অনলাইন ডেস্ক:
রাজধানীর একটি হাসপাতালে বৃহস্পতিবার সন্ধ্যায় মারা যান স্বাস্থ্যমন্ত্রী জাহিদ মালেকের মা ফৌজিয়া মালেক। যিনি করোনায় আক্রান্ত হলেও পরে করোনামুক্ত হয়েছিলেন। কিন্তু করোনা-পরবর্তী জটিলতা আর কাটিয়ে উঠতে পারেননি। এর আগের দিন রাজধানীর আরেকটি হাসপাতালে মারা যান বিএনপি নেতা মোয়াজ্জেম হোসেন আলালের ভাই জাকির হোসেন জেলাল। করোনায় আক্রান্ত হয়ে তিনি বরিশাল শের-ই-বাংলা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে ভর্তি ছিলেন। এক পর্যায়ে তিনি করোনা নেগেটিভ হন। কিন্তু তার পরও জটিলতা আগের চেয়ে বেড়ে যাওয়ায় তাঁকে সেখান থেকে ঢাকার ওই হাসপাতালের নিবিড় পরিচর্যাকেন্দ্রে (আইসিইউ) ভর্তি করা হয়। তিন দিনের মাথায় মারা যান জেলাল।
শুধু এই দুজনই নন, গত বছর সাবেক স্বাস্থ্যমন্ত্রী মোহাম্মদ নাসিম, গত মাসে সংগীতশিল্পী মিতা হকসহ এ পর্যন্ত অনেকেই মারা গেছেন, যাঁরা করোনায় আক্রান্ত হয়ে করোনামুক্ত হওয়ার পর পরবর্তী জটিলতায় ভুগছিলেন। গতকাল শুক্রবার পর্যন্ত দেশে করোনা আক্রান্ত হয়ে মারা যাওয়া ১২ হাজার ৫১১ জনের মধ্যে করোনা-পরবর্তী জটিলতায় কতজন মারা গেছে তার হিসাব নেই। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, যারা করোনা-পরবর্তী জটিলতায় মারা গেছে তাদের হিসাবে রাখা গেলে দেশে করোনায় মৃত্যুসংখ্যা আরো অনেক বেশি হতো। বিশেষজ্ঞরা আরো বলছেন, করোনায় আক্রান্ত হয়ে মৃতদের মধ্যে যেমন পঞ্চাশোর্ধ্ব মানুষ সর্বাধিক, তেমনি করোনা-পরবর্তী নানা জটিলতায় মৃতদের মধ্যে বেশির ভাগই এই বয়সী। তাঁদের মধ্যে অনেকেই করোনায় আক্রান্ত হওয়ার পর নেগেটিভ রিপোর্ট দেখে তাত্ক্ষণিক স্বস্তিতে ছিলেন।
স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের অতিরিক্ত মহাপরিচালক (প্রশাসন) অধ্যাপক ডা. নাসিমা সুলতানা বলেন, ‘আমরা প্রতিদিন করোনায় মৃত্যুর যে তথ্য দিয়ে থাকি তারা কেবল করোনা পজিটিভ অবস্থায় মারা যাচ্ছে। কিন্তু যারা পোস্ট কভিড বা করোনা-পরবর্তী জটিলতায় মারা যাচ্ছে তাদের আলাদা করে হিসাব রাখা হয়নি। যদিও প্রতিটি হাসপাতালে তাদের মৃত্যুর পরিসংখ্যান রয়েছে।’
অধ্যাপক নাসিমা সুলতানা বলেন, ‘করোনা-পরবর্তী জটিলতায় যারা মারা যাচ্ছে তাদের বেশির ভাগই মূলত আগে থেকেই নানা ধরনের জটিল রোগে আক্রান্ত ছিল। ফলে করোনায় আক্রান্ত হওয়ার পর তাদের জটিলতা আরো বেড়ে যায়।’
অবশ্য বাংলাদেশের ক্ষেত্রেই যে শুধু এমনটা হচ্ছে তা নয়, দাবি করে কোনো কোনো বিশেষজ্ঞ বলেছেন, বিশ্বব্যাপী করোনা-পরবর্তী মৃত্যুর প্রবণতা রয়েছে।
সরকারের রোগতত্ত্ব রোগ নিয়ন্ত্রণ ও গবেষণা ইনস্টিটিউটের (আইইডিসিআর) প্রধান বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা ড. এ এস এম আলমগীর বলেন, ‘বিভিন্ন সমীক্ষা প্রতিবেদনের তথ্যানুযায়ী আমরা দেখছি, সারা বিশ্বে করোনা-পরবর্তী জটিলতায় ভুগছে করোনাজয়ী ১০ থেকে ১২ শতাংশ রোগী। যাকে এরই মধ্যে লং কভিড বলে আখ্যা দেওয়া হয়েছে। এমন পর্যায়ে থাকা ব্যক্তিরা করোনা নেগেটিভ হওয়ার পরও অনেক দিন পর্যন্ত নানা ধরনের জটিলতায় ভোগে। যাদের মধ্যে একটি অংশ মারা যায়। কিন্তু এই মৃত্যুর পরিসংখ্যান খুব একটা পাওয়া যাচ্ছে না। তবে ইদানীং এমন মৃত্যু বাড়ছে বলে আপাতদৃষ্টিতে মনে হচ্ছে। আমরা এখন চেষ্টা করছি করোনা-পরবর্তী জটিলতায় মৃতদের তথ্য-উপাত্ত সংরক্ষণের।’
আইইডিসিআরের উপদেষ্টা ড. মুশতাক হোসেন বলেন, যারা বিভিন্ন জটিল রোগে ভুগছে তাদের অন্যদের চেয়ে অনেক বেশিমাত্রায় সতর্ক থাকা জরুরি। কারণ তারা করোনায় আক্রান্ত হলে তাদের ঝুঁকি অনেক বেশি। এমনকি এ ধরনের ঝুঁকিপূর্ণ ব্যক্তিরা করোনায় আক্রান্ত হওয়ার পর করোনা নেগেটিভ হলেও তা খুব একটা গুরুত্বপূর্ণ নয়। বরং তার চেয়েও বেশি গুরুত্বপূর্ণ—তাঁর জটিলতা কোন পর্যায়ে আছে সেই বিষয়টি। এ ধরনের রোগীদের দিকে হাসপাতালগুলোতে বেশি নজর রাখা জরুরি। আবার হাসপাতাল থেকে ছুটিতে বাসায় গেলেও একইভাবে অধিকতর সতর্কতার মধ্যে থাকতে হবে ওই রোগীদের। চিকিৎসকের পরামর্শ সঠিকভাবে মেনে চলা, ওষুধ ঠিকমতো খাওয়া এবং অন্য নিয়ম-কানুন সঠিকভাবে পালন করা। তা না করায় করোনা থেকে সুস্থ হওয়ার পর অনেকেই আবার বিপদের মুখে পড়ছে। শুরু থেকে এ পর্যন্ত প্রায় প্রতিদিনই এ ধরনের নজির দেখা যাচ্ছে। ওই বিশেষজ্ঞ বলেন, পরিবারে এ ধরনের রোগী থাকলে অন্যদেরও তার দিকে আগের তুলনায় অনেক বেশি যত্নশীল হতে হবে। অনেক বেশি সতর্কতার সঙ্গে তাদের সেবা-শুশ্রূষা করতে হবে এবং নিয়মিত চিকিৎসকের সঙ্গে যোগাযোগ রাখতে হবে।
বাংলাদেশ মেডিসিন সোসাইটির সভাপতি ও মুগদা মেডিক্যাল কলেজের অধ্যক্ষ অধ্যাপক ডা. আহমেদুল বলেন, ‘আমরা সব সময় বলে আসছি, যাদের নিয়ন্ত্রণহীন ডায়াবেটিস, উচ্চ রক্তচাপ, হৃদরোগ, কিডনির সমস্যা, অ্যাজমা, ক্যান্সার কিংবা বার্ধক্যজনিত নানা জটিলতা রয়েছে, তাদের অবশ্যই করোনা সংক্রমণের ব্যাপারে বেশি সতর্ক থাকতে হবে। একজন সাধারণ মানুষ করোনায় আক্রান্ত হলে যতটা সমস্যা হয় তার চেয়েও বহু গুণ বেশি ঝুঁকিতে থাকে ওই সব রোগে আক্রান্তরা। এ পর্যন্ত করোনায় যারা মারা যাচ্ছে তারা সবাই এ ধরনের কোনো না কোনো জটিলতায় আগে থেকেই ভুগছিল। কিন্তু অনেকের ক্ষেত্রেই হয়তো সময়মতো চিকিৎসা হয়নি কিংবা হাসপাতালে আসতে দেরি করা হয়েছে অথবা আগে থেকেই অবস্থা এত খারাপ ছিল, যা থেকে ওই রোগীকে আর ফেরানো যায়নি।’ তিনি বলেন, করোনা-পরবর্তী জটিলতা এখন কেবলই দীর্ঘায়িত হচ্ছে। এর সঙ্গে নিত্যনতুন আরো নানা জটিলতা বেড়ে যাচ্ছে, যা বিপদ বাড়িয়ে তুলছে।