অনলাইন ডেস্ক:
দেশে করোনার সংক্রমণের সংকটকালে সুরক্ষা ও চিকিৎসার নামে শুরু হওয়া জালিয়াতি এখনো চলছে। রাজধানীতে রিজেন্ট হাসপাতালের সাহেদ, জেকেজি হেলথকেয়ারের ডা. সাবরিনা, আরিফসহ সারা দেশে শতাধিক লোককে গ্রেপ্তারের পর কমে যায় প্রতারণা। তবে সম্প্রতি সংক্রমণ ব্যাপকভাবে বেড়ে যাওয়ায় ফের সক্রিয় হয়ে উঠেছে বেশ কিছু চক্র। দেশে কঠোর লকডাউন বাস্তবায়নে পুলিশ, র্যাব ও প্রশাসন ব্যস্ত থাকছে। হাসপাতালে করোনা রোগীর চাপ এবং টিকাদান কর্মসূচি নিয়ে ব্যস্ত স্বাস্থ্য বিভাগ। নজরদারি ও অভিযানে ভাটা পড়েছে। আর এই সুযোগে চলছে নিষ্ঠুর জালিয়াতির কাণ্ড।
কিছু অভিযোগের সূত্রে অভিযান বা তদন্ত হলে উঠে আসছে ভয়াবহ চিত্র। হাসপাতালে করোনা চিকিৎসার অনুমোদন না থাকলেও রোগী ভর্তি করে মনগড়া চিকিৎসা দেওয়া হচ্ছে। হাসপাতালে শয্যা না পাওয়া রোগীর স্বজনদের জিম্মি করে তাদের কাছ থেকে ইচ্ছামতো টাকা আদায় করা হচ্ছে। টাকার বিনিময়ে করোনা পরীক্ষার ভুয়া রিপোর্টও দিচ্ছে অর্ধশত চক্র। মাস্ক, হ্যান্ড স্যানিটাইজারসহ সুরক্ষাসামগ্রীর চাহিদা বাড়ায় নকল কারবারিরা এখন সক্রিয়।
করোনার চিকিৎসাসংক্রান্ত অনিয়মের তথ্য পাওয়ার পর এসব অপকর্ম প্রতিরোধে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় গতকাল মঙ্গলবার দুটি কমিটি গঠন করেছে। একটি কমিটি কেন্দ্রীয় পর্যায়ে এবং অন্য কমিটি জেলা সিভিল সার্জনের অধীনে এলাকাভিত্তিক নজরদারি করবে।
এ ব্যাপারে স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের পরিচালক (হাসপাতাল) ড. ফরিদ উদ্দিন মিয়া বলেন, ‘করোনার শুরু থেকে চিকিৎসা ও পরীক্ষায় বিভিন্ন অভিযোগে শতাধিক প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে। অনেক ক্ষেত্রে র্যাব-পুলিশের অভিযানের মাধ্যমেও ব্যবস্থা নেওয়া হয়। ঢাকায় ২০-২৫টি প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে। সম্প্রতি আটটি হাসপাতাল ও পরীক্ষা কেন্দ্রের কার্যক্রম বন্ধ করেছে।’
র্যাবের আইন ও গণমাধ্যম শাখার পরিচালক কমান্ডার খন্দকার আল মাঈন বলেন, ‘করোনা সনদ জালিয়াতি, চিকিৎসা বা সুরক্ষাসামগ্রী নিয়ে জালিয়াতির ব্যাপারে আমরা কোনো তথ্য পেলে তা স্বাস্থ্য অধিদপ্তর বা মন্ত্রণালয়কে অবহিত করি। তাদের নির্দেশনা অনুযায়ী সমন্বয় করে অভিযান চালানো যেতে পারে।’ তিনি উদাহরণ দিয়ে বলেন, সম্প্রতি চারটি হাসপাতালে স্বাস্থ্য অধিদপ্তর করোনা পরীক্ষা বন্ধ ঘোষণা করেছে। এটি ছিল একটি সমন্বিত কাজ। তাঁদের নজরদারি অব্যাহত আছে।
গত বছরের ৬ জুলাই উত্তরায় রিজেন্ট হাসপাতালে র্যাবের অভিযানের পর জানা যায়, করোনা পরীক্ষা না করে ফলাফল দিয়ে এবং চিকিৎসার নামে প্রতারণা করে অন্তত তিন কোটি টাকা হাতিয়ে নিয়েছেন ওই হাসপাতালটির মালিক সাহেদ। আলোচিত এই প্রতারকের বিরুদ্ধে এক বছরে ১৮টি মামলা হয়েছে, যার ১০টির অভিযোগপত্র আদালতে দাখিলও করা হয়েছে। একই সময় জেকেজি হেলথ কেয়ারের ব্যবস্থাপনা পরিচালক আরিফ চৌধুরীসহ কয়েকজনকে গ্রেপ্তার করে পুলিশ। ১২ জুলাই গ্রেপ্তার করা হয় জেকেজির সঙ্গে সম্পৃক্ত জাতীয় হৃদরোগ ইনস্টিটিউটের তৎকালীন চিকিৎসক সাবরিনাকে।
র্যাব সদর দপ্তরের তথ্য মতে, গত বছরের ৬ এপ্রিল থেকে গত সোমবার পর্যন্ত করোনাসংক্রান্ত প্রতারণাসহ বিভিন্ন অভিযোগে ১৯০টি মামলা করেছে র্যাব। ভ্রাম্যমাণ আদালতের মাধ্যমে কারাদণ্ড দেওয়া হয় ৩৪ জনকে। মোট জরিমানা করা হয়েছে দুই কোটি ৪৮ লাখ ১৮ হাজার টাকা। করোনার আতঙ্ককে পুঁজি করে সম্প্রতি আবার নিষ্ঠুর প্রতারণার ফাঁদ পেতে বসেছে অনেক চক্র। সর্বশেষ গত রবিবার ডা. ইশরাত রফিক ঈশিতা নামের এক চিকিৎসককে গ্রেপ্তার করেছে র্যাব।
গত ২২ জুলাই উত্তরার গরীবে নেওয়াজ এভিনিউর শিন-শিন জাপান হাসপাতালে ছুরি নিয়ে নার্স-বয়দের ওপর হামলা চালান সবুজ পিরিস নামের এক রোগী। এর জের ধরে তাঁকে পিটিয়ে চিকিৎসা না দিয়ে ১০ ঘণ্টা বেঁধে রাখা হয়। পরে ইউনাইটেড হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় ২৬ জুলাই মারা যান সবুজ। তাঁর শ্বশুর জ্যোতি কস্তা বলেন, চিকিৎসার নামে তাঁদের কাছ থেকে পাঁচ লাখ ৪০ হাজার টাকা আদায় করা হয়েছে। হাসপাতাল থেকে ৮০ হাজার ৮০০ টাকা মূল্যের ইনজেকশনও দেওয়া হয়।
এ ঘটনায় স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের ‘বেসরকারি কভিড-১৯ হাসপাতাল মনিটরিং কমিটি’র তদন্তদল শিন-শিন জাপান হাসপাতাল পরিদর্শন করে উদ্বেগজনক পরিস্থিতি দেখতে পায়। কভিড-১৯ চিকিৎসার অনুমোদন নেই হাসপাতালটির। সেন্ট্রাল অক্সিজেন সরবরাহব্যবস্থা, ভেন্টিলেটর ও হাই ফ্লো ন্যাজাল ক্যানুলা ছাড়াই কভিড রোগীদের জন্য আইসিইউ ইউনিট চলছিল। করোনা রোগীদের তথ্য গোপন করে প্রয়োজনীয় চিকিৎসক, নার্স ও স্টাফ ছাড়াই দেওয়া হয় চিকিৎসা। স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের নির্দেশনা অনুসরণ না করে দেওয়া ইচ্ছামতো বিল আদায় করা হয়। হাসপাতালটির লাইসেন্স বাতিলসহ শাস্তির সুপারিশ করে প্রতিবেদন দেওয়া হয়েছে। উত্তরা এলাকার ‘রেডিক্যাল হাসপাতাল’ এবং ‘আল আশরাফ হাসপাতালে’ গিয়েও একই চিত্র দেখেছে তদন্তদল। এই তিনটি হাসপাতালে সম্প্রতি অন্তত ১০০ করোনা রোগী মারা গেছে। এই মৃত্যুর কোনো তথ্য দেওয়া হয়নি স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের কভিড সেলে।
স্বাস্থ্য অধিদপ্তর জানায়, গত ১০ জুন বিদেশগামী যাত্রীদের ভুয়া করোনা রিপোর্ট দেওয়ার প্রমাণ পেয়ে সিএসবিএফ হেলথ সেন্টার, স্টিমজ হেলথ কেয়ার, আল জামী ডায়াগনস্টিক সেন্টার ও মেডিনোভা মেডিক্যাল সার্ভিসেস লিমিটেডের মিরপুর শাখার পরীক্ষা কার্যক্রম স্থগিত করা হয়। একই সঙ্গে মহাখালীতে ইন্টারন্যাশনাল মেডিক্যাল কলেজ পরিচালিত নমুনা সংগ্রহের বুথের কার্যক্রম স্থগিত করা হয়েছে। গত সোমবার বনানীর প্রাভা হেলথকেয়ার নামের আরেকটি প্রতিষ্ঠানের কার্যক্রম বন্ধ করা হয়েছে।
এ ছাড়া ভুয়া রিপোর্ট দেওয়ার অভিযোগে জুন মাসে ১১ জনকে গ্রেপ্তার করেছে র্যাব ও পুলিশ। জিজ্ঞাসাবাদে সারা দেশে বিদেশগামী যাত্রীদের নেগেটিভ সনদ নেওয়ার অর্ধশত চক্র আছে বলে তথ্য পাওয়া গেছে।
গত ১৫ এপ্রিল মোহাম্মদপুরের লালমাটিয়া ও বনানীতে তিন প্রতিষ্ঠানে অভিযান চালিয়ে প্রায় চার ট্রাক অনুমোদনহীন, মেয়াদোত্তীর্ণ ও ভেজাল টেস্ট কিট, রি-এজেন্ট জব্দ করে র্যাব। গ্রেপ্তার করা হয় ৯ জনকে।