Saturday , 23 November 2024
E- mail: news@dainiksakalbela.com/ sakalbela1997@gmail.com
ব্রেকিং নিউজ
কুড়িগ্রামে চুলের তৈরি টুপি যাচ্ছে চীন স্বাবলম্বি হচ্ছে গ্রামীণ নারীরা

কুড়িগ্রামে চুলের তৈরি টুপি যাচ্ছে চীন স্বাবলম্বি হচ্ছে গ্রামীণ নারীরা

কুড়িগ্রাম প্রতিনিধিঃ
চুলের টুপি তৈরী করে চমক দিয়েছেন ফুলবাড়ীর নারীরা। আর এই সাফল্যের গল্প রচিত হয়েছে একজন লাইজু খাতুনের হাত ধরে। তার কারণেই কর্মসংস্থানের সুযোগ সৃষ্টি হয়েছে বেশ কিছু দরিদ্র নারী ও স্কুল শিক্ষার্থী। তাদের নিপুণ হাতের ছোঁয়ায় তৈরী করা চুলের টুপি দেশের বাজার ছাপিয়ে এখন রপ্তানি হচ্ছে চীন দেশে। ফলে লাইজু এখন একজন সফল নারী উদ্যোক্তা। ছড়িয়ে পরেছে তার নামডাক। কুড়িগ্রাম জেলার সীমান্তবর্তি উপজেলা ফুলবাড়ী’র প্রত্যন্ত অঞ্চলের এই নারী উদ্যোক্তা নিজে স্বাবলম্বি হবার পাশাপাশি সৃষ্টি করেছেন আরো ৩০ নারীর কর্মসংস্থানের সুযোগ।
ফুলবাড়ী উপজেলার সদর ইউনিয়নের চন্দ্রখানা বালাতাড়ি গ্রামের কৃষক হেছার আলী মেয়ে লাইজু খাতুন। বাণিজ্যিকভাবে মাথার চুল দিয়ে টুপি তৈরী করে এক উজ্জ্বল সম্ভাবনা ও সফল উদ্যোক্তা হওয়ার স্বপ্ন দেখছেন এই নারী উদ্যোক্তা। কৃষক হেছার আলীর তার পাঁচ মেয়ের মধ্যে লাইজু চতুর্থ নম্বর। বড় তিন মেয়ের অর্থাভাবে লেখা পড়া করাতে না পেরে অল্প বয়সে বিয়ে দিয়ে দেন দরিদ্র কৃষক। তবে শত বাঁধার মুখেও নিজের ঐকান্তিক প্রচেষ্টায় লাইজু খাতুন রংপুর সরকারি কলেজ থেকে বাংলা বিষয় মার্স্টাস সম্পন্ন করেন। আর সব ছোট মেয়েকে এসএসসি পাশ করেছে। ২০১৫সালের উপজেলার পার্শ্ববর্তি শিমুলবাড়ী ইউনিয়নের সোনাইকাজী গ্রামের আজিজার রহমানের ছেলে সামিউল ইসলাম সেলিমের সঙ্গে পারিবারিক ভাবে বিয়ে হয় লাইজুর। তার স্বামী একটি বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে চাকুরি করেন। তাদের দাম্পত্য জীবনে আড়াই বছরের একটি কন্যা সন্তান রয়েছে।
লাইজু খাতুন নিজেই স্বাবলম্বি হওয়ার পাশাপাশি গরীব-অসহায় পরিবারের শতাধিক নারীদের কর্মসংস্থানের লক্ষ্যে কাজ করে যাচ্ছেন। চুলের টুপি দেশ-বিদেশে রপ্তানির সুযোগ থাকায় ইতিমধ্যেই গ্রামের গরীব-অসহায় পরিবারের ৩০জন নারীকে দিয়ে চুলের টুপি তৈরি করে রপ্তানি করছেন তিনি। এই নারী উদ্যোক্তার সঙ্গে টুপি তৈরি করে প্রতি মাসে ৫/৮ হাজার টাকা আয় করে পরিবারে তাদেরও সংসারে স্বচ্ছলতা ফিরিয়েছেন এসব নারী। সরকারি-বেসরকারিভাবে সুযোগ-সুবিধা পেলে প্রতিষ্ঠানটির মাধ্যমে অবহেলিত এলাকার শতশত নারীর কর্মসংস্থান সৃষ্টির সম্ভাবনা দেখছেন এই নারী উদ্যোক্তা।
লাইজু খাতুন বলেন,আমার অনেক দিনের ইচ্ছা ও স্বপ্ন ছিল একজন সফল উদ্যোক্তা হবো। চাকুরির পিছনে ছুটবো না নিজেই সৃষ্টি করবো কর্মসংস্থানের। নারীদের ভাগ্যবদলে নিবো বিশেষ উদ্যোগ। এই স্বপ্নটা পুরণ করতে আমার স্বামীর সহযোগীতায় ময়মসিংহে ৫দিন এবং ঢাকা উত্তরায় ১০ দিন চুল দিয়ে টুপি তৈরির প্রশিক্ষণ নেই। প্রশিক্ষণ নিয়ে গ্রামের ৩০জন নারীকে আমার নিজস্ব অর্থায়ণে প্রায় একমাসের প্রশিক্ষণ দেই। আমার বাবার বাড়িতে একটি টিনসেড ঘরে সল্প পরিসরে “সিনহা বিনতে সামিউল হেয়ার ক্যাপ নিটিং লিঃ”প্রতিষ্ঠানের যাত্রা শুরু করি চলতি বছরের তিন মাস আগে। প্রায় দেড় লাখ টাকা ব্যয়ে প্রতিষ্ঠানটি চালু করি। এখন গড়ে মাসে ৯০-১০০টি চুলের টুপি তৈরি করা হচ্ছে। প্রতিটি টুপিতে গড়ে সাড়ে তিনশ টাকা খরচ করে ঢাকায় বিক্রি হচ্ছে প্রায় ৫শ টাকায়। আমাদের তৈরিকৃত চুলের টুপি গুলো ঢাকার বেসরকারি প্রতিষ্ঠান চীনে রপ্তানি করে।
নারী শ্রমিক নাসিমা বেগম বলেন,‘আমার স্বামী দিন মজুরির টাকায় চার জনের সংসার চলে না। কাজ জুটলে সেদিন পেটে খাবার যায় না হলে এক/আধ বেলা খেয়ে না খেয়ে দিন কাটে। লাইজু আপার এডে কাজের সুযোগ পাইছি। গত তিন মাস থাকি মাসে ৪/৭ হাজার টাকা আয় করছি। এতে করে হামার সংসারে অভাব কমি গেছে।”
৯ম শ্রেণীর ছাত্রী নিশি আকতার বলেন, করোনার মধ্যে স্কুল বন্ধ রয়েছে দীর্ঘদিন ধরে। সংসারের বসে থেকে বাড়তি খরচের চাপ হয়ে গেছে। লাইজু আপার চুলের টুপি তৈরির বিষয়টি জানতে পারি। পরে প্রশিক্ষণের সময় দেখলাম কম পরিশ্রমে আয় করা সম্ভব। তাই এই চুলের টুপি তৈরির কাজ করে মাসে ৫/৭হাজার টাকা আয় করছি। এতে করে আমি নিজের পড়ালেখার খরচ চালানোর পাশাপাশি সংসারে সহযোগিতা করতে পারছি।’
অষ্টম শ্রেণীর শিক্ষার্থী আনিছা আক্তার বলেন, স্কুল বন্ধ থাকায় ১০জন শিক্ষার্থী লাইজু আপার প্রতিষ্ঠানে প্রশিক্ষণ নিয়ে কাজ করছি। আমরা সবাই পড়ালেখার পাশাপাশি ভবিষ্যতে নিজের পায়ে দ্বাঁড়ানো স্বপ্ন দেখছি। দেখছি বড় হওয়ার জীবন যুদ্ধে সফল হওয়ার স্বপ্ন।
লাইজু খাতুনের অনুপ্রেরণা শক্তি স্বামী সামিউল ইসলাম সেলিম। সামিউল ইসলাম সেলিম বলেন,লাইজু খুবেই মেধাবী একজন নারী। সে উচ্চ শিক্ষায় শিক্ষিত হওয়ার পরেও চাকুরি করার ইচ্ছে ছিল না। ওল্টো স্বপ্ন দেখত সফল নারী উদ্যোক্তা হয়ে নিজে সাবলম্বি হয়ে গ্রামের অবহেলিত নারীদের সাবলম্বি করে তুলবেন। তাই স্বামী হিসাবে স্ত্রীর স্বপ্ন পুরণের জন্য তাকে অনুপ্রেরণা যুগিয়েছি। আর্থিক সহায়তা পেলে এ প্রতিষ্ঠানে আরো শতাধিক নারীর কর্মসংস্থান করা সম্ভব। উপজেলা মহিলা বিষয়ক কর্মকর্তা সোহেলী পারভীন বলেন, লাইজুর প্রতিষ্ঠান পরিদর্শন করে উর্দ্ধতন কর্তৃপক্ষকে জানানো হয়েছে। উপজেলা মহিলা বিষয়ক অধিদপ্তরের মাধ্যমে লাইজুর প্রতিষ্ঠানটি সমিতির অন্তভুর্ক্তির মাধ্যমে রেজিস্ট্রেশনের ব্যবস্থা করা হলে উপজেলার শতাধিক নারীর কর্মসংস্থানের সুযোগ সৃষ্টি হবে বলে।
উপজেলা নির্বাহী অফিসার সুমান দাস বলেন,উপজেলার প্রত্যন্ত অঞ্চলে নারীরা এগিয়ে যাচ্ছে। এটা খুবেই ইতিবাচক। নতুন নতুন উদ্যোক্তা তৈরী হলে দেশ ও জাতি এগিয়ে যাবে। উপজেলা প্রশাসনের পক্ষ থেকে নতুন নতুন উদ্যোক্তাদের সার্বিক সহযোগিতার আশ্বাস দেন তিনি।

About Syed Enamul Huq

Leave a Reply