বিশ্ববাসী দীর্ঘ এক বছর পর করোনা টিকা পাচ্ছে। বিভিন্ন দেশে সাধারণ মানুষের মধ্যে করোনার টিকা দেওয়া শুরু হয়েছে। বাংলাদেশ সরকারও ইতিমধ্যেই বিভিন্ন উৎস থেকে টিকা ক্রয় ও সংগ্রহের চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে। ইতিমধ্যে টিকা কাদের দেওয়া হবে সেই অগ্রাধিকারের জন্য বিভিন্ন শ্রেণি-পেশার মানুষদের তালিকা প্রস্তুত করেছে সরকার। সে ক্ষেত্রে নিশ্চই ডাক্তার, নার্স, পুলিশ এবং অন্য সম্মুখসারির করোনা যোদ্ধারা অগ্রাধিকার ভিত্তিতে পাবে করোনার টিকা। এছাড়াও বিভিন্ন বিভাগে করোনার টিকা পৌঁছানোর নকশাও বাংলাদেশ সরকার তৈরি করে রেখেছে।
যুক্তরাজ্যের ৯০ বছর বয়সী নারী মার্গারেট থ্যাচার প্রথম টিকা গ্রহণ করে ইতিহাসে নাম লেখালেন। ৮ ডিসেম্বর ২০২০ বায়োএনটেক ও ফাইজারের টিকার প্রথম ডোজ নেন তিনি। যুক্তরাজ্যে প্রথম আট লাখ টিকা পাবেন তার মতো প্রবীণ আর সামনের সারির স্বাস্থ্যকর্মীসহ বাকি বয়স্ক নাগরিকরা। তবে করোনার টিকা বিতরণের মোট সংখ্যায় সবার ওপরে আছে যুক্তরাষ্ট্র। ১৪ ডিসেম্বর থেকে দেশটিতে বায়োএনটেক-ফাইজারের টিকার প্রয়োগ শুরু হয়েছে। এই দুই প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে ৩০ কোটি ভ্যাকসিনের চুক্তি যুক্তরাষ্ট্রের। প্রথম ধাপে স্বাস্থ্যকর্মী, নার্সিং হোমে বসবাসরত, জরুরি সেবায় নিয়োজিত এবং দীর্ঘস্থায়ী ব্যাধিতে আক্রান্তরা টিকার অন্তভুক্ত। ২০ জনুয়ারি পর্যন্ত সংযুক্ত আরব আমিরাত তাদের ৪ কোটি ১৮ লাখেরও বেশি মানুষকে টিকা দিতে পেরেছে। ১৬ ডিসেম্বর থেকে মডার্নার টিকা দেওয়া শুরু করেছে কানাডা। তবে তার আগেই ফাইজারের টিকা পৌঁছে গেছে দেশটিতে। ৬ লাখ ১৪ হাজারেরও বেশি মানুষ এখন পর্যন্ত সেখানে করোনার প্রতিষেধক পেয়েছে।
ইউরোপের দেশগুলোতে ২৭ ডিসেম্বর থেকে একজোটে বায়োএনটেক-ফাইজারের টিকাদান কার্যক্রম শুরু করেছে। জার্মানি সবচেয়ে বেশি মানুষকে টিকার আওতায় আনতে পেরেছে জার্মানি সরকার। জানুয়ারি তৃতীয় সপ্তাহ পর্যন্ত দেশটিতে ১২ লাখ ২১ হাজারেরও বেশি মানুষ টিকা পেয়েছে। মোট সংখ্যায় পিছিয়ে থাকলেও জনসংখ্যার শতকরা হিসেবে জার্মানির চেয়ে ইতালি অনেক এগিয়ে। করোনায় ইউরোপে এখন পর্যন্ত ১২ লাখেরও বেশি টিকা দেওয়া হয়েছে। আর ছয় থেকে আট মাসের মধ্যে ভারতের ৩০ কোটি নাগরিককে টিকা দেওয়ার পরিকল্পনা করেছে ভারত সরকার। দেশটিতে প্রথম ধাপের এই টিকা কর্মসূচির আওতায় আসবেন স্বাস্থ্যকর্মী ও পঞ্চাশোর্ধ্বরা। এতে খরচ হবে তাদের ১৪০ থেকে ১৮০ কোটি ডলার। যুক্তরাজ্যের অক্সফোর্ড ও অ্যাস্ট্রাজেনেকা, রাশিয়ার স্পুৎনিক এবং ভারতীয় জাইডাস কেডিলা ও ভারতী বায়োটেকের টিকা আছে সম্ভাব্য প্রাপ্তির তালিকায়।
চীনের রাষ্ট্রীয় কোম্পানি সিনোফার্মের টিকার আনুষ্ঠানিক অনুমোদন দিয়েছে চীন সরকার। অনুমোদনের আগে পরীক্ষার জন্য টিকা প্রয়োগ করা হয়েছে ৪৫ লাখ মানুষের দেহে। চীন সরকার ফেব্রুয়ারির মধ্যে ৫ কোটি মানুষকে টিকার আওতায় আনার পরিকল্পনা করছে। বিশ্বে সবার আগে নিজেদের উদ্ভাবিত টিকার অনুমোদন দিয়ে আলোচনায় রাশিয়া। ৫ জানুয়ারির ঘোষণা অনুযায়ী দেশটি এরই মধ্যে ১০ লাখ মানুষকে স্পুৎনিক-ফাইভ নামের সেই টিকা দিয়েছে, যা মোট জনগোষ্ঠীর এক ভাগের কম।
করোনার ভ্যাকসিন তৈরিতে বাংলাদেশি বিজ্ঞানীরাও অনেক এগিয়ে। নিজ দেশে ভ্যাকসিন আবিষ্কার না পারলেও করোনাভাইরাস ‘ধ্বংস করতে সক্ষম’ এমন একটি ‘সলিউশন’ তৈরির দাবি করেছে রাষ্ট্রায়ত্ত প্রতিষ্ঠান বাংলাদেশ রেফারেন্স ইনস্টিটিউট ফর কেমিক্যাল মেজারমেন্টস (বিআরআইসিএম)। নাম দেওয়া হয়েছে ‘বঙ্গোসেইফ ওরো নেইজল স্প্রে’। ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে ২০০ জন কভিড-১৯ রোগীর ওপর এই স্প্রের পরীক্ষামূলক প্রয়োগ করে তা ‘নিরাপদ ও কার্যকর’ প্রমাণিত হয়েছে। বঙ্গোসেইফ কভিড-১৯ রোগীদের ‘ভাইরাল লোড কমিয়ে মৃত্যুঝুঁকি হ্রাস’ করার পাশাপাশি ‘কমিউনিটি ট্রান্সমিশন নিয়ন্ত্রণে’ ভূমিকা রাখতে পারে বলে গবেষকদের ভাষ্য। এছাড়াও ‘কনটাক্ট ট্রেসিং’ মোবাইল অ্যাপসহ নানা ধরনের ছোট ছোট মেশিন তৈরি করেছে দেশের তরুণ বিজ্ঞানীরা।
বিশ্বের সব দেশেই ভ্যাকসিন ব্যবহারে বয়স্ক, অসুস্থ ব্যক্তিবর্গ, স্বাস্থ্যকর্মী, পুলিশ, উচ্চপদস্থ কর্মকর্তাদের অগ্রাধিকার দেওয়া হয়েছে। বাংলাদেশ এই টিকা পাওয়ায় শিক্ষা কার্যক্রম পুরোদমে এবং দ্রুত শুরু করতে পারবে আশা রাখি। করোনার কারণে দীর্ঘ ১০ মাস দেশের সব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ থাকায় চরম ক্ষতিগ্রস্ত শিক্ষা খাত। তাই প্রথম সারির করোনাযোদ্ধাদের টিকা দেওয়ার পর জরুরি ভিত্তিতে শিক্ষক-শিক্ষার্থীদের করোনার টিকা দেওয়া উচিত বলে মনে করছেন শিক্ষা বিশেষজ্ঞরা। সে জন্য এ তালিকায় শিক্ষক-শিক্ষার্থীদের রাখা উচিত। শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের ছুটি আরো দীর্ঘায়িত হলে ক্ষতির মাত্রা আরো বাড়বে। শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান খুলতে না পারলে শিক্ষাসূচি মেরামতের উপায় খুঁজে পাওয়া কষ্টসাধ্য হয়ে পড়বে। এ ছাড়া দীর্ঘদিন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ থাকায় বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে সেশনজট বাড়ছে। ফলে এসব শিক্ষার্থীর জন্য শুরুতেই করোনার টিকা দেওয়া যেতে পারে বলে মনে করছেন সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা।
জাতিসংঘ শিশু তহবিল (ইউনিসেফ) থেকেও এ আহ্বান জানানো হয়েছে। স¤প্রতি গণসাক্ষরতা অভিযানের ‘এডুকেশন ওয়াচ ২০২০-২০২১’ এর এক সমীক্ষায় ফুটে উঠেছে যে দেশের ৭৫ শতাংশ শিক্ষার্থীই শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে ফিরতে চায়। ৭০ শতাংশ অভিভাবক ও ৭৩ শতাংশ জেলা শিক্ষা কর্মকর্তাও স্কুল খুলে দেওয়ার পক্ষে। ইতিমধ্যে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান খোলা নিয়ে বিভিন্ন সংগঠন আন্দোলন করছে। এদিকে সরকারও আগামী ৪ ফেব্রুয়ারির মধ্যে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান খুলে দেওয়ার প্রস্তুতি নিতে বলেছে সংশ্লিষ্টদের। অবশ্য ভ্যাকসিন না পাওয়া পর্যন্ত অবশ্যই মাস্ক পরিধান করা এবং অন্যান্য স্বাস্থ্যবিধি ও শারিরিক দূরত্ব মেনে চলতে হবে। শিক্ষার্থীরা যদি নিজেদের নিরাপদ মনে করে তবেই তারা স্কুলে আসবে। আবার তাদের জীবনের ঝুঁকিও নেওয়া যাবে না। শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের জন্য স্থানীয়, আঞ্চলিক ও জাতীয় পর্যায়ে বিশেষ পরিকল্পনা নিতে হবে।
মুহাম্মদ শামসুল ইসলাম সাদিক
লেখকঃ প্রাবন্ধিক ও