অনলাইন ডেস্ক:
করোনাভাইরাসের সংক্রমণ ঠেকাতে লকডাউনের আদলে জারি করা বিধি-নিষেধ ঢিলেঢালাভাবে চলায় আবারও উদ্বেগ প্রকাশ করেছে কভিড-১৯ সংক্রান্ত জাতীয় কারিগরি পরামর্শক কমিটি। সার্বিক পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে না আসা পর্যন্ত সারা দেশে চলমান লকডাউন কঠোরভাবে বাস্তবায়নের পরামর্শ দিয়েছে কমিটি। একই সঙ্গে সীমান্তবর্তী জেলাগুলোতে করোনার সংক্রমণ বেড়ে যাওয়ায় ওই সব এলাকায় পূর্ণ লকডাউন দেওয়ার তাগিদ দেওয়া হয়েছে।
জাতীয় কমিটির গত ৩০ ও ৩১ মে পর পর দুই দিন দুটি সভা থেকে এসব বিষয়ে সরকারকে পরামর্শ দেওয়া হয়েছে। সভায় সরকারের পক্ষ থেকেও একাধিক সচিব, মহাপরিচালকসহ অন্যরা আমন্ত্রিত হিসেবে অংশ নেন।
সভায় সরকারকে করা সুপারিশগুলোর মধ্যে বলা হয়েছে, সারা দেশব্যাপী জারি করা সরকারি বিধি-নিষেধ কঠোরভাবে পালন করতে হবে। সঠিকভাবে নাক-মুখ ঢেকে মাস্ক পরার বিষয়টি নিশ্চিত করতে হবে, রেস্তোরাঁয় বসে খাওয়ার ব্যবস্থা বন্ধ করতে হবে তবে সরবরাহ চলতে পারে, সব ধরনের সামাজিক, রাজনৈতিক ও ধর্মীয় জনসমাবেশ সম্পূর্ণরূপে নিষিদ্ধ করতে হবে, পর্যটন স্থান ও বিনোদনকেন্দ্র বন্ধ রাখতে হবে, সীমান্তবর্তী জেলা ও উচ্চ সংক্রমিত এলাকায় অঞ্চলভিত্তিক সম্পূর্ণ লকডাউন দিতে হবে, জরুরি সেবায় নিয়োজিত ছাড়া সব মানুষকে বাড়িতে থাকার আদেশ জারির কথাও বলা হয়েছে সীমান্তবর্তী জেলাগুলোতে। পাশাপাশি অনুপ্রবেশ সম্পূর্ণরূপে বন্ধের জন্য কঠোর নজরদারির ব্যবস্থা করা ও টহলের পরিমাণ বাড়ানো, তাত্ক্ষণিকভাবে স্থানীয় কার্যক্রম গ্রহণে স্থানীয় প্রশাসনকে ক্ষমতার্পণ উচ্চ সংক্রমিত এলাকা থেকে আন্ত জেলা গণপরিবহন বন্ধ, স্বাস্থ্য বিভাগের সঙ্গে জনপ্রশাসন ও পুলিশ প্রশাসনের সমন্বয়, প্রশাসনের পক্ষ থেকে বিধি-নিষেধ নিশ্চিতকরণের উদ্দেশ্যে কঠোর মনিটরিং জোরদার করা এবং প্রয়োজনে এই বিষয়ে আইন প্রয়োগের ক্ষেত্রে অন্তরায় দূরীকরণে আইন সংশোধন করা যেতে পারে বলে মত দেওয়া হয়েছে।
সভায় কভিড-১৯ চিকিৎসা গাইডলাইনে ব্লাক ফাঙ্গাসের চিকিৎসা অন্তর্ভুক্তকরণ, প্রয়োজনীয় ওষুধের সংরক্ষণ এবং স্টেরয়েডের যৌক্তিক ব্যবহারের পরামর্শ দেওয়া হয়। ভবিষ্যতে এ দেশেও ইন্ডাস্ট্রিয়াল অক্সিজেন ব্যবহারের প্রয়োজন হতে পারে বলে এখনই তার প্রস্তুত করার পরামর্শ দেওয়া হয়। সভায় সংক্রমণ নিয়ন্ত্রণ না আসা পর্যন্ত বিধি-নিষেধের প্রয়োগ অব্যাহত রাখা এবং বিজ্ঞানভিত্তিক পদক্ষেপ গ্রহণ নিশ্চিত করার তাগিদ দেওয়া হয়।
সভায় সভাপতিত্ব করেন কমিটির সভাপতি অধ্যাপক ডা. মোহাম্মদ সহিদুল্লাহ। সভায় মন্ত্রিপরিষদ বিভাগের সচিব খন্দকার আনোয়ারুল ইসলাম, স্বাস্থ্যসেবা বিভাগের সচিব লোকমান হোসেন মিয়া, স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের মহাপরিচালক অধ্যাপক ডা. আবুল বাসার মোহম্মদ খুরশীদ আলমও ছিলেন।
জাতীয় কমিটির পর্যবেক্ষণ
সভায় কভিড-১৯ সংক্রমণের সর্বশেষ পরিস্থিতি ও ভবিষ্যৎ প্রেক্ষাপট নিয়ে আলোচনা করা হয়। এ সময় পরিস্থিতির পর্যবেক্ষণ তুলে ধরে বলা হয়, দেশের সার্বিক কভিড-১৯ পরিস্থিতির অবনতি ঘটেছে; বিশেষ করে সীমান্তবর্তী (রাজশাহী বিভাগের চাঁপাইনবাবগঞ্জ, নাটোর, রাজশাহী, নওগাঁ এবং খুলনা বিভাগের সাতক্ষীরা, যশোর, খুলনা, বাগেরহাট) এলাকাতে সংক্রমণের উচ্চহার দেখা যাচ্ছে। এ ছাড়া আরো কিছু জেলাতে উচ্চ সংক্রমণ দেখা যাচ্ছে। এরই মধ্যে কমিউনিটি পর্যায়ে ভারতীয় ভেরিয়েন্টের উপস্থিতি পাওয়া গেছে। পর্যবেক্ষণে বলা হয়, স্বাস্থ্য বিভাগের সর্বাত্মক প্রচেষ্টার পরও বড় আকারে সংক্রমণ হলে চিকিৎসাব্যবস্থার জন্য বড় রকমের চ্যালেঞ্জ হতে পারে। যেমনটি বিভিন্ন উন্নত দেশে দেখা গেছে। সাম্প্রতিককালে ভারত এই চ্যালেঞ্জের মধ্য দিয়ে যাচ্ছে। সার্বিক অবস্থা বিবেচনায় সংক্রমণ প্রতিরোধের কোনো বিকল্প নেই এবং এতে জনপ্রশাসনের ভূমিকা অনস্বীকার্য।
স্থানীয় পর্যায়ে সংক্রমণ রোধে বিভিন্ন ধরনের পদক্ষেপ নেওয়া শুরু হয়েছে। চাঁপাইনবাবগঞ্জে লকডাউনের পাশাপাশি আরো তিনটি এলাকায় লকডাউন শুরু হয়েছে। কোথাও পরিস্থিতির ওপর নজর রেখে চলাচলে কড়াকড়ি আরোপ করা হয়েছে। এর পরও বিভিন্ন জেলায় সংক্রমণ বেড়েই চলছে।
সিলেটেও বাড়ছে সংক্রমণ
সিলেটে গত ১০ দিনে শনাক্ত বেড়েছে জাতীয় হারের প্রায় দ্বিগুণ। গত মে মাসের শেষ ১০ দিনে জেলাটিতে প্রতি ১০০টি নমুনা পরীক্ষায় শনাক্ত হয়েছে ১৭ জন। জেলা সিভিল সার্জন কার্যালয় সূত্রে জানা যায়, গতকাল সকাল পর্যন্ত করোনায় আক্রান্ত ২৩৬ জন রোগী বিভিন্ন হাসপাতালে চিকিৎসাধীন রয়েছে। ডেপুটি সিভিল সার্জন ডা. জন্মেজয় দত্ত বলেন, ‘ঈদের সময় স্বাস্থ্যবিধি না মেনে শপিং মল-বাজারে ভিড় করাই সংক্রমণ বৃদ্ধির প্রধান কারণ। মানুষজন গাদাগাদি করে বাড়ি ফিরেছে। এখন এর মাসুল দিতে হচ্ছে।’
রাজশাহীতে কঠোর ১০ নির্দেশনা
গতকাল বিকেলে রাজশাহীতে কঠোর ১০টি নির্দেশনা জারি করেছে জেলা প্রশাসন। এর আগে জেলা প্রশাসক আব্দুল জলিলের সভাপতিত্বে তাঁর কার্যালয়ে করোনা নিয়ে একটি সভা অনুষ্ঠিত হয়। আজ বৃহস্পতিবার সকাল ৭টা থেকে পরবর্তী নির্দেশ না দেওয়া পর্যন্ত এ নির্দেশনা কার্যকর থাকবে।
এদিকে রাজশাহী মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে ২৪ ঘণ্টায় করোনা ইউনিটে আরো সাতজনের মৃত্যু হয়েছে। মঙ্গলবার সকাল ৮টা থেকে বুধবার সকাল ৮টা পর্যন্ত সময়ের মধ্যে তাঁরা মারা যান বলে জানান হাসপাতালের উপপরিচালক ডা. সাইফুল ফেরদৌস। মারা যাওয়া সাতজনের মধ্যে পাঁচজনের করোনা পজিটিভ ছিল।
আজ থেকে কার্যকর হওয়া নির্দেশনার আওতায় সন্ধ্যা ৭টা থেকে সকাল ৮টা পর্যন্ত অতি জরুরি প্রয়োজন ছাড়া (ওষুধ ও নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রব্যাদি ক্রয়, চিকিৎসাসেবা, মৃতদেহ দাফন/সৎকার ইত্যাদি) কোনোভাবেই বাড়ির বাইরে বের হওয়া যাবে না। খাবারের দোকানে বসে খাওয়া যাবে না; তবে পার্সেল চলবে। শপিং মলসহ অন্য দোকানগুলো বন্ধ থাকবে।
খুলনায় এক উপজেলা ও তিন থানায় কঠোর বিধি-নিষেধের সিদ্ধান্ত
খুলনার একটি উপজেলা ও নগরীর তিনটি থানায় কঠোর লকডাউনের সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে। আগামীকাল শুক্রবার থেকে এসব এলাকায় জরুরি সেবা ছাড়া সব দোকান, কাঁচাবাজার এবং জনসমাবেশ স্থান এক সপ্তাহ বন্ধ থাকবে। স্থানগুলো হলো জেলার রূপসা উপজেলা, মহানগরীর সদর, সোনাডাঙ্গা ও খালিশপুর থানা। গতকাল সকালে করোনাভাইরাস প্রতিরোধ সংক্রান্ত জেলা কমিটির মতবিনিময়সভায় এ সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়। খুলনা জেলা প্রশাসক মোহাম্মদ হেলাল হোসেনের সভাপতিত্বে তাঁর সম্মেলনকক্ষে সভায় প্রধান অতিথি ছিলেন খুলনা সিটি করপোরেশনের মেয়র তালুকদার আব্দুল খালেক। সভায় মন্ত্রিপরিষদ বিভাগের সচিব (সমন্বয় ও সংস্কার) মো. কামাল হোসেন এবং খুলনার বিভাগীয় কমিশনার মো. ইসমাইল হোসেন অনলাইনে যুক্ত ছিলেন।
উল্লেখ্য, খুলনা মহানগরীর সদরে সংক্রমণ হার ৩৫ শতাংশ, খালিশপুরে ২৫ ও সোনাডাঙ্গাতে এই হার ১৭ শতাংশ।
নওগাঁ পৌরসভা ও নিয়ামতপুর উপজেলায় কঠোর লকডাউন ঘোষণা
নওগাঁ পৌরসভা ও নিয়ামতপুর উপজেলায় আজ থেকে কঠোর লকডাউন জারি করা হয়েছে। সেই সঙ্গে জেলার সাপাহার ও পোরশা সীমান্তবর্তী উপজেলার সব হাট-বাজার ও স্থায়ী দোকান, মান্দা উপজেলার চৌবাড়িয়াহাটসহ নওগাঁ জেলার সঙ্গে রাজশাহী, চাঁপাইনবাবগঞ্জ ও আন্তর্জাতিক সীমান্তসংলগ্ন সব হাট-বাজার বন্ধ ঘোষণা করা হয়েছে। নওগাঁর জেলা প্রশাসক মো. হারুন-অর-রশীদ গতকাল দুপুর আড়াইটায় তাঁর সম্মেলনকক্ষে আয়োজিত এক প্রেস কনফারেন্সে এই ঘোষণা দেন।
নাটোরে জরুরি প্রয়োজন ছাড়া ঘরের বাইরে যাওয়া নিষেধ
গত মঙ্গলবার জেলায় ৪৫ জনের নমুনা পরীক্ষা করে ২৩ জন করোনা পজিটিভ হিসেবে চিহ্নিত হয়েছে। আক্রান্তের হার ৫১ শতাংশ। এ অবস্থায় জেলা প্রশাসনের পক্ষ থেকে মাইকিং করে জরুরি প্রয়োজন ছাড়া ঘর থেকে বাইরে না আসার পরামর্শ দেওয়া হয়েছে। একই সঙ্গে স্বাস্থ্যবিধি ও মাস্ক ব্যবহারে কঠোর নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে। নাটোরের জেলা প্রশাসক মো. শাহরিয়াজ ও পুলিশ সুপার লিটন কুমার সাহা সরেজমিনে নাটোর শহরের বিভিন্ন এলাকা পরিদর্শন করেন এবং সবাইকে স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলার পরার্মশ দেন।
যশোরে ভারতীয় ভেরিয়েন্ট ছড়িয়ে পড়ার আশঙ্কা
যশোরে শতভাগ সিটে যাত্রী উঠিয়ে অতিরিক্ত ৬০ শতাংশ ভাড়া আদায়ের মধ্য দিয়েই চলাচল করছে গণপরিবহন। ভারত সীমান্তঘেঁষা যশোর ও সাতক্ষীরা জেলার মধ্যে যশোর-বেনাপোল ও যশোর-সাতক্ষীরা ভায়া নাভারণ রুটে চলাচলকারী বাসগুলোতে সরকারি বিধি-নিষেধ না মানায় ‘ভারতীয় ভেরিয়েন্ট’ ছড়িয়ে পড়ার আশঙ্কা রয়েছে। তবে যশোর মিনিবাস ও বাস মালিক সমিতির সহসভাপতি মুসলিম উদ্দীন বলেন, ‘করোনা সংক্রমণ ঠেকাতে প্রশাসনের নানা প্রচারণার পরও অনেক বাসে সঠিকভাবে স্বাস্থ্যবিধি এবং সামাজিক দূরত্ব মানছে না। বিষয়টি নিয়ে আমরা পরিবহনসংশ্লিষ্টদের সঙ্গে কথা বলেছি।’
শার্শা উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা মীর আলিফ রেজা বলেন, স্বাস্থ্যবিধি এবং সামাজিক দূরত্ব মেনে চলাচলের জন্য সব পরিবহনের সংশ্লিষ্টদের সঙ্গে বলা হয়েছে। যারা মানছে না তাদের বিরুদ্ধে অভিযান চালিয়ে ব্যবস্থা নেওয়া হচ্ছে।