অনলাইন ডেস্ক
গজনবী রোড, বাবর রোড, শাহজাহান রোড ও হুমায়ুন রোড ঘিরে অবাঙালিদের ক্যাম্প, যা জেনেভা ক্যাম্প নামে পরিচিত। এসব সড়কে পুলিশের তল্লাশিচৌকি বা চেকপোস্ট রয়েছে, কিন্তু মাঝখানে ওই ক্যাম্পে চলছে রমরমা মাদক কারবার।
রাজধানীর মোহাম্মদপুর এলাকার এই ক্যাম্পে ৯-১৩ ডিসেম্বর সরেজমিন ঘুরে প্রায় প্রকাশ্যে মাদক কারবার ও মাদকসেবীদের লেনদেনের দৃশ্য দেখা গেছে। জানা গেছে, অন্তত ২০ জনের নিয়ন্ত্রণে এই ক্যাম্পে মাদক কারবার চলছে। অবাঙালিদের অধিকার নিয়ে কাজ করা একটি সংগঠনের একজন নেতার ভাষ্য অনুযায়ী, এই চক্রটি মোহাম্মদপুরের ছয়টি অবাঙালি ক্যাম্পেই মাদক কারবার নিয়ন্ত্রণ করছে। এ ছাড়া দেশের অন্য অবাঙালি ক্যাম্পগুলোতে এই কারবার চলছে তাদের নিয়ন্ত্রণে।
২০১৬, ১৭ ও ১৮ সালে মোহাম্মদপুরের জেনেভা ক্যাম্পসহ অন্যান্য ক্যাম্পে বড় ধরনের অভিযান চালায় পুলিশ ও র্যাব। ২০১৮ সালের ৪ মে থেকে ‘চল যাই যুদ্ধে’ মাদকের বিরুদ্ধে স্লোগান দিয়ে বিশেষ অভিযান শুরু করে আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীগুলো। ওই অভিযান শুরুর পর পুলিশ, র্যাব ও বিজিবির সঙ্গে কথিত বন্দুকযুদ্ধে এ পর্যন্ত নিহত হয়েছে ২৭২ জন। জেনেভা ক্যাম্পের শীর্ষ মাদক কারবারি পাঁচু ওরফে পঁচিশও নিহত হয়েছেন ‘বন্দুকযুদ্ধে’।
এর পরও কেন জেনেভা ক্যাম্পে মাদক করবার কমছে না, এমন প্রশ্নে র্যাবের আইন ও গণমাধ্যম শাখার পরিচালক আশিক বিল্লাহ বলেন, ‘মাদকের বিরুদ্ধে আমরা জিরো টলারেন্স নীতিতে আছি। মাদক নিয়ন্ত্রণে জেনেভা ক্যাম্পে এর আগেও অনেক অভিযান হয়েছে, ভবিষ্যতেও অভিযান অব্যাহত থাকবে।’
প্রায় ৪০ হাজার বাসিন্দার জেনেভা ক্যাম্পে সরেজমিনে মাদক কারবারের খোঁজখবর করার সময় একদিন সন্ধ্যার পর একটি জনাকীর্ণ গলির শেষ মাথায় টুলে বসা ষাটোর্ধ্ব এক নারীর দেখা মিলেছিল। এক তরুণ তাঁর হাতে একটি নোট গুঁজে দেওয়ার পর চোখ আটকে যায় সেদিকে। তরুণটি ওই নারীর হাত থেকে একটি কাগজের পুঁটলি নিয়ে জ্যাকেটের পকেটে হাত ঢুকিয়ে ফেলেছিলেন। পরে তাঁর সঙ্গে কথা বলে জানা গেল, তিনি ৫০০ টাকায় দুটি ইয়াবা ট্যাবলেট কিনেছেন ওই নারীর কাছ থেকে। আশপাশে খোঁজ নিয়ে ইয়াবা বিক্রেতা নারীর নামও জানা গেল—রেহানা। রাত ১০টার দিকে একদল কিশোরকে পাওয়া গেল, যারাও ছিল মাদকদ্রব্যের খরিদদার। রাত পৌনে ১১টার দিকে ক্যাম্পের একটি দোকানের সামনে গিয়ে দাঁড়াতেই পাশের এক মুরব্বিকে মন্তব্য করতে শোনা গেল, ‘কী অবস্থা, প্রকাশ্যে বাবা (ইয়াবা) বিক্রি হয়, কোনো ভয়ডর নাই অগো’।
আরেক দিন পুলিশের একটি টহল টিমকে দেখা গেল ক্যাম্পের আশপাশে দায়িত্ব পালনরত অবস্থায়। ওই দলটির প্রধান সহকারী উপপরিদর্শক (এএসআই) ইফতেখার বলেন, ‘আমরা সব সময়ই চেষ্টা করছি ক্যাম্পের ভেতরের মাদক নিয়ন্ত্রণের, তবে এখনো পুরোপুরি সম্ভব হয়নি।’
ক্যাম্পের একাধিক বাসিন্দা জানান, এমন কোনো মাদকদ্রব্য নেই, যা এখানে মিলবে না। ঢাকায় যে কয়টি স্পট মাদক কারবারের জন্য কুখ্যাত এর মধ্যে একটি এই ক্যাম্প। পুলিশ ক্যাম্পের বাইরে চেকপোস্টে তল্লাশি চালালেও ভেতরে খুব একটা অভিযান চালায় না। চেকপোস্ট গলিয়ে ক্যাম্পে মাদক ঢুকছে কিভাবে—এটাও তাঁদের জিজ্ঞাসা। যদিও এএসআই ইফতেখার বলছিলেন যে ক্যাম্পে মাদক নিয়ন্ত্রণে অন্য টিম আছে।
মোহাম্মদপুর থানার ওসি মো. আব্দুল লতিফ দাবি করেন যে কঠোর নজরদারির কারণে জেনেভা ক্যাম্পের মাদক কারবার এখন আর আগের মতো নেই। পরিস্থিতি অনেকটাই পুলিশের নিয়ন্ত্রণে রয়েছে। তিনি বলেন, ‘ক্যাম্পকেন্দ্রিক মাদক কারবার নিয়ন্ত্রণ করতে ক্যাম্পের চারপাশে চারটি চোকপোস্ট বসিয়েছি, যাতে কেউ মাদক নিয়ে ক্যাম্পের ভেতরে ঢুকতে না পারে।’ তিনি আরো বলেন, ‘প্রতিনিয়ত ক্যাম্পের ওপর নজর রাখছি আমরা। যারা একেবারেই মাদক কারবার থেকে ফিরছে না তাদের গ্রেপ্তার করছি।’
পুলিশ কর্মকর্তা লতিফ জানান, ক্যাম্পের মাদক কারবারিদের বিরুদ্ধে প্রতি মাসে কম করে হলেও ১০টি মামলা হয়। এই হিসেবে বছরে ১২০টি মামলা হয়। এভাবে গত ১০ বছরে সহস্রাধিক মামলা হওয়ার ও কয়েক হাজার অপরাধীকে গ্রেপ্তারের তথ্য পাওয়া গেছে।
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, রাজু, মোল্লা আছাদ, রাজা ও শাহজাদা নামের দুই ভাই, খোরশিদ ও তার মেয়েজামাই রাজু, মুন্না, ফকিন্নি কাল্লু, পাপ্পু ও তার ছেলে রাসেল, ছোট রাজু, বড় রাজু, আতিক ও তার মা রেহানা, চুুয়া সেলিম, তুতে, তার শ্যালক রানা, বালম ও তার ভাই তাবলচি আসলাম ও গালকাটা মনু ক্যাম্পে মাদক কারবার নিয়ন্ত্রণ করছে। তাদের কাছ থেকে মাদকদ্রব্য নিয়ে বিক্রি করে আরো শতাধিক নারী-পুরুষ।
ক্যাম্পের মাদক কারবারিদের মধ্যে ফকিন্নি কাল্লু পুলিশের সোর্স হিসেবে পরিচিত। এ ছাড়া মোল্লা মেহতাব ও মোল্লা বশির নামের আরো দুজন পুলিশের সোর্স মাদক কারবারে জড়িত বলে জানা গেছে।
মোল্লা বশির মাদক কারবারে জড়িত থাকার কথা অস্বীকার করেছেন। তিনি বলেন, ‘অনেকেই মাদক কারবার করছে। খোঁজ নেন, পাইয়া যাইবেন।’ অন্যদের সঙ্গে মোবাইল ফোনে যোগাযোগ করলে তাঁরা এ বিষয়ে কথা বলতে রাজি হননি।
ক্যাম্পে মাদক কারবার নিয়ন্ত্রণকারীরা কেন গ্রেপ্তার হয় না—জানতে চাইলে মোহাম্মদপুর থানার বিট পুলিশিংয়ের দায়িত্বপ্রাপ্ত উপপরিদর্শক (এসআই) জহির রায়হান বলেন, তিনি আগে অন্য থানাতে ছিলেন। কিছুদিন হলো মোহাম্মদপুর থানায় যোগদান করে বিট পুলিশিংয়ের দায়িত্ব পালন করছেন। ক্যাম্পগুলোতে খোঁজ নিয়ে মাদক কারবারের সত্যতা পাওয়া গেছে জানিয়ে তিনি বলেন, প্রতিনিয়ত অভিযান চালিয়ে অনেক কারবারিকে গ্রেপ্তার করা হয়। তবে অনেকেই জামিনে এসে ফের একই কাজ করে।
বিভিন্ন ক্যাম্পে থাকা অবাঙালি, যারা উর্দুভাষী তাদের অনেকেই নিজেদের আটকা পড়া পাকিস্তানি হিসেবে পরিচয় দেয়। তাদের অধিকার নিয়ে কাজ করে এমন একটি সংগঠন স্ট্রান্ডেড পাকিস্তানিজ জেনারেল রিপাট্রিয়েশন্সের (এসপিজিআরসি) নেতারা বলছেন, সারা দেশে ৭০টি ক্যাম্পেই কমবেশি মাদকের প্রভাব রয়েছে। এক ক্যাম্পের মাদক কারবারিদের সঙ্গে অন্য ক্যাম্পের মাদক কারবারিদের নিয়মিত যোগাযোগ রয়েছে মোবাইল ফোন ও বিভিন্ন ইন্টারনেট মাধ্যমে। এভাবে মাদক ছড়িয়ে পড়ছে।
সংগঠনের সাধারণ সম্পাদক এম শওকত আলী বলেন, ‘ক্যাম্পে বসবাসকারীরা নাগরিক সুবিধা থেকে বঞ্চিত। তাদের অনেকেই লেখাপড়া জানে না, আবার কেউ লেখাপড়া করলেও কর্মসংস্থানের তেমন সুযোগ নেই। তাই জীবিকার তাগিদে তারা ঝুঁকি জেনেও বেছে নিয়েছে মাদক বিক্রির মতো অপরাধে।’
জানা গেছে, অবাঙালিদের অনেকেই এরই মধ্যে বাংলাদেশের নাগরিকত্ব গ্রহণ করেছে। যে কারণে তারা আর শরণার্থীর মর্যাদা পাচ্ছে না। অন্যদিকে নাগরিক সুবিধাও পাচ্ছে না।
অপরাধ বিশ্লেষকরা বলছেন, সুনির্দিষ্ট কিছু কারণে মাদক কারবার নিয়ন্ত্রণে আসছে না। জানতে চাইলে অপরাধ বিশেষজ্ঞ ও মানবাধিকারকর্মী নুর খান লিটন বলেন, ‘মাদক কারবারসহ অপরাধপ্রবণতা নিয়ন্ত্রণের জন্য দরকার কর্মসংস্থান ও সামাজিক নিরাপত্তা, সেই সঙ্গে দরকার আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীগুলোর সঠিক নজরদারি।’