অনলাইন ডেস্ক:
প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ১৯৭১ সালে পাকিস্তান সেনাবাহিনীতে কর্মরত জিয়াউর রহমানের ভূমিকার কথা তুলে ধরে বলেছেন, ‘২৫ মার্চ নিরস্ত্র বাঙালিদের ওপর পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী হামলা শুরু করে। জাতির পিতা বলেছিলেন, যার যা কিছু আছে তাই নিয়ে প্রস্তুত হও। রাস্তাঘাট যা কিছু আছে বন্ধ করে দাও। চট্টগ্রামে ২৫ মার্চ যারা ব্যারিকেড দিচ্ছিল তাদের ওপর যারা গুলি চালিয়েছিল তার মধ্যে জিয়াউর রহমান একজন। পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর একজন অফিসার হিসেবে সেদিন যারা রাস্তায় ব্যারিকেড দিচ্ছিল তাদের অনেককেই জিয়াউর রহমান গুলি করে হত্যা করে। চট্টগ্রামে যারা ছিল তাদের অনেককেই জিজ্ঞেস করলে এটা পাওয়া যাবে। দেশেও আছে, বিদেশেও অনেকে আছে।’ তিনি বলেন, ‘শুধু তা-ই নয়, জিয়াউর রহমান ২৫, ২৬ এ দুই দিনই হত্যাকাণ্ড চালায়। ২৭ তারিখ সে যাচ্ছিল সোয়াত জাহাজ থেকে অস্ত্র নামাতে। ছাত্ররা, সাধারণ জনগণ বাধা দিয়েছিল। সেখানে তারা জিয়াউর রহমানকে আটকায়। যেন সোয়াত জাহাজ থেকে সে অস্ত্র নামাতে না পারে।’
প্রধানমন্ত্রী আরো বলেন, ‘যে জাতির পিতাকে হত্যা করে সংবিধান লঙ্ঘন করে ক্ষমতা দখল করে অবৈধভাবে নিজেকে রাষ্ট্রপতি ঘোষণা করে, অবৈধ ক্ষমতায় বসে দল গঠন করেছে সেই দলের নেতারা ৭ই মার্চের ভাষণের ভাষা বুঝবে না, মর্ম বুঝবে না এটা তো খুবই স্বাভাবিক। এতে অবাক হবার কিছু নেই। ধরে নিতে হবে এরা এখনো সেই পুরনো প্রভুদের ভুলতে পারে নাই।’ শেখ হাসিনা ৭ই মার্চের ভাষণের সুবর্ণ জয়ন্তী উপলক্ষে গতকাল সোমবার আওয়ামী লীগ আয়োজিত আলোচনাসভায় সভাপতির বক্তৃতায় এসব কথা বলেন। তাঁর প্রায় ৩৫ মিনিটের বক্তব্যে ৭ই মার্চের ভাষণের তাৎপর্য ও মুক্তিযুদ্ধের প্রস্তুতি, জিয়াউর রহমানের মুক্তিযুদ্ধে যুক্ত হওয়ার পরিপ্রেক্ষিত, ৭ই মার্চ উপলক্ষে বিএনপির আলোচনাসভায় বক্তাদের নানা বক্তব্যের সমালোচনা স্থান পায়।
আওয়ামী লীগ সভাপতি শেখ হাসিনা বলেন, ‘কৌশলগত কারণে চট্টগ্রামে জিয়াউর রহমানকে ঘটনাচক্রে ধরে নিয়ে এসে ২৭ মার্চে স্বাধীনতার ঘোষণা পাঠ করানো হয়। ২৫ মার্চ, ২৬ মার্চ রাতে যে মানুষ হত্যা করেছে এটা মানুষ ভুলে যায়। সে তো আগাগোড়াই পাকিস্তানের দালালি করে এসেছে। তার জন্মই ওখানে। তার লেখাপড়াই পাকিস্তানে। সে কবে বাংলাদেশের হলো? চাকরিসূত্রে এখানে এসেছিল। বিবাহ করে পরবর্তীতে এখানে থেকে যায়। এটাই হলো বাস্তবতা। তার পরও মুক্তিযুদ্ধে যারা অংশগ্রহণ করেছে সকলকেই কিন্তু সম্মান দেওয়া হয়েছে। কিন্তু এদের চরিত্র তো বদলায়নি। ঠিকই বেইমানি মোনাফেকি করেছে। একটা মেজর ছিল। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবই তাকে প্রমোশন দিয়ে মেজর জেনারেল করেছিলেন। কিন্তু সে-ই এই হত্যাকাণ্ডের মূল হোতা ছিল এবং ষড়যন্ত্রের সঙ্গে যুক্ত ছিল।’
রবিবার বিএনপির আলোচনাসভায় দলটির নেতাদের বক্তব্যের প্রতি ইঙ্গিত করে শেখ হাসিনা বলেন, ‘বিএনপির কয়েকজন নেতা, এর মধ্যে কয়েকজন আছে, যারা একসময় ছাত্রলীগ করেছিল, পরে আবার ছেড়ে চলেও গিয়েছিল, তারা নাকি ৭ই মার্চের ভাষণে স্বাধীনতার কোনো ঘোষণাই পায় নাই। আমি আমার নেতাকর্মীদেরকে বলতে চাই—এরা পাবে না। কারণ পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীও পায়নি। আমার মনে হচ্ছে, এরা যেন সেই পাকিস্তানি সামরিক জান্তাদেরই পদলেহনকারী, খোশামোদি, তোষামোদির দল। কাজেই তারা (পাকিস্তানি জান্তা) যা বোঝে, এরা তাই বোঝে। বাঙালিরা যা বোঝে, এরা তা বোঝে না। বাংলাদেশের মানুষ যা বোঝে, এরা তা বোঝে না। এটাই হলো তাদের ঐতিহ্য।’
৭ই মার্চের ভাষণে বঙ্গবন্ধুর সরাসরি স্বাধীনতার ঘোষণা না দেওয়ার প্রসঙ্গে প্রধানমন্ত্রী বলেন, ‘জাতির পিতা ছিলেন পয়েট অব পলিটিকস। তিনি জানতেন কী ভাষায় ঘোষণা দিলে সাধারণ মানুষ এটা বুঝবে। কিন্তু শত্রুদের বুঝতে একটু সময় লাগবে। যুদ্ধক্ষেত্রে রণকৌশল হচ্ছে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ। এই রণকৌশলের মধ্য দিয়ে যুদ্ধ করে বিজয় ছিনিয়ে আনা, এটাই হচ্ছে যুদ্ধে যিনি নেতৃত্ব দেন তাঁর সবচেয়ে বড় কৃতিত্ব। আর সেটাই জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব করেছিলেন।’
এই বিষয়টি ‘না বোঝার’ দলে তৎকালীন ছাত্রনেতা বঙ্গবন্ধুর একসময়ের ঘনিষ্ঠ সহচর সিরাজুল আলম খানও ছিলেন বলে সমালোচনা করেন শেখ হাসিনা। বঙ্গবন্ধুর ভাষণ শেষ হওয়ার পর ঘরে ফেরার সময় রাস্তায় রাস্তায় জনসভাফেরত মানুষের আনন্দ-উচ্ছ্বাসের কথা স্মরণ করে তিনি বলেন, ‘বাঁশের লাঠি, বৈঠা সব কিছু নিয়েই কিন্তু মানুষ এসেছিল। তারা খুশিতে লাফাতে লাফাতে যাচ্ছে। স্লোগান দিতে দিতে যাচ্ছে-বীর বাঙালি অস্ত্র ধরো বাংলাদেশ স্বাধীন করো। আমার গাড়ি দেখে গাড়ি থামাল। এটা ফুলার রোডে। আমরা গাড়ি থেকে নামতে বাধ্য হলাম। তাদের সঙ্গে স্লোগান ধরলাম, তারপর ঘরে ফিরলাম।’
সেদিন ঘরে ফিরে কয়েকজন ছাত্রনেতাকে দেখার স্মৃতি স্মরণ করে শেখ হাসিনা বলেন, “সিরাজুল আলম খান বঙ্গবন্ধুকে বললেন, ‘লিডার, আপনি কী বললেন! সব মানুষ তো হতাশ হয়ে চলে যাচ্ছে।’ যেহেতু আমরা মিছিল থেকে এসেছি, মানুষের সেই উত্তেজনা, মানুষের সেই খুশি, মানুষ যা চেয়েছিল তা পাওয়ার যে উদ্দীপনা সেটা তো আমরা স্বচক্ষে দেখে এসেছি। সঙ্গে সঙ্গে আমি বললাম, ‘আপনারা এমন মিথ্যা কথা বলছেন কেন?’ আমি তাকে নিজেই ধরলাম, ‘আপনারা তো মাঠ থেকে অনেক আগেই চলে এসেছেন, আপনারা তাহলে মাঠের অবস্থা জানেন না। মানুষ তো খুশিতে লাফাতে লাফাতে যাচ্ছে যে তারা যুদ্ধ করবে, তারা প্রস্তুতি নেবে।’”
প্রধানমন্ত্রী বলেন, ‘আজকে বিএনপির কয়েকজন নেতার বক্তব্য আর ওই দিনে এই কথা শুনে আমার তো মনে হচ্ছে, এরা আসলে পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর কোনো দালালি নিয়েই ছিল।’
আলোচনাসভায় আওয়ামী লীগ সভাপতি শেখ হাসিনা প্রধানমন্ত্রীর সরকারি বাসভবন গণভবন থেকে ভার্চুয়ালি যোগ দিয়ে বক্তব্য দেন। আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় কার্যালয় প্রান্তে ছিলেন দলের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের, সভাপতিমণ্ডলীর সদস্য জাহাঙ্গীর কবির নানক, আবদুর রহমান, যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক আ ফ ম বাহাউদ্দিন নাছিম, মাহবুবউল আলম হানিফ প্রমুখ।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক উপাচার্য আ আ ম স আরেফিন সিদ্দিকও সভায় বক্তব্য দেন।