কুষ্টিয়া প্রতিনিধি:
বিংশ শতাব্দীর শুরুর একটা সময় কুষ্টিয়ার কয়া গ্রামের মানুষ আতংকিত হয়ে উঠল। পাশের জঙ্গলে বিশাল একটি বাঘ দেখা গেছে। বাঘটির ভয়ে দিনের বেলায়ও কেউ রাস্তা-ঘাটে বের হয় না। রাতে তো কথাই নেই। বাঘটি প্রায়ই গ্রামের গরু, ছাগল খেতে শুরু করল। অতিষ্ঠ হ’য়ে উঠল গ্রামের মানুষ।কয়া গ্রামে একটিই বন্দুক আর তা ছিল ফণিভূষণ বাবুর। গ্রামের জান-মাল রক্ষায় তিনি জীবনবাজী রেখে বাঘটিকে মারার সিদ্ধান্ত নিলেন। সেই সময়ে কৃষ্ণনগর থেকে মামা বাড়ি বেড়াতে এসেছিলেন তরুণ যতীন্দ্রনাথ। মামাত ভাই ফণিভূষণ বাঘ মারতে যাবেন শুনে যতীন্দ্রনাথ তাঁর সাথে যাওয়ার জন্য ব্যাকুল হয়ে উঠলেন। মামাবাড়ির সবাই যতীন্দ্রনাথকে যেতে নিষেধ করলেন। কারণ বন্দুক একটি, খালি হাতে যতীন্দ্রনাথ যাবেন কি করে, বাঘ যদি তাকে আক্রমণ করে? কিন্তু যতীন্দ্রনাথ কারও কথা শুনলেন না। খালি হাতে যাওয়া ঠিক হবে না ভেবে তিনি একটি ভোজালি নিয়ে দুপুরের পর ভাই ফণিভূষণের সাথে বাঘ মারতে রওনা হলেন।শুরু হল বাঘ খোঁজা। ফণিবাবু ও যতীন্দ্রনাথ গ্রামের পাশের জঙ্গলের কাছে একটি বড় মাঠের মাঝে গিয়ে উপস্থিত হলেন। যতীন সেই মাঠের চারদিক দেখছিলেন আর ফণিভূষণ মাঠের এক প্রান্তে বন্দুক তাক করে দাঁড়িয়ে আছেন। গ্রামের মানুষ জঙ্গলের পাশে দাঁড়িয়ে বাদ্যযন্ত্র বাজিয়ে চলেছে। কিছুক্ষণ পর যতীন যেখানে দাঁড়িয়েছিলেন, সেইদিক দিয়ে বাঘ বেরিয়ে এল। বাঘ দেখে গ্রামের মানুষ ভয়ে পালাতে শুরু করল। ফণিভূষণ বাঘটি লক্ষ্য করে গুলি ছুড়ল। গুলি বাঘের মাথা স্পর্শ করে চলে গেল। বাঘ আহত না হয়ে বরং আরো ক্ষিপ্ত হয়ে যতীনের উপর ঝাঁপিয়ে পড়ল। আক্রান্ত যতীন বাঘটিকে বাম বগলের মধ্যে চেপে ধরে বাঘের মাথার উপর সমস্ত শক্তি প্রয়োগ করে ভোজালি দিয়ে আঘাত করতে শুরু করল। বাঘও যতীনকে কামড়াবার আপ্রাণ চেষ্টা করতে লাগল। চলতে থাকে বাঘে-মানুষে লড়াই। বাঘ নখ দিয়ে যতীনের সমস্ত শরীর ক্ষত-বিক্ষত করে চলল। তাঁর হাঁটুতে একটা কামড়ও বসিয়ে দিল। কিন্তু যতীন জানতেন বাঘটিকে না মারতে পারলে তাঁর রক্ষা নেই। তাই জীবন বাঁচানোর লড়াই চালিয়ে গেলেন তিনি। অন্যদিকে বাঘটিকে গুলি করার জন্য ফণিভূষণ বারবার চেষ্টা করে ব্যর্থ হচ্ছিলেন। কারণ বাঘের সাথে যতীন যেভাবে গড়াগড়ি করছিলেন, তাতে গুলি ছুড়লে সেটি যতীনের শরীরে লেগে যেতে পারে। এভাবে প্রায় ১০ মিনিট লড়াই করবার পর যতীন বাঘটিকে মেরে ফেললেন এবং নিজে জ্ঞান হারিয়ে মাটিতে পড়ে গেলেন।মৃত বাঘ ও অচেতন যতীনকে বাড়িতে নিয়ে যাওয়া হল। গ্রাম্য ডাক্তার দেখানোর পর যতীন একটু সুস্থ হলেন। কিন্তু তার শরীরের প্রায় ৩০০ স্থানে ক্ষত দেখা গেল। ডাক্তার তাঁর অবস্থা দেখে তাড়াতড়ি কলকাতায় নিয়ে যেতে বললেন। যতীনের মেজ মামা হেমন্তকুমার তখন কলকাতায় ডাক্তারি করতেন। মামার কাছে তাঁকে পাঠানো হল। হেমন্তকুমার ভাগ্নের অবস্থা আশংকাজনক দেখে কলকাতার সেকালের বিখ্যাত সার্জন লেফটেন্যান্ট কর্ণেল সুরেশপ্রসাদ সর্বাধিকারীর উপর চিকিৎসার ভার দিলেন। প্রখ্যাত এই ডাক্তারও যতীন্দ্রনাথকে বাঁচানোর ও পুরাপুরি সুস্থ করার আশা প্রায় ছেড়েই দিলেন। যতীন মাসখানেক পর একটু সুস্থ হলেন কিন্তু তাঁর পায়ে পচন ধরল। ডাক্তার তাঁর পা কেটে ফেলার সিদ্ধান্ত নিলেন। কিন্তু যতীনের মামাদের আপ্রাণ চেষ্টা ও ডাক্তারদের সুচিকিৎসার ফলে শেষ পর্যন্ত তাঁর পা দুটি রক্ষা পেল। ডাক্তার সুরেশ প্রসাদ সর্বাধিকারী যতীনের বীরত্ব আর অদম্য আত্মবিশ্বাসে বিস্মিত হলেন এবং তাঁকে ‘বাঘা যতীন’ নামে ভূষিত করলেন। মানুষের কাছে যতীন্দ্রনাথ মুখোপাধ্যায় হ’য়ে উঠলেন ‘বাঘা যতীন’।বাঘা যতীন যার পূর্ণ নাম যতীন্দ্রনাথ মুখোপাধ্যায়, জন্মেছিলেন ১২৮৬ সালের ২১ অগ্রহায়ণে (১৮৭৯ সালের ৭ ডিসেম্বর)। তৎকালীন নদীয়া জেলার কুষ্টিয়া মহকুমার কয়া গ্রামের মাতুলালয়ে। বাবা উমেশচন্দ্র মুখোপাধ্যায়। মা শরৎশশী দেবী। তাঁদের আদি নিবাস ছিল যশোর জেলার ঝিনাইদহ মহকুমার রিশখালী গ্রামে। বাঘা যতীনের ৫ বছর বয়সে তাঁর বাবা মারা যান। এরপর মা ও বড়বোন বিনোদবালার সাথে তিনি মাতামহের বাড়ি কয়া গ্রামে চলে আসেন। স্বভাব কবি মায়ের আদর-স্নেহে মাতুলালয়েই তিনি বড় হতে থাকেন। এখানেই কেটেছে তাঁর শৈশব-কৈশোর।পরিবারেই যতীনের লেখাপড়ায় হাতেখড়ি। শরৎশশী দেবী ছেলেকে আদর্শবান ও স্পষ্টভাষী হিসেবে গড়ে তুলতে চেয়েছিলেন। প্রাথমিক লেখাপড়া শেষে বড় মামা বসন্ত কুমার দুরন্ত স্বভাবের যতীনকে কৃষ্ণনগরের অ্যাংলো ভার্ণাকুলার হাইস্কুলে ভর্তি করিয়ে দেন। স্কুলের পড়াশুনা আর খেলাধূলার পাশাপাশি ঘোড়ায় চড়া, শিকার করা, মাছ ধরা, গাছে চড়া, দৌড়-ঝাঁপসহ নানা দুরন্তপনায় মেতে থাকতেন যতীন। পড়াশুনায় ভাল, দুষ্টমিতে সেরা ও স্পষ্টভাষী, এসব গুণের কারণে যতীন তাঁর সহপাঠী ও শিক্ষক মহলে প্রিয় হয়ে উঠেছিলেন। পাড়া-মহল্লা ও স্কুলে নাটকে অভিনয়ও করতেন তিনি