অনলাইন ডেস্ক:
চিরাচরিত দৃশ্য আবার ফিরে এলো। বিপুলসংখ্যক বইপ্রেমী মানুষের সমাগম। বিশাল পরিসরে ঘুরে বেড়াচ্ছে তারা। উড়ছে ধুলা। গতকাল শুক্রবার ছুটির দিনে বইমেলায় এমন দৃশ্যই দেখা গেল। এবার করোনাকালে বইমেলার কী অবস্থা দাঁড়ায়, তা দেখার অপেক্ষায় ছিল অনেকে। গতকালের বইমেলায় বিপুল সমাগম দেখে নৈরাশ্যবাদীরা আশাবাদী হয়ে উঠেছে।
আগের দিন মেলা শুরু হলেও প্রকৃত অর্থে গতকালই ছিল বইমেলার প্রথম দিন। করোনাভাইরাস সংক্রমণ শুরুর পর মুক্ত পরিবেশে দেশে প্রথম বৃহত্তম কোনো আয়োজন এই বইমেলা। গতকাল ছুটির দিনে সকাল ১১টা থেকে মেলার দ্বার উন্মুক্ত থাকলেও শেষ বিকেলে বিপুল জনসমাগমে সরব হয়ে ওঠে মেলা। দল বেঁধে অনেকে ছুটে আসে মেলায়। তবে গতকাল দর্শনার্থীদের অনেকটা ইচ্ছামতো ঘুরে বেড়াতে দেখা গেছে। ফলে এক পর্যায়ে মেলা প্রাঙ্গণ ধুলায় ধূসর হয়ে ওঠে। অবশ্য প্রচুর ফাঁকা জায়গা রেখে স্টল সাজানোতে বিপুল সমাগম অস্বস্তিকর লাগেনি। মেলায় ধুলা নিয়ন্ত্রণে পানি ছিটানোর আয়োজন থাকলেও গতকাল পর্যন্ত সেটা শুরু হয়নি। সম্ভবত মেলা কর্তৃপক্ষ এত জনসমাগম হবে তা আশা করেনি। ধারণা করা হয়েছিল বিশ্ববিদ্যালয়সহ শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলো বন্ধ থাকায় মেলায় বিপুল সমাগম না-ও হতে পারে। কিন্তু এই ধারণাকে উড়িয়ে দিয়েছে বইপ্রেমী মানুষ। অন্যদিকে গতকাল মেলার দ্বিতীয় দিনেও অনেক স্টলে নির্মাণকাজ চলতে দেখা গেছে। মেলা প্রাঙ্গণের এখানে-সেখানে নির্মাণসামগ্রীর স্তূপ পড়ে থাকতেও দেখা গেছে।
মেলা কমিটির প্রকাশক প্রতিনিধি খান মাহবুব বলেন, মেলা প্রাঙ্গণে মানুষের চলাচল পথে ইট বিছানোর জন্য বলেছিলেন। তা না করায় ধুলার যন্ত্রণায় ভুগতে হচ্ছে দর্শনার্থীদের।
করোনা মহামারিকালে দম বন্ধ পরিবেশ পেরিয়ে একটু নিঃশ্বাস নিতেই গতকাল নগরবাসী ছুটে আসে বইমেলায়। রাজধানীর কল্যাণপুর থেকে মেলায় এসেছেন বদরুল আলম সস্ত্রীক। করোনা শুরুর পর থেকে কোথাও যাওয়া যায় না। আনন্দ উপভোগের সুযোগ সীমিত হয়ে গেছে। তাই মেলার প্রথম ছুটির দিনই ঘুরতে এলেন। বই কেনা নিয়ে জানালেন, এখনো কেনা হয়নি, প্রিয় লেখকদের কার কী বই আসছে তার খোঁজখবর নেওয়ার চেষ্টা করছেন। কথা প্রসঙ্গে তিনি জানালেন, বইমেলার এর বেশি জনসমাগম হলে স্বাস্থ্য সুরক্ষা বজায় রাখা কঠিন হয়ে পড়বে।
গতকালের আলোচনা অনুষ্ঠান : মেলার সোহরাওয়ার্দী উদ্যান অংশের পূর্ব পাশে যে শেড তৈরি করা হয়েছে, সেখানে গতকাল শুরু হয়েছে ‘লেখক বলছি’ অনুষ্ঠান। এতে নিজেদের বই নিয়ে আলোচনা করেন রঞ্জনা বিশ্বাস, আশরাফ জুয়েল ও মঈনুল হাসান।
বিকেল ৪টায় বইমেলার মূল মঞ্চে অনুষ্ঠিত হয় ‘স্বাধীনতার সুবর্ণ জয়ন্তী : বঙ্গবন্ধুর ঐতিহাসিক ৭ই মার্চের ভাষণ’ শীর্ষক আলোচনা অনুষ্ঠান। প্রবন্ধ উপস্থাপন করেন সুভাষ সিংহ রায়। আলোচনায় অংশ নেন অ্যারোমা দত্ত ও নাসির উদ্দীন ইউসুফ। অনুষ্ঠানে সভাপতিত্ব করেন অধ্যাপক সৈয়দ আনোয়ার হোসেন।
আজকের অনুষ্ঠান : অমর একুশে বইমেলার তৃতীয় দিনে আজ মেলা শুরু হবে সকাল ১১টায়। চলবে রাত ৯টা পর্যন্ত। বিকেল ৪টায় বইমেলার মূল মঞ্চে অনুষ্ঠিত হবে ‘স্বাধীনতার সুবর্ণ জয়ন্তী : স্বাধীনতার ঘোষণাপত্র’ শীর্ষক আলোচনা অনুষ্ঠান। প্রবন্ধ উপস্থাপন করবেন আবুল মোমেন। আলোচনায় অংশ নেবেন আবুল কাশেম এবং আব্দুল মান্নান চৌধুরী। সভাপতিত্ব করবেন ব্যারিস্টার এম আমীর-উল ইসলাম।
নতুন বই : বইমেলার তথ্যকেন্দ্র থেকে শুরু হয়েছে নতুন বইয়ের প্রচার। গতকাল মেলায় এসেছে ৫৫টি নতুন বই। এসব নতুন বই থেকে চারটি নির্বাচিত বইয়ের তথ্য তুলে ধরা হলো।
আনিসুজ্জামান স্মরণ : বাংলাদেশের শীর্ষ গবেষক, আমৃত্যু শিক্ষাব্রতী, প্রাবন্ধিক, অসাম্প্রদায়িক চেতনা প্রসারে অগ্রণী ব্যক্তিত্ব এবং একটি গণতান্ত্রিক সমাজ নির্মাণ আন্দোলনের ধীমান ভাবুক ছিলেন অধ্যাপক আনিসুজ্জামান। বহুধারার কাজের মধ্যে বাঙালির স্বরূপের অনুসন্ধান ও বহুত্ববাদী সংস্কৃতির চিন্তা ও ভাবুকতায় যে মাত্রা তিনি সঞ্চার করেছিলেন তা এ দেশের বুদ্ধিবৃত্তিক চর্চার ক্ষেত্রকে প্রসারিত করেছে। বহুবিধ কর্মের মধ্য দিয়ে তিনি বাঙালি মনীষার শ্রেষ্ঠ প্রতিনিধি হয়ে উঠেছিলেন। তাঁর চরিত্র মাধুর্য, স্বভাবধর্ম ও সৌজন্যে যে বিনয় ছিল এবং সবাইকে ভালোবাসা ও স্নেহ করার যে উজ্জ্বল প্রকাশ ছিল, তা ড. আনিসুজ্জামানকে করে তুলেছিল এক অনন্যব্যক্তিত্ব। জাতির বাতিঘর খ্যাত আনিসুজ্জামান প্রয়াত হয়েছেন গত বছরের ১৪ মে। তাঁকে নিয়ে স্মরণগ্রন্থটি প্রকাশ করেছে বেঙ্গল পাবলিকেশন্স। সম্পাদনা করেছেন আবুল হাসনাত। এতে আহমদ রফিক থেকে শুরু করে রেহমান সোবহান, সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী, হাসান আজিজুল হক, পবিত্র সরকারসহ খ্যাতিমান লেখকরা লিখেছেন আনিসুজ্জামানকে নিয়ে। বইটির সম্পাদক আবুল হাসনাতও প্রয়াত হয়েছেন গত বছর। এই বইটিই সম্ভবত কীর্তিমান এই সম্পাদকের শেষ সম্পাদিত বই। বইটির মূল্য ৯০০ টাকা।
বর্তমানে দাঁড়িয়ে ভবিষ্যতের মুখোমুখি : সিরাজুল ইসলাম চৌধুরীর সমসাময়িক প্রবন্ধের বই। এ বইয়ের প্রবন্ধগুলোয় বর্তমানের কথা চমৎকারভাবে তুলে ধরা হয়েছে। এই বর্তমান অত্যন্ত প্রত্যক্ষ এবং ভীষণ দুঃসহ। বিদ্যমান অবস্থার সাক্ষ্য হিসেবে অনেক ঘটনা এখানে উপস্থিত। এমনিতে মনে হবে ঘটনাগুলো বিচ্ছিন্ন, এমনকি বিক্ষিপ্ত। কিন্তু এগুলো সবই পুঁজিবাদী উন্নতির ধারাপ্রবাহের সঙ্গে যুক্ত। ভেতরে ইতিহাস আছে। সেই ইতিহাস অতীত থেকে চলে এসেছে বর্তমানে এবং বর্তমান প্রসারিত হবে ভবিষ্যতে, আশঙ্কাটা এই রকমেরই। সংকট বাড়ছে। এর থেকে অব্যাহতির পথটা অজানা নয়, কিন্তু তাকে স্পষ্ট করে সামনে আনা আবশ্যক। লেখক এই কাজেই যুক্ত হতে চেয়েছেন। হৃদয়গ্রাহী এই প্রবন্ধগুলো পাঠককে সাহায্য করবে ভাবতে। প্রকাশ করেছে কথা প্রকাশ। মূল্য ৪০০ টাকা।
সুগন্ধি সমুদ্র পার হয়ে : বাংলা সাহিত্যের শক্তিমান কথাশিল্পী হাসান আজিজুল হকের একটি ব্যতিক্রমী বই ‘সুগন্ধি সমুদ্র পার হয়ে’। এই বইয়ে সংকলিত হয়েছে তাঁর নিজের লেখা কবিতাগুচ্ছ, কয়েকটি বিদেশি কবিতার অনুবাদ আর প্রিয় ও পরিচিত কয়েক বাঙালি কবির মূল্যায়ন ও স্মৃতি। বইটি প্রকাশ করেছে কথা প্রকাশ। মূল্য ১৫০ টাকা।
১৯৭১ : অসহযোগ আন্দোলন ও প্রতিরোধ : গবেষক আফসান চৌধুরীর এ গ্রন্থ বাংলাদেশ রাষ্ট্রের জন্মপ্রক্রিয়ার প্রথম প্রহরের ওপরে নির্মিত। বহুকাল আগে ঐতিহাসিকভাবে বাংলাদেশ রাষ্ট্র গঠনের যে যাত্রা শুরু হয়েছিল তার চরম পর্বের ঘটনাবলি বিন্যস্ত করে এই গ্রন্থ তৈরি করা হয়েছে। এই গ্রন্থে ১ মার্চ থেকে এপ্রিলের শেষ পর্যন্ত যে অসহযোগ ও প্রতিরোধ গড়ে ওঠে, সেটিকে তথ্য ও দলিলের মাধ্যমে নির্মাণ করা হয়েছে। প্রকাশ করেছে কথা প্রকাশ। মূল্য ৫০০ টাকা।