Friday , 22 November 2024
E- mail: news@dainiksakalbela.com/ sakalbela1997@gmail.com
ব্রেকিং নিউজ
হেলেনা জাহাঙ্গীরের আর্থিক দুর্নীতির খোঁজে গোয়েন্দারা
--ফাইল ছবি

হেলেনা জাহাঙ্গীরের আর্থিক দুর্নীতির খোঁজে গোয়েন্দারা

অনলাইন ডেস্ক:

আওয়ামী লীগের মহিলাবিষয়ক উপকমিটির সদ্যঃসাবেক সদস্য হেলেনা জাহাঙ্গীরের বিতর্কিত কর্মকাণ্ডের পাশাপাশি আর্থিক দুর্নীতির খোঁজ নিতে শুরু করেছেন সরকারের বিভিন্ন গোয়েন্দার সদস্যরা। এরই মধ্যে তাঁর বিরুদ্ধে পাওয়া কিছু দুর্নীতির মৌখিক তথ্য যাচাই-বাছাই চলছে জানিয়ে এক গোয়েন্দা কর্মকর্তা বলেন, দলের নাম ভাঙিয়ে তিনি বিভিন্ন ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠানের কাছ থেকে আর্থিক সুবিধা নিয়েছেন বলে অভিযোগ পাওয়া গেছে।

হেলেনা জাহাঙ্গীরের চলাফেরার ওপরও নজরদারি চলছে। দলের ভাবমূর্তি নষ্ট করে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ফেসবুকে দেওয়া নানা সময়ে দেওয়া তাঁর বক্তব্য খোঁজা হচ্ছে। সরকারবিরোধী কোনো গোষ্ঠীর সঙ্গে তাঁর যোগাযোগ আছে কি না, বিশেষ করে বিএনপি, জামায়াত-শিবিরসহ দেশের বাইরের কোনো সংগঠনের সঙ্গে যোগসূত্র থাকার তথ্য জানার চেষ্টা চলছে।

যেভাবে আলোচনায় : একাধিক গোয়েন্দা সংস্থার ঊর্ধ্বতনদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, হেলেনা জাহাঙ্গীর সম্প্রতি ‘বাংলাদেশ আওয়ামী চাকরিজীবী লীগ’ নামে একটি সংগঠন গঠনের ঘোষণা দেন। তিনি নিজেকে সংগঠনটির সভাপতি ও মাহবুব মনিরকে সাধারণ সম্পাদক ঘোষণা করেন। দুই দিন ধরে এই সংগঠনে জেলা-উপজেলা ও বিদেশ শাখায় সভাপতি-সাধারণ সম্পাদক মনোনয়ন দেওয়া হচ্ছে জানিয়ে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে একটি পোস্টার প্রকাশ করা হয়। এ ঘটনার পর ফেসবুকে ব্যাপক সমালোচনার মুখে পড়েন তিনি। বিএনপি চেয়ারপারসন খালেদা জিয়া ও জাতীয় পার্টির চেয়ারম্যান হুসেইন মুহম্মদ এরশাদ ছাড়াও অনেক আলোচিত-সমালোচিত ব্যক্তির সঙ্গে তোলা ছবি ফেসবুকে পোস্ট দিয়ে অনেকেই তাঁর রাজনৈতিক আদর্শ নিয়ে প্রশ্ন তোলেন।

একজন গোয়েন্দা কর্মকর্তা বলেন, হেলেনা জাহাঙ্গীরের বিরুদ্ধে দলের ভাবমূর্তি নষ্ট, দুর্নীতির নানা ধরনের মৌখিক তথ্য পাওয়া গেছে। তিনি চাকরিজীবী লীগে দলীয় পোস্ট দেওয়ার নাম করে বিভিন্ন লোকের কাছ থেকে বিপুল অঙ্কের টাকা হাতিয়ে নিয়েছেন বলে অভিযোগ পাওয়া গেছে। এসব অভিযোগ যাচাই-বাছাই চলছে। প্রয়োজনে তাঁকে আটক করে জিজ্ঞাসাবাদ করা হতে পারে বলে জানান এই গোয়েন্দা কর্মকর্তা।

আওয়ামী লীগের মহিলাবিষয়ক উপকমিটির সদস্য পদ থেকে হেলেনা জাহাঙ্গীরকে অব্যাহতি দিয়ে গতকাল রবিবার সংবাদ বিজ্ঞপ্তি দেওয়া হয়েছে। উপকমিটির সদস্যসচিব ও আওয়ামী লীগের মহিলাবিষয়ক সম্পাদক মেহের আফরোজের সই করা ওই বিজ্ঞপ্তিতে বলা হয়, হেলেনা জাহাঙ্গীর আওয়ামী লীগের মহিলাবিষয়ক উপকমিটির সদস্য ছিলেন। কিন্তু সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে প্রচারিত তাঁর সাম্প্রতিক কর্মকাণ্ড সংঘটনের নীতিবহির্ভূত হওয়ায় আওয়ামী লীগের মহিলাবিষয়ক উপকমিটির সদস্য পদ থেকে তাঁকে অব্যাহতি দেওয়া হয়েছে।

এ ব্যাপারে হেলানা জাহাঙ্গীর বলেন, ‘আমাকে অব্যাহতি দেওয়ার বিষয়টি আমার জানা নেই। আমি চিঠিও পাইনি বা কেউ আমাকে ফোন করেও জানায়নি।’

কুমিল্লা উত্তর জেলা আওয়ামী লীগের উপদেষ্টার পদ থেকেও বহিষ্কার করা হয়েছে হেলেনাকে। বিভিন্ন বিতর্কিত মন্তব্য ও কর্মকাণ্ডের কারণে তাঁকে বহিষ্কারের নীতিগত সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে বলে জানিয়েছেন আওয়ামী লীগের একাধিক কেন্দ্রীয় নেতা।

কুমিল্লা উত্তর জেলা আওয়ামী লীগের দপ্তর সম্পাদক সাইফুল ইসলাম রাজীব জানান, গত ১৬ জুন হেলেনাকে দল থেকে অব্যাহতি দেওয়ার সুপারিশ করেন কমিটির সভাপতি ও সাধারণ সম্পাদক। তাঁদের স্বাক্ষরিত চিঠির কপি তাঁকেও পাঠানো হয়েছে।

আত্মীয়তার সুবাদেই পদ-পদবি : রাজনীতি না করেও ‘জয়যাত্রা ফাউন্ডেশন’-এর কর্ণধার হেলেনা জাহাঙ্গীরের আওয়ামী লীগে পদ-পদবি জুটেছিল অনেকটা আত্মীয়তার সুবাদে। সূত্র জানায়, আওয়ামী লীগ কেন্দ্রীয় কমিটির বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিষয়ক সম্পাদক ইঞ্জিনিয়ার মো. আব্দুস সবুর তাঁর খালাতো ভাই, কুমিল্লা উত্তর জেলা আওয়ামী লীগ সভাপতি মু. রুহুল আমিন তাঁর জার (ভাশুরের স্ত্রীর) বড় ভাই। এ ছাড়া মুন্সীগঞ্জের গজারিয়ার আওয়ামী লীগ নেতা ও ইউপি চেয়ারম্যান কাইয়ূম হক তাঁর মামা।

কুমিল্লার দাউদকান্দি উপজেলার সদর উত্তর ইউনিয়নের কদমতলী গ্রামের ক্যাপ্টেন আব্দুল হক শরীফের দুই ছেলে ও দুই মেয়ের মধ্যে হেলেনা আক্তার দ্বিতীয়। ১৯৯০ সালে জেলার বুড়িচং উপজেলার চাঁদসার গ্রামের গার্মেন্ট ব্যবসায়ী মো. জাহাঙ্গীর কবিরের সঙ্গে বিয়ের পর তিনি হেলেনা জাহাঙ্গীর নাম নেন। স্বামীর ব্যবসা দেখার পাশাপাশি নিজেও হয়ে ওঠেন একজন নারী উদ্যোক্তা। তাঁর স্বামী কোনো রাজনৈতিক সংগঠনের সঙ্গে যুক্ত নন।

রাজধানীর অনেক নারী উদ্যোক্তাকে নিয়ে গঠিত ‘ইনার হুইল ক্লাব’-এর সদস্য হয়ে হেলেনা সখ্য গড়ে তোলেন বিভিন্ন রাজনৈতিক মহলে। ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশন (ডিএনসিসি) নির্বাচনে প্রয়াত আনিসুল হকের সঙ্গে কাজ করেন। সেখান থেকেই মূলত তিনি আলোচনায় আসেন। পরবর্তী সময়ে আওয়ামী লীগের নানা পেশাজীবী সংগঠনের সঙ্গে ওঠাবসা করতে দেখা যায় তাঁকে। এ ছাড়া ব্যবসায়ীদের শীর্ষ সংগঠন এফবিসিসিআইয়ের নির্বাচনে তিনি সরকার সমর্থক প্যানেল থেকে নির্বাচনও করেন। মাত্র কয়েক বছরের মধ্যে বাগিয়ে নেন কেন্দ্রীয় ও জেলা আওয়ামী লীগের পদ-পদবি। কুমিল্লা-৫ আসনের সাবেক সংসদ সদস্য অ্যাডভোকেট আবদুল মতিন খসরুর মৃত্যুতে ওই আসন থেকে নির্বাচন করার জন্য আওয়ামী লীগের মনোনয়নপত্রও সংগ্রহ করেছিলেন। হেলেনা জাহাঙ্গীর নিজেকে আইপি টিভি ওনার্স অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের সভাপতি হিসেবেও পরিচয় দেন।

বিএনপি চেয়ারপারসন খালেদা জিয়া ও জাতীয় পার্টির চেয়ারম্যান মরহুম হুসেইন মুহম্মদ এরশাদের সঙ্গে পৃথক দুটি ছবি সম্প্রতি ফেসবুকে ভাইরাল হয়। ছবি দুটি সম্পর্কে হেলেনা জাহাঙ্গীর বলেন, ২০০০ সালে বিএনপি নেতা ব্যারিস্টার মওদুদ আহমদের ছেলের বিয়েতে তাঁদের সংগঠন ‘ইনার হুইল ক্লাব’কে দাওয়াত করা হয়েছিল। সেখানে গিয়ে ওই ছবি তোলা হয়েছিল। আর ২০১৬ সালের নভেম্বরে তাঁর ছেলের বিয়েতে হুসেইন মুহম্মদ এরশাদ অতিথি হিসেবে আসার পর ছবি তোলেন। তখন কোনো রাজনীতিতে সম্পৃক্ত ছিলেন না বলে দাবি করে হেলেনা জাহাঙ্গীর বলেন, ‘২০১৫ সালে ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশন নির্বাচনে তৎকালীন আওয়ামী লীগ মেয়র প্রার্থী আনিসুল হকের সঙ্গে কাজ করে আওয়ামী লীগের সঙ্গে পথচলা শুরু করি। ২০১৯ সালে আওয়ামী লীগের মহিলাবিষয়ক উপকমিটির সদস্য এবং ২০২০ সালে কুমিল্লা উত্তর জেলা আওয়ামী লীগের পূর্ণাঙ্গ কমিটির উপদেষ্টা হই।’

দেড় বছরেই শেষ দরিদ্র ভাতা : নাম প্রকাশ না করার শর্তে হেলেনা জাহাঙ্গীরের স্বামীর এলাকার বাসিন্দারা জানায়, গ্রামে তেমন না এলেও জাহাঙ্গীর কবির বিভিন্ন সামাজিক ও ধর্মীয় প্রতিষ্ঠানে সহযোগিতা করে আসছেন। জয়যাত্রা ফাউন্ডেশনের নামে ২০১৮ সাল থেকে ২৫ জন বৃদ্ধকে মাসিক এক হাজার টাকা করে ভাতা দিতেন হেলেনা জাহাঙ্গীর। প্রায় দেড় বছর চলার পর তা বন্ধ হয়ে যায়।

এ বিষয়ে হেলেনা জাহাঙ্গীর বলেন, ‘জয়যাত্রা ফাউন্ডেশন দরিদ্র ভাতা, বয়স্ক ভাতা ও দেশের দুর্যোগে অসহায়দের পাশে দাঁড়ায়। প্রতি মাসে আমরা ৬০ জনকে বৃদ্ধ ভাতা দিয়ে আসছি।’

আপনার স্বামীর গ্রামে ২৫ জনকে ভাতা দিতেন এবং তা এক বছর ধরে বন্ধ আছে জানালে তিনি বলেন, ‘সেখানে (স্বামীর গ্রামে) ৩০ জনকে দিয়েছি, দাউদকান্দিতে ১০ জন, রংপুরে ২০ জনকে দিয়েছি। ফান্ড না থাকায় তা এখন বন্ধ আছে।’

কুমিল্লা উত্তর জেলা আওয়ামী লীগ সভাপতি মু. রুহুল আমিন বলেন, আত্মীয়তার সুবাদে নয়, মূলত স্থানীয়দের অনেকের সুপারিশেই হেলেনাকে নেওয়া হয়েছিল। কারা সুপারিশ করেছিলেন এমন প্রশ্নে তিনি বলেন, ‘এত কিছু মনে নেই, তবে আধাঘণ্টার জন্য আওয়ামী লীগ করেও অনেকে পদ-পদবি পায়, আবার নির্বাচনও করতে আসে, যেটা অবশ্যই দুঃখজনক।’

ফেসবুকে যা বললেন : হেলেনা জাহাঙ্গীর তাঁর ফেসবুক পেজে একটি প্রতিক্রিয়া জানিয়ে সমালোচনার বিষয়ে বলেছেন, ‘আমি দলকে ভালোবাসি, আমি দলের সব সিদ্ধান্তকে সম্মান জানাই, আমি যদি কোনো ভুল করে থাকি তাহলে নেত্রী আমাকে সাজা দেবেন এবং পরক্ষণে আগলে নেবেন। আশা করি আমরা কেউই ভুলের ঊর্ধ্বে নই।’

তিনি বলেন, ‘আমার আওয়ামী চাকরিজীবী লীগের সঙ্গে কোনো সম্পৃক্ততা ছিল না, এখনো নেই। আমি কোথাও কি লিখেছি যে আমি আওয়ামী চাকরিজীবী লীগের সঙ্গে সম্পৃক্ত? আমাকে প্রস্তাব দিয়েছে সভাপতি হতে। আমি বলেছি মাননীয় প্রধানমন্ত্রী অনুমোদন দিলে আমি সভাপতি হব। এর বেশি কিছু আমার জানা নেই।’

আগের বক্তব্যের জন্য ক্ষমা প্রার্থনা : এর আগে দেশে ‘লকডাউন’ চলা অবস্থায় কারখানা চালুর সমালোচনাকারীদের তুলাধোনা করেন তিনি। তবে গতকাল সুর বদলে ক্ষমা চেয়েছেন পোশাক কারখানার মালিক হেলেনা জাহাঙ্গীর। ফেসবুক লাইভে এসে কারখানা চালু রাখার পক্ষে আগের দেওয়া বক্তব্যের জন্য ক্ষমা চান তিনি।

হেলেনা বলেন, ‘আমার তিনটি কারখানা রয়েছে। আমি সেগুলো বন্ধ রাখার সিদ্ধান্ত নিয়েছি। আগে যেহেতু বন্ধের সিদ্ধান্ত হয়নি তাই খোলা রাখার পক্ষে বলেছিলাম। এটা নিয়ে অনেকেই আমাকে ভুল বুঝেছেন। সরকার যত দিন চাইবে, তত দিন কারখানা বন্ধ থাকবে।’

তবে তিনি এ-ও বলেন, ‘জনগণের খাবারটা কে দেবে? আপনারা যাঁরা বড় বড় কথা বলেন সোশ্যাল মিডিয়ায়, আপনারা কি জনগণের খাবার দিচ্ছেন? আপনারা ১০টা শ্রমিকের খাবার দেবেন না, ১০০টা শ্রমিকের বেতন নিশ্চয়ই দেবেন না। সো, আপনারা বড় কথা বলতে আসবেন না।’

জানা গেছে. গত বছর এক ইফতার মাহফিলে জন্মদিন উদযাপন ও রোমান্টিক গান পরিবেশন করতে গিয়েও সমালোচনার মুখে পড়তে হয়েছিল হেলেনাকে। একই বছর দেশের প্রবীণ একজন টেলিভিশন মালিকের সঙ্গে গানের অফার পেয়েছেন বলে ফেসবুকে পোস্ট দেন হেলেনা। পরে এ জন্য তাঁকে বেকায়দায় পড়তে হয়েছিল বলে গণমাধ্যমের খবর। মাঝেমধ্যেই তাঁকে ফেসবুক লাইভে এসে বিভিন্ন বিষয়ে কথা বলতে দেখা যায়। তবে এর আগেও ফেসবুক লাইভে ‘ঝামেলার জন্য’ পরে ক্ষমা চেয়েছেন তিনি।

About Syed Enamul Huq

Leave a Reply