গ্রাম, গ্রামই। অন্তত শহর বলা যায় না কোন অর্থেই। চারপাশ মলিন গাছপালা,ঝোপঝাড়,বুনো জঙ্গল নতুন বর্ষার পানি পেয়ে পান্নার মতো ঝলসাচ্ছে দুপুরের রোদে। বৃষ্টি থমেছে ঘন্টা দুয়েক,পূর্ব দিকে মেঘ জমেছে আবার,বিকেলে হয়তো আবার ঢালবে। রাস্তা কিছুটা পিচের,কিছু কাচাঁও-সেখানে খানাখন্দ। গর্তে জমে উঠেছে ঘোলাপানি। দু-চারটে মোড়ে নির্জীব মড়াখেকো মুদির দোকান,সেখানে অবিশ্যি কোক-পেপসিও চোখে পড়ল দু’বার। জায়গাটা গরিবই। ১৫০ বছর আগেও আনোয়ারা উপজেলার পরৈকোড়া গ্রাম এত হতশ্রী,এত নি:স্ব ছিল না ? চেনা যেত তাকে প্রতাপশালী জমিদার যোগেশ চন্দ্রের রাজধানী বলে। এই প্রশ্ন সে কখন থেকে ঘুরছে মাথায়। দক্ষিণ চট্টগ্রামের প্রত্মতত্ত্বগুলো দেখতে গিয়ে একেকটি ঐতিহাসিক উঠোনে যাচ্ছি আর মন ভরাক্রান্ত হয়ে উঠেছে। জমিদার যোগেশ চন্দ্র রায় ১৮৩৪ সালের দিকে মূল জমিদারির স্থাপতি ছিলেন। তিনি ছিলেন জনদরদী,মহানুভব ও দানশীল এবং বিলাসী প্রকৃতির মানুষ। তার রাজপ্রাসাদটি প্রায় ৪০ কানি জায়গার উপর নির্মিত হয়। এতে রয়েছে ৪টি বড় বড় পুকুর, খেলার মাঠ, নাচঘর, খাজনাঘর, মাগুবঘর, বৈঠকখানা, অভ্যর্থনা প্রাচীর,পুরাবড়ি,সিতলা মন্দির, জালাতনী মন্দির, দশভূজা মন্দির। এছাড়া রয়েছে বিশ্রামাগার।
রাজপ্রাসাদের কেন্দ্রিয় প্রবেশ পথে ৪টি বলয়রেখা অলঙ্খৃত ও হরেক নকশা করা তোরণ। যা উঁচু উঁচু খুঁটি ও পুর্তগীজ সভ্যতার শৈলী শিল্পে নকশা করা তোরণগুলো চোখ ধাঁধিয়ে দেয়। বেলতলা পুকুরের মাঝ খানে পিতলের তৈরি পান্থশালা ছিল সেসময়। এখন তা গল্প-কাহিনী। মূল জমিদার বাড়িটি এবরো তেবরো ভাবে পড়ে আছে। আনোয়ারার পরৈকোড়া গ্রামে রয়েছে আরেক প্রতাপশালী জমিদার প্রসন্ন কুমার রায়ের স্মৃতি বিজড়িত রাজবাড়ি। ১৮৪৫ সালে জন্ম গ্রহণ করেন ওই জমিদার। ১৮ কানি জায়গার উপর নির্মিত জমিদার বাড়ির প্রধান তোরণ পার হয়ে ভিতরে প্রবেশ করলে ভাঙ্গাচোরা ইটের পাঁজার ফাঁক গলে ভিতর বাড়িতে গেলে গা ছমছম করে।
একসময় ওই বাড়িতে জৌলুস আর জৌলুস ছিল। এখন হাহাকার। জমিদার প্রসন্ন কুমার ছিলেন ধর্মভিরু,শিল্প সাহিত্য ও সংস্কৃতি মনা। রাজপ্রাসাদটির অস্তিত্ব বলতে যাই বোঝায় তা হল কয়েকটা লুপ্ত দেয়াল মাত্র। রাজভবনের সামনে মেহমানখানা। ৬ রুম বিশিষ্ট দ্বিতল ভবন। সামনে ছোট্ট পরিসরে হল রুম। ভবনের ফ্লোরজুড়ে নানা শৈলীতে ঘাঁথা মোগল স্থাপত্য শিলা বিন্যাসে তৈরি মোজাইক করা। ভবনের গাঁয়ে পোড়া মাটি দিয়ে খচিত আছে দেবদেবীর মুর্তি,ফুলেল ছবির প্রচ্ছদ। কিন্তু নেই আগের মত জৌলুস, চাকচিক্য, শাসন-শোষণ। অনেকটা মায়া হল বাড়িটি ভ্রমণ শেষে বের হয়ে আসতে। পরদিন সকালে প্রত্মত্তত্ত্ব গবেষক সৈয়দ মুহাম্মদ রফিক, রহিমুর রশীদ ও ছোটভাই প্রান্তনীল শর্মা কে সঙ্গে নিয়ে চললাম পটিয়ার দিকে।
পশ্চিম পটিয়ার বড় উঠান গ্রামে জমিদার আসাদ আলীর প্রাসাদে। যার নাম শুণলে বাঘে- মহিষে একঘাটে জল খেত। ১৮০০ সালে নির্মিত বাড়ির দরবার ছিল অত্যন্ত ঐশ্বর্য ও জাঁকজমকপূর্ণ। পারসি কায়দায় দরবার সুসজ্জিত ও আড়ম্বরপূর্ণ ছিল তাদের বিলাসী জীবন। এখন কেবল তা স্মৃতিমাত্র। বিশাল জমিদারি বাড়ি-ঘর ও জায়গা থাকলেও বর্তমানে ভোগ দখলের নেই তেমন কোন লোকজন। ২০ কানি জায়গার উপর নির্মিত বাড়িটি দেখলে মনে হবে এ যেন ভূতের বাড়ি। রাজপ্রাসাদের বাইরে রয়েছে নাচঘর, আদালত, ভূমি রেজিষ্ট্রির অফিস,মসজিদ,তেরজুরি (টাকা রাখার সুরক্ষিত ঘর)। ১৯০৫ সালে বঙ্গভঙ্গের সময়ে তোলা এ প্রাসাদের একখানি সাদাকালো ছবি পেলাম আমরা। তাতেও বৈভবের ছাপ স্পষ্ট। আর ২০১২-এ ? হয়তো অবশিষ্ট ছাদ ধসে পড়ে মাটিতে মিশে যাবে জমিদার আসাদের প্রাসাদটির শেষ স্মৃতি টুকু। অবাক হওয়ার মত বর্ণনা শুনলাম চন্দনাইশের খাঁন বাড়িতে গিয়ে। বিখ্যাত সুফি-সাধক ও ধর্ম প্রচারক নবাব ইয়াছিন আলী খাঁন খাঁন বাড়িতে বসেই সুশাসন প্রতিষ্ঠা ও ইসলাম প্রচারের কাজ করেছিলেন। এখন রাজপ্রাসাদটি বিলুপ্ত। আছে তাঁর বংশধর ফজর আলী খাঁন এর শেষ স্মৃতি বিজড়িত একটি ছোট বাড়ি। ওই বাড়িতে এখনও পর্যন্ত কেউ স্থায়ীভাবে বসবাস করতে পারে না। কারণ লোকমুখে শুণা-স্থায়ীভাবে কেউ বসবাস করতে গেলেই অলৌকিকভাবে আগুণ জ্বলে উঠে। ১৫০০ খ্রিষ্টাব্দে তুরস্ক থেকে নবাব ইয়াছিন আলী খাঁন চট্টগ্রামে ধর্ম প্রচারে আসেন। তাঁর বিনম্রতা, বদন্যতা এবং সুবিচারের প্রতি শ্রদ্ধা ছিল সর্বজনের।
এলাকাবাসীরা জানান,ফজর আলী খাঁন ২২ গ্রামে ২২টি দিঘী, ২২টি মসজিদ, ২২টি বিরাট আকারের ফুলের বাগান তৈরি করেছিলেন। বর্তমানে তাঁর স্মৃতি বিজড়িত অনেক কিছু হারিয়ে গেছে। গল্প করতে করতে এক পসলা বৃষ্টির মধ্যে ফিরে এলাম পটিয়ার পাইরুল গ্রামে। সেখানে রয়েছে ১৮০০ খ্রিষ্টাব্দের প্রতাপশালী জমিদার অভিমন্যুর জমিদার বাড়ি। এক সময় ওই জমিদারের জমিদারী ছিল পটিয়ার জঙ্গলখাইন,গৈড়লা,পাইরুল,ধলঘাট,মুকুল নাইট ও আমজুরহাটসহ বিস্তীর্ণ এলাকা। এখন শুধু ১২ কামরা বিশিষ্ট জীর্ণশীর্ণ জমিদার বাড়িটি ছাড়া আর কিছুই নেই। জমিদার অভিমান্যের বাড়ির সামনে দিয়ে কেউ জুতা পায়ে হেঁটে যেতে পারতো না। নিষ্টুর স্বাভাবের এ জমিদার ছিল অত্যাচারি। কালের অতল গহব্বরে হারিয়ে গেল তাঁর সমস্ত স্মৃতি। শেষ স্মৃতি টুকুই ভেঙ্গে পড়ে পড়ে অবস্থা। অনেক খারাপ লেগেছে উচ্চ বিলাসী জমিদার অভিমান্য- এর বাড়িতে গিয়ে। অত্যাচারি জমিদার হলেও কেন যেন তাঁর জন্য অনেক মায়া হচ্ছিল। এভাবে কি একটি পরিবার ধ্বংস হতে পারে! একদিন পরপর দুটি ঐতিহাসিক প্রাসাদ দেখার পর মন ডুবে গেল গভীর বিষণতায়।
রাজবাড়িগুলো আজ দাঁড়িয়ে আছে অতীতের কঙ্কাল হয়ে। ছিয়াত্তরের মন্বস্তরের পর এই রাজ বাড়ির মানুষগুলো অসামান্য অত্যাচার চালিয়েছিলেন ব্রিটিশের রেভিনিউ কালেক্টর হিসাবে। সে রকম একটি বাড়িতে গেলাম লোহাগাড়া উপজেলার পদুয়া ইউনিয়নে।
রাজবাড়ির নাম গুপ্ত এস্টেট। ১৭০০ খৃস্টাব্দে ২য় মহারাণী ভিক্টোরিয়া রামমোহন রায়কে দান করেছিল বিশাল সম্প্রতি। বান্দরবান জেলা ও সাতকানিয়া- লোহাগাড়া উপজেলা ৮০ শতাংশ জায়গা ছিল তাঁর জমিদারির আওতায়। অত্যাচারি ওই জমিদাবেরর বিশাল বাড়িটি কালের সাক্ষি হয়ে দাঁড়িয়ে আছে। তাঁকে অত্যাচারি বলছি এই জন্য তাঁর জমিদারি এলাকায় মুসলিম ও বৌদ্ধ ধর্মাবলম্বীরা জুতা পায়ে হাঁটতে পারতো না। তেওয়ারি হাট এলাকায় অবস্থিত জমিদার বাড়িটি ৯ একর জায়গার উপর প্রতিষ্ঠিত। মূল বাড়িটি ২ তলা বিশিষ্ট। ঘরের দেয়ালগুলো প্রায় ২৪ ইঞ্চি প্রস্থ। বিশাল আকারের নকশায় তৈরি থাম ও ফটক গেইট এখন বাড়িটির অস্তিত্ব জানান দেয়। শেষ বিকালে আমরা দেখলাম আনোয়ারা উপজেলার তৈলারদ্বীপ এলাকার সরকার বাড়ি। সরকার বাড়ি অনেক ষড়যন্ত্রের সাক্ষী। ১৮০০ খৃস্টাব্দের শেষের দিকে সরকার বাড়িতে নির্যাতিত মানুষের বীভৎস কান্না শুণা যেত। ওই বাড়ির পাশদিয়ে মানুষ হাঁটতে ভয় পেত। সেই সরকার বাড়িতে আজ কোন সরকার নেই। শুনা যায় না আজ নির্যাতিত মানুষের করুন কান্নার রোল। শুধু দাঁড়িয়ে আছে কালের সাক্ষী ও ব্যর্থ ইতিহাস হয়ে জীর্ণশীর্ণ অহংকারী সরকার বাড়ি। জমিদার এরশাদ আলী ছিলেন সাহসী ও রাজস্ব আদায়ে নির্ভীক স্বভাবের। তাঁর সময়ে কঠোর হস্তে রাজস্ব আদায়ের ফলে কৃষক শ্রেণীর মানুষরা চরমভাবে নির্যাতিত হয়। এরশাদ আলীর জমিদারি ছিল চকোরিয়া, বাঁশখালী, আনোয়ারা ও চন্দনাইশ উপজেলা পর্যন্ত। প্রাচীন শৈল চিত্রে অঙ্কিত স্থাপত্যের সরকার বাড়িটি এখন পরিপাটি এবং সুরক্ষিত রয়েছে। আজও রাজবাড়িগুলোর ফটকের সামনে দাঁড়ালে গায়ে কাঁটা দেয়। কী সুন্দর ! শোনা কথা,ফটকের এই পিলারগুলি নাকি লুটের মাল। হবেও বা, আর কদিন পরে সবই হয়তো ঢাকা পড়ে যাবে,জঙ্গল হয়ে যাবে,মুছে যাবে মানুষের স্মৃতি থেকে।
কেন এমন হল ? কেন এমন হয় ? আজ যাঁরা এই সব সম্পত্তির মালিক তাঁদের তাঁদের দোষ দিয়ে তো কোনও লাভ নেই। এত ব্যাপ্ত, এত ছড়ানো,এত বিলাসবহুল এ সব প্রাসাদ। এগুলি তো ব্যক্তি মালিকের টাকায় রক্ষা করা
সম্ভব নয়। আর যে দেশের সরকারের কোষাগার তলানিতে এসে ঠেকেছে সে দেশে সরকারই বা কী করবে ? কিন্তু এগুলো অন্য অনেক কাজে তো লাগাতে পারত। নিদেনপক্ষে হেরিটেজ হোটেল হতে ক্ষতি কী ছিল ?
লেখকঃ রাজিব শর্মা, সাংবাদিক ও তরুণ লেখক, চট্টগ্রাম। রক ভ্যালী মিনিষ্ট্রির একজন শিক্ষার্থী।