং হাতে পোড়ানো ইট দিয়ে নির্মিত। ইটে কোনো কাজ না থাকলেও মসজিদের দেয়ালের বিভিন্ন স্থানে ইট কেটে কলস, ঘণ্টা, ডিশ, বাটি, আমলকি,পদ্ম ইত্যাদি নকশা তৈরি করা হয়েছে ।
স্থানীয় বাসিন্দা সাদ্দাম চৌধুরী বলেন, ‘মসজিদটির বয়স প্রায় ১১০-১১২ বছরের মতো হবে। আমাদের এই এলাকাটি একটি উঁচু ও পিরামিড আকৃতির ছিল। বন জঙ্গলের মধ্যেই ছোট্ট একটি মসজিদ ঘর নির্মাণ করে এলাকার মানুষ নামাজ আদায় করত। এরপর মসজিদ কমিটির ও স্থানীয় সকলের সহযোগিতায় এই মসজিদের বাকি কাজ সম্পূর্ণ করা হয়।’
চুন সুরকির লাল ইটের নান্দনিক এই মসজিদটি দেখতে প্রতিদিন ভিড় করে অনেক মানুষ।
হাসানূরজামান অন্তু নামে একজন দর্শনার্থী বলেন, আমি ঠাকুরগাঁও থেকে এসেছি মসজিদটি দেখতে। মুসলিমের ইতিহাস কতটা সমৃদ্ধ ছিল তা এই মসজিদ দেখল বুঝা যায়। খুব ভালো লেগেছে।
রাজু ইসলাম রুবেল নামে আরেকজন দর্শনার্থী বলেন, “অনেকের কাছে শুনেছি পুরাতন মসজিদটির ব্যাপারে। আসব আসব বলে আসা হচ্ছিল না ফাইনালি আজ এসে খুব ভালো লাগছে। পাঁকা রাস্তা থেকে মসজিদের আসার রাস্তাটাও পাঁকা করা উচিত।”
এই মসজিদের ইমাম বলেন, “১১ বছর ধরে এখানে ইমামতি করছি। প্রতিদিন অনেক মানুষ আসে এবং তারা জানতে চায়। এটা আসলেই জ্বীনের মসজিদ কি না। এটি কোন জ্বীনের নয় এটা মানুষের ভ্রান্ত ধারণা
এ ব্যাপারে ঠাকুরগাঁও জেলা প্রশাসক  মাহবুবুর রহমান বলেন, ‘আমি এই ঐতিহাসিক বালিয়া মসজিদে গিয়েছিলাম। আসলেই মসজিদটি দেখতে অনেক সুন্দর। বিশেষ করে সেখানকার দেয়ালগুলোতে যে নকশা আঁকা আছে সেটি চমৎকার। আমরা ঠাকুরগাঁও বার্ড ক্লাবের সঙ্গে মিলে একটি ডকুমেন্টারি তৈরি করছি। সেখানে ঠাকুরগাঁও জেলার অনেক ঐতিহাসিক জিনিস আমার সকলের মাঝে তুলে ধরতে সক্ষম হয়েছি। সেই ডকুমেন্টারির মধ্যে আমরা এই মসজিদটিও রেখেছি।’
তিনি আরও জানান, বালিয়া মসজিদের ব্যাপারে কোনো রকমের সহযোগিতার প্রয়োজন হলে জেলা প্রশাসকের পক্ষ থেকে তা অবশ্যই করা হবে।

About Syed Enamul Huq

Leave a Reply