অনলাইন ডেস্ক:
দুই বছর আগে ২০১৯ সালের ৭ জানুয়ারি আওয়ামী লীগের টানা তৃতীয় মেয়াদের সরকার শপথ গ্রহণ করেছিল। সে হিসাবে বর্তমান সরকারের দুই বছর পূর্তি আজ। এর আগে ২০০৮ সালের ২৯ ডিসেম্বর অনুষ্ঠিত নবম জাতীয় সংসদ নির্বাচনে বিশাল বিজয় অর্জনের মাধ্যমে ২০০৯ সালের ৬ জানুয়ারি আওয়ামী লীগ নেতৃত্বাধীন মহাজোট সরকার গঠিত হয়। ফলে গতকাল বুধবার সরকারের টানা এক যুগ থাকার বিরল দৃষ্টান্ত স্থাপন করল আওয়ামী লীগ। আর দলটির সভাপতি, বঙ্গবন্ধুকন্যা শেখ হাসিনা দীর্ঘ সময় সরকারপ্রধান অর্থাৎ প্রধানমন্ত্রী হিসেবে দায়িত্ব পালনের অনন্য রেকর্ড স্থাপন করলেন। একই সঙ্গে আর এক মাস পর এ বছর ফেব্রুয়ারিতে আওয়ামী লীগের সভাপতি হিসেবে চার দশক পূর্ণ হচ্ছে এই নেত্রীর।
বাংলা একাডেমির সভাপতি অধ্যাপক শামসুজ্জামান খান গতকাল বুধবার বলেন, তাঁর রাজনৈতিক বিশ্বাস ও কর্মপরিকল্পনায় আন্তরিকতা এবং মানব ভাগ্য উন্নয়নে দৃঢ় অঙ্গীকার আছে বলেই এমন সাফল্য এসেছে। তিনি প্রশ্ন উত্থাপন করে নিজেই জবাব দেন, ‘শেখ হাসিনার এ সাফল্যের উৎস কী? আমার বিবেচনায় এর প্রথম কারণ তিনি বঙ্গবন্ধুকন্যা। তবে শুধু এ কারণেই তাঁর এই স্বর্ণ সাফল্য আসেনি। তিনি বঙ্গবন্ধুর যোগ্য উত্তরসূরি হিসেবে নিজেকে প্রমাণ করতে পেরেছেন বলেই এ সাফল্য এসেছে। এটা সম্ভব হয়েছে কারণ তিনি বঙ্গবন্ধুর মতোই সাধারণ মানুষের বিশ্বাস, আস্থা জয় করেছেন এবং পরম মমতায় তাদের আপন করে নিয়েছেন। সেই সঙ্গে তাঁর অসম্ভবকে সম্ভব করার নেতৃত্ব গুণ ও দৃঢ়তা আছে।’
লেখক ও গবেষক মহিউদ্দিন আহমদ বলেন, ‘আওয়ামী লীগের সভাপতি হিসেবে শেখ হাসিনাকে দলের সংকটকালে আনা হয়েছিল। সেই থেকে তিনি সভাপতি হিসেবে দায়িত্ব পালন করছেন। ওই সময় তিনি সভাপতি নির্বাচিত না হলে আওয়ামী লীগ তিন টুকরা হতো। আমি মনে করি আশির দশকের আওয়ামী লীগের এক ধরনের পুনর্জাগরণ হয়। ’৯৬ সালে জাতীয় সংসদ নির্বাচনে জয়লাভের মাধ্যমে আওয়ামী লীগে শেখ হাসিনার নিরঙ্কুশ নেতৃত্ব প্রতিষ্ঠা পায়। এরপর এক-এগারোতে তিনি দলে চ্যালেঞ্জের মধ্যে পড়েন। কিন্তু যাঁরা চ্যালেঞ্জ ছুড়েছিলেন তাঁরা আওয়ামী লীগের তরুণ নেতাকর্মীর সমর্থন পাননি। ফলে এ ঘটনার পর দলে শেখ হাসিনার নেতৃত্ব আরো সুসংহত হয়েছে। তাই, যদি কোনো মিরাকল না ঘটে তাহলে আমৃত্য তিনি আওয়ামী লীগের নেতৃত্ব দেবেন। সরকারের এক যুগ প্রসঙ্গে মহিউদ্দিন আহমদ বলেন, যেভাবে নির্বাচন হচ্ছে তাতে আওয়ামী লীগ ২০২৪ সালেও জয়ী হবে।’
আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক এবং সড়ক পরিবহন ও সেতু মন্ত্রী ওবায়দুল কাদের গতকাল বুধবার ঢাকায় এক অনুষ্ঠানে বলেন, বঙ্গবন্ধু দিয়েছেন ভৌগোলিক মুক্তি, তাঁর কন্যা অর্থনৈতিক। তিনি বলেন, শেখ হাসিনা সরকারের ধারাবাহিকতায় গত ১২ বছরে বাংলাদেশ উন্নয়ন-অগ্রগতির সব সূচকে যুগান্তকারী মাইলফলক স্পর্শ করেছে।
সাবেক সিনিয়র সচিব ড. মো. মোজাম্মেল হক খান গতকাল বলেন, ‘মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা যখন আওয়ামী লীগের সভাপতির দায়িত্ব নেন তখন সব নেতাকর্মীর মধ্যে আস্থার সৃষ্টি হয়েছিল। তাঁরা বুঝতে পেরেছিলেন জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের অঙ্গীকার তাঁর যোগ্য উত্তরসূরির মাধ্যমেই বাস্তবায়ন সম্ভব। পরবর্তী সময়ে বঙ্গবন্ধুকন্যা শেখ হাসিনা সে আস্থা রেখেছেন। তিনি আওয়ামী লীগকে পুনর্গঠন করেন। সবাইকে একই পতাকাতলে আনেন এবং সব পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হন। তাঁর নেতৃত্বে চতুর্থবারের মতো আওয়ামী লীগ রাষ্ট্র ক্ষমতায়। বাংলাদেশ পেয়েছে মধ্যম আয়ের দেশের মর্যাদা। তাঁর দৃঢ় মনোবলের কারণেই সম্পূর্ণ নিজস্ব অর্থায়নে তৈরি হয়েছে পদ্মা সেতু। যেসব মেগা প্রকল্প রয়েছে বা তিনি বাংলাদেশকে উন্নত ও সমৃদ্ধ দেশে রপান্তরিত করার যে স্বপ্ন দেখিয়েছেন, সে সব যে বাস্তবায়ন সম্ভব, তা এখন সবাই মনে প্রাণে বিশ্বাস করে।’
চার দশক আওয়ামী লীগের সভাপতি শেখ হাসিনা
জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট কালরাতে সপরিবারে নিহত হন। ওই সময় বিদেশে অবস্থান করার কারণে ভাগ্যক্রমে বেঁচে যান বঙ্গবন্ধুর দুই কন্যা শেখ হাসিনা ও শেখ রেহানা। বঙ্গবন্ধুর অনুপস্থিতিতে জাতি যেমন এক ক্রান্তিকাল অতিক্রম করছিল, তেমনি আওয়ামী লীগের নেতৃত্ব নিয়েও চরম সংকট তৈরি হয়। এ পরিস্থিতিতে ১৯৮১ সালের ১৩ থেকে ১৫ ফেব্রুয়ারি অনুষ্ঠিত আওয়ামী লীগের জাতীয় কাউন্সিলে দলটির সভাপতি নির্বাচিত হন শেখ হাসিনা। ওই সময় তিনি দিল্লিতে নির্বাসিত জীবন যাপন করছিলেন। সভাপতি নির্বাচিত হওয়ার প্রায় তিন মাস পর শেখ হাসিনা দেশে ফিরে এসে দলের হাল ধরেন। তারপর অনেক চড়াই-উত্রাই অতিক্রম করতে হয়েছে তাঁকে। এই চার দশকের নেতৃত্বে তিনি আওয়ামী লীগকে চারবার ক্ষমতায় নিয়ে গিয়ে বিশ্বে বিরল নেতৃত্বের দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছেন। পরিণত হয়েছেন নেতাকর্মীদের আস্থার প্রতীক হিসেবে।
বিশ্বে দীর্ঘ মেয়াদে ক্ষমতাসীন নারী
নারী হিসেবে দীর্ঘমেয়াদে রাষ্ট্র ক্ষমতায় থাকার অনন্য রেকর্ড অর্জন করেছেন আওয়ামী লীগ সভাপতি শেখ হাসিনা। জার্মান চ্যান্সেলর অ্যাঙ্গেলা মারকেল টানা ১৫ বছর ক্ষমতায় থাকার রেকর্ড ধরে রেখেছেন। শেখ হাসিনা টানা ১২ বছর হলেও চার মেয়াদে এরই মধ্যে ১৭ বছর প্রধানমন্ত্রীর দায়িত্ব পালন করছেন।
যুক্তরাজ্যের প্রয়াত প্রধানমন্ত্রী মার্গারেট থ্যাচার প্রধানমন্ত্রী ছিলেন প্রায় ১১ বছর সাত মাস। ভারতের প্রয়াত প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধী ষাটের দশকে ক্ষমতায় এসে টানা ১১ বছর তিন মাস এবং আশির দশকে আবার ক্ষমতায় এসে নিহত হওয়ার আগে প্রায় পৌনে চার বছর ক্ষমতায় ছিলেন। এ ছাড়া শ্রীলঙ্কার শ্রীমাভো বন্দরনায়েক তিন মেয়াদে মোট প্রায় সাড়ে ১৭ বছর সরকারের নেতৃত্ব দেন। তাঁর মেয়ে চন্দ্রিকা বন্দরনায়েক কুমারাতুঙ্গা প্রধানমন্ত্রী ও রাষ্ট্রপতি হিসেবে প্রায় ১১ বছর সাত মাস ক্ষমতায় ছিলেন। সবচেয়ে বেশিদিন ক্ষমতায় থাকা নারী সেন্ট লুসিয়ার গভর্নর জেনারেল ডেম পারলেট লুইজি। তিনি ১৯৯৭ থেকে ২০১৭ সাল পর্যন্ত ২০ বছর ১০৫ দিন দেশ শাসন করেন।
উন্নয়নে বদলে গেছে দৃশ্যপট
প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নেতৃত্বে মহামারি করোনাভাইরাস মোকাবেলা করে বাংলাদেশ এখন সারা বিশ্বে প্রশংসিত। একটির পর একটি সূচকে উঠে আসছে বাংলাদেশের অর্থনৈতিক সমৃদ্ধির তথ্য এবং সারা বিশ্বে প্রশংসা হচ্ছে শেখ হাসিনার সরকারের। ২০০৮ সালের ডিসেম্বরের নির্বাচনে নিরঙ্কুশ জয় নিয়ে সরকার গঠন করে আওয়ামী লীগ। সে সময় দেশের অর্থনীতি ছিল অনেকটাই নাজুক। বিদ্যুতের বেহাল অবস্থায় নাকাল ছিল দেশের মানুষ। সে অবস্থার বৈপ্লবিক পরিবর্তন সূচিত হয়েছে শেখ হাসিনার নেতৃত্বে আওয়ামী লীগ সরকারের টানা এক যুগের শাসনামলে। দেশের মানুষ ভুলতে বসেছে ‘লোডশেডিং’ শব্দটি।
যোগাযোগব্যবস্থাকে সহজ এবং সাধারণ মানুষের আওতায় এনে অর্থনীতির চাকাকে গতিশীলও করেছে এই সরকার। এই মূল্যায়ন দেশের মানুষের। ভেঙে পড়া রেল যোগাযোগকে পুনরুজ্জীবিত করার পাশাপাশি ঢাকা-চট্টগ্রাম, ঢাকা-ময়মনসিংহ ফোর লেন মহাসড়ক, ঢাকা-মাওয়া-ভাঙ্গা এক্সপ্রেসওয়ে এবং ঢাকা ও চট্টগ্রামে নির্মিত ফ্লাইওভারের সুফল পাচ্ছে দেশবাসী। বঙ্গবন্ধু স্যাটেলাইট স্থাপন, চট্টগ্রামে নদীর নিচে ট্যানেল নির্মাণ, চরম প্রতিকূল পরিস্থিতিতে পদ্মা সেতু নির্মাণ শেষ, বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ বৃদ্ধির পাশাপাশি বাংলাদেশকে মধ্যম আয়ের দেশে রূপান্তর শেখ হাসিনার সরকারের ফসল।
২০০৯ সালে ৫ শতাংশের বৃত্ত ভেঙে ৬ শতাংশ প্রবৃদ্ধি অর্জনের মধ্য দিয়ে নতুন এক অধ্যায় শুরু করে বাংলাদেশ। সবশেষ ২০১৮-১৯ অর্থবছরে ৮.১৫ শতাংশ প্রবৃদ্ধি অর্জিত হয়েছে। এরপর করোনাভাইরাস মহামারিতে সারা বিশ্বের প্রায় সব দেশই নেতিবাচক প্রবৃদ্ধি পেলেও বাংলাদেশ ৫.২৪ শতাংশ প্রবৃদ্ধি অর্জন করেছে। বাংলাদেশের এ অর্জন এখন সারা বিশ্বে প্রশংসিত এবং দৃষ্টান্ত হিসেবে বিবেচিত হচ্ছে।