Sunday , 24 November 2024
E- mail: news@dainiksakalbela.com/ sakalbela1997@gmail.com
ব্রেকিং নিউজ
বিদায়, হৃদয়জয়ী দিলীপ কুমার
--ফাইল ছবি

বিদায়, হৃদয়জয়ী দিলীপ কুমার

বিনোদন ডেস্ক:

১৯৬১ সালের কথা। পঞ্চম শ্রেণির বৃত্তি পরীক্ষা দিতে প্রাইমারির শিক্ষক মিয়া আব্দুল মান্নাফ স্যার সদরে নিয়ে এলেন আমাদের। এখানে কয়েক দিন থাকতে হবে, কেননা কেন্দ্রের কাছাকাছি থেকেই পরীক্ষা দিতে হবে। এর মধ্যে একদিন শহরের দেয়ালে সিনেমার পোস্টারে চোখ আটকে গেল। সিনেমার নাম ‘আন’। এক সুদর্শন যুবক আমাকে দুর্নিবার আকর্ষণে টেনে নিল। সব পরীক্ষা শেষ হওয়ার পর বুঝলাম শুধু আমি না, আমার স্কুলের স্যারও এই যুবকের প্রতি আকৃষ্ট আরো আগে থেকেই। পরীক্ষা শেষ হলো যেদিন, আমাদের কয়েকজনকে নিয়ে স্যার শহরের আশা সিনেমা হলে গেলেন। সেদিন পুরোটা সময় পর্দায় দিলীপ কুমার আমাকে রোমাঞ্চিত করলেন। দিলীপ কুমার নাচছেন-গাইছেন, এক ছাদ থেকে আরেক ছাদে লাফিয়ে যাচ্ছেন—আর আমি ভাবলাম, এটাই তো আমি।

সদ্য কৈশোরে পা দেওয়া দিলীপ কুমারকে সামনাসামনি দেখলাম ১৯৯৫ সালে। দেখা হলো ঢাকায়, এফডিসিতে। অবশ্য তত দিনে তিনি আমার জীবনের প্রতিটি ক্ষেত্রে মিশে গেছেন। ১৯৬১ সালের পর ভারত-পাকিস্তান যুদ্ধ, একাত্তরে মুক্তিযুদ্ধের মধ্য দিয়ে বাংলাদেশ স্বাধীন হলো। এরপর ১৯৭৬ সালে দিলীপ কুমার আমার জীবনে ফিরে এলেন অন্যভাবে, তাঁকে নতুনভাবে’আবিষ্কার করলাম নীলক্ষেতের ফুটপাতে। আলমগীর কবিরের ফিল্ম ইনস্টিটিউটে ভর্তি হওয়ার পর চলচ্চিত্র নিয়ে যা পাচ্ছি, তা-ই পড়ছি। তুমুল আগ্রহ নিয়ে পড়ি, নীলক্ষেতে যাই, চলচ্চিত্র নিয়ে বই পেলে কিনে ফেলি। একদিন এভাবেই ফুটপাতে খুঁজে পেলাম ‘আর পাব না ফিরে’ বইটি। এটি দিলীপ কুমারের আত্মজীবনীমূলক অনুবাদ বই। এই বই আমাকে নতুন এক দিলীপ কুমারকে চেনাল। আমি জানলাম তাঁর আসল নাম মুহাম্মদ ইউসুফ খান, জানলাম তাঁর জন্ম পাকিস্তানে। জানলাম ফল বিক্রেতা থেকে অভিনেতা হয়ে ওঠার গল্প।

বাঙালিদের প্রতি দিলীপ কুমার বরাবরই দুর্বল ছিলেন। হয়তো কৃতজ্ঞতাবোধ থেকেই। দিলীপ কুমারের প্রথম চলচ্চিত্র ‘জোয়ার ভাটা’। এই ছবির প্রযোজনা প্রতিষ্ঠান ‘বোম্বে টকিজ’-এর কর্ণধার হিমাংশু রায় ও দেবিকা রানী। হিমাংশুর বাড়ি মানিকগঞ্জে। সেই কৃতজ্ঞতাবোধ দেখেছিলাম যখন তিনি বাংলাদেশে আসেন। দিলীপ কুমারে বাংলাদেশিরা এরপর মাতে ১৯৮১ সালে। বাংলাদেশে আন্তর্জাতিক চলচ্চিত্র উৎসব উপলক্ষে বিটিভিতে দেখানো হবে ‘গঙ্গা যমুনা’। দেশজুড়ে হৈচৈ পড়ে গেল।

‘জোয়ার ভাটা’ প্রথম সিনেমা হলেও ১৯৪৬ সালে মুক্তি পাওয়া ‘মিলন’ ছবিটি তাঁকে তারকা বানিয়ে দেয়। মিলন ছবিটি রবীন্দ্রনাথের নৌকাডুবির হিন্দি সংস্করণ। আবার দেবদাসের অভিনয় দিলীপ কুমারকে কী দিয়েছে, তা সবাই জানেন। স্বাভাবিকভাবেই বলা যায়, দিলীপ কুমারের অনুরাগ ছিল বাংলার প্রতি। যদিও তাঁর একমাত্র অভিনীত বাংলা ছবি ‘সাগিনা মাহাতো’ ফ্লপ হয়।

প্রয়াত মেয়র আনিসুল হকের উদ্যোগে দিলীপ কুমার ঢাকায় আসেন ১৯৯৫ সালের জানুয়ারিতে। উপমহাদেশের এই কিংবদন্তি অভিনেতার আগমনে স্যুভেনির কমিটি করা হলো। সেখানে আমাকে সহসম্পাদক করা হলো। রাখা হলো সংবর্ধনা কমিটিতে। স্যুভেনিরে দুটি লেখা লিখতে হলো, এর মধ্যে একটি লেখা হলো ইংরেজিতে। ‘সিনেমা অব বাংলাদেশ’ নামের এই লেখাটি মূলত দিলীপ কুমারকে আমাদের দেশের চলচ্চিত্র সম্পর্কে একটি ধারণা দেওয়ার জন্য লিখতে হয়েছিল।

২৬ জানুয়ারি দিলীপ কুমারকে নিয়ে আসা হলো এফডিসিতে। চলচ্চিত্র শিল্পী সমিতির পেছনে মঞ্চ বানানো হয়েছে। শিল্পী, পরিচালক, প্রযোজকে পূর্ণ এফডিসি। আমি বসেছি দ্বিতীয় সারিতে। চাষী নজরুল ইসলাম উপস্থাপনা করছেন। মঞ্চে এলেন দিলীপ কুমার। সেই প্রথম দেখলাম দিলীপ কুমারকে। আমার স্বপ্নের নায়ককে। তিনি পর্দায় যতটা সুন্দর, বাস্তবে এর চেয়েও বেশি সুন্দর। আমার পাশে বসেছিলেন সংগীতশিল্পী আনজুমান আরা বেগম। তিনি দেখতে পাচ্ছিলেন না। তখন আমার সিটটি ছেড়ে দিলাম। উনি সেখানে দাঁড়িয়ে দেখলেন দিলীপ কুমারকে।

খুব অল্প সময়ে বাংলাদেশিদের মন জয় করে নিয়েছিলেন তিনি। আধো আধো বাংলায় কথা বলেছিলেন। সে সময় বাংলাদেশিরা বুঝেছিল দিলীপ কুমার শুধু হিন্দি ভাষার নয়, তাদেরও অভিনেতা। ওই একবারই দিলীপ কুমার ঢাকায় এসে বেশ কয়েক দিন ছিলেন। ছিলেন ইন্টার কন্টিনেন্টাল হোটেলে। পরদিন ২৭ জানুয়ারি ওসমানী মিলনায়তনে জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার প্রদান অনুষ্ঠানে বিশেষ অতিথি হিসেবে যোগ দিলেন। ওই অনুষ্ঠানে কিংবদন্তি অভিনেতার একটি সিনেমার গানে দুর্দান্ত নেচেছিল শাবনাজ-নাঈম জুটি। দিলীপ কুমার এতটাই অভিভূত হয়েছিলেন যে কাছে ডেকে দুজনকে জড়িয়ে ধরেছিলেন।

দিলীপ কুমারকে ‘ট্র্যাজেডির রাজা’ হিসেবে আখ্যায়িত করা হয়; কিন্তু বিশেষণ তাঁর জন্য আসলে কোনো সুখকর ছিল না। মনের ওপর প্রভাব ফেলে। ইংল্যান্ডে গিয়ে তিনি মনোরোগ বিশেষজ্ঞ দেখান। তাঁকে পরামর্শ দেওয়া হয় কৌতুক মেশানো চরিত্র করতে। তিনি করলেন রাম অর শ্যাম, বৈরাগ আজাদের মতো ছবি। এই ছবিগুলোও প্রমাণ করে শুধু ব্যথা-বেদনাতুর চরিত্রে নয়, সব চরিত্রে দিলীপ কুমার অনবদ্য। যদিও আমি ছাত্রদের পাঠ্য তালিকায় মুঘল ই আজমের মতো সিনেমা রেখেছি, কেননা ঐতিহাসিক একটি সিনেমা বাণিজ্যিকভাবেও সফল। ছবির অভিনয় যে হিসাব বদলে দিতে পারে, এটা শিক্ষার্থীদের পাঠ্য হওয়া প্রয়োজন।

দিলীপ কুমার গতকাল চলে গেলেন। তাঁর মতো অভিনেতা আর হবে না। যুগ পাল্টেছে, প্রযুক্তির কল্যাণে সব কিছুই খণ্ড খণ্ড হয়ে যাচ্ছে। একটি সম্পূর্ণ দিলীপ কুমারকে আর কখনোই পাবে না ভারত, উপমহাদেশ কিংবা পুরো বিশ্ব।

অনুলিখন : মাহতাব হোসেন

About Syed Enamul Huq

Leave a Reply