অনলাইন ডেস্ক:
বঙ্গবন্ধু হত্যার প্রতিবাদকারী প্রতিরোধ যোদ্ধাদের একটি দল দুই গ্রুপে ভাগ হয়ে যাত্রা করল ঢাকার উদ্দেশে। লক্ষ্য পুরান ঢাকার আগামসি লেনের একটি বাড়িতে হামলা করা, ওই বাড়িতে বসবাসকারী ব্যক্তিটিকে হত্যা করে তাঁর মাথা নিয়ে যাওয়া।
১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট বঙ্গবন্ধুকে হত্যার পর কিংবদন্তি মুক্তিযোদ্ধা কাদের সিদ্দিকীর নেতৃত্বে যে প্রতিরোধ যুদ্ধ শুরু হয়েছিল তার একটি ক্যাম্প ছিল
নেত্রকোনার সীমান্তবর্তী ভারতের বেতগড়া। সেখানেই সিদ্ধান্ত হয় অপারেশন চালিয়ে বঙ্গবন্ধুর খুনিচক্রের পৃষ্ঠপোষক খন্দকার মোশতাক আহমদের বাড়ি উড়িয়ে দেওয়া, তাঁকে হত্যা করে মাথা নিয়ে যাওয়ার।
এই ক্যাম্পের প্রতিরোধ যোদ্ধা অসিত সজল সরকার, মানু মজুমদার, মোতাহার হোসেন মোল্লা, চন্দন বিশ্বাস, জ্যোতিষ সরকার দুলাল ও নিরঞ্জন সরকার বাচ্চুর ওপর দায়িত্ব পড়ে অপারেশন পরিচালনার। এ জন্য বরাদ্দ করা হয় একটি করে সেভেন এমএম পিস্তল, অনেকগুলো বিধ্বংসী ৮৬ হ্যান্ডগ্রেনেড এবং দুটি নেপালি ভুজালি।
১৯৭৬ সালের আগস্টের কোনো একদিন তাঁরা এই অপারেশন পরিচালনার জন্য বেরিয়ে পড়লেন। দেশে তখন চলছে জিয়াউর রহমানের সামরিক শাসন। চারদিকে সেনাবাহিনীর কড়া নজরদারি।
অস্ত্রগুলো ঢাকায় নিয়ে আসার দায়িত্ব পড়ল মানু মজুমদার, মোতাহার হোসেন মোল্লা ও চন্দন বিশ্বাসের ওপর। অস্ত্র ব্রিফকেস ও থলিতে ভরে তাঁরা যাত্রা করলেন নেত্রকোনা ও ময়মনসিংহ থেকে ট্রেনে করে। আরেক গ্রুপ অসিত সজল সরকার, জ্যোতিষ সরকার দুলাল ও নিরঞ্জন সরকার বাচ্চু যাত্রা করলেন সুনামগঞ্জের টাঙ্গুয়ার হাওর দিয়ে। নজরদারি এড়িয়ে নিরাপদেই তাঁরা ঢাকায় পৌঁছান। একসঙ্গে মিলিত হলেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের জগন্নাথ হলে। কলাবাগানে বসবাসকারী মুক্তিযোদ্ধা বজলুর রহমান, যিনি বঙ্গবন্ধুর ব্যক্তিগত নিরাপত্তা বাহিনীর সদস্য ছিলেন, তিনি এগিয়ে এলেন সব রকম সহযোগিতা দিতে। তিনি যোগাযোগ করেন কলাবাগানের যুবলীগ নেতা মো. রাজুর সঙ্গে। রাজুর শ্বশুরবাড়ি ছিল আগামসি লেনের খন্দকার মোশতাক আহমদের বাড়ির ঠিক উল্টো দিকে। রাজুকে সঙ্গে নিয়ে প্রতিরোধ যোদ্ধারা পুরান ঢাকায় গিয়ে মোশতাকের বাড়িটি ভালো করে রেকি করে আসেন।
তাঁরা লক্ষ করলেন, মোশতাকের বাড়িতে তখন সাবেক রাষ্ট্রপতি হিসেবে কড়া পুলিশ প্রহরা রয়েছে। বাসার প্রবেশপথে রয়েছে দুটি কলাপসিবল গেট। এগুলো পেরিয়ে অপারেশন চালাতে হবে।
অপারেশনের তারিখ ও সময় চূড়ান্ত করা হয়। ২২ গ্রেনেড জড়ো করা হয় বজলুর রহমানের বাসায়। অপারেশনের ঠিক দুই দিন আগে আকস্মিক পুলিশ এসে কলাবাগানে বজলুর রহমানের বাড়ি ঘেরাও করে। সে বাড়িতে তখন অসিত সজল সরকার, মানু মজুমদার ও জ্যোতিষ সরকার দুলাল অবস্থান করছিলেন। পুলিশের উপস্থিতি টের পেয়ে জ্যোতিষ সরকার দুলাল দেয়াল টপকে পালিয়ে যেতে পারলেও ধরা পড়েন সজল সরকার ও মানু মজুমদার। বাসা থেকে গ্রেনেডগুলোও উদ্ধার করে নিয়ে যায় পুলিশ। পরে বজলুকে আটক করা হয় জিগাতলার এক কৃষক লীগ নেতার বাড়ি থেকে। সজল, মানু ও বজলুকে ধানমণ্ডি থানা পুলিশ ১৭ দিনের রিমান্ডে নিয়ে জিজ্ঞাসাবাদ চালায়, নানা রকম নির্যাতন করে।
অসিত সজল সরকার বর্তমানে ঢাকায় আইনপেশায় নিয়োজিত। মানু মজুমদার এখন নেত্রকোনা-১ আসন থেকে নির্বাচিত সংসদ সদস্য। বজলুর রহমান প্রয়াত হয়েছেন। তাঁর স্ত্রী শিরিন আহমেদ বর্তমানে জাতীয় সংসদের মনোনীত আসনের এমপি।
অসিত সজল সরকার বলেন, ‘বঙ্গবন্ধুকে হত্যার ঘটনাটি কোনোভাবেই মেনে নিতে পারিনি বলেই জীবনের ঝুঁকি নিয়েই প্রতিরোধ যুদ্ধে যুক্ত হই। আমাদের মতো হাজারো তরুণ এই প্রতিবাদে যুক্ত হয়ে নির্যাতিত হয়েছে, সর্বস্ব হারিয়েছে।’