অনলাইন ডেস্ক:
করোনাভাইরাসের সংক্রমণ আবার ভয়ানকভাবে চেপে ধরেছে বিশ্বের দেশগুলোকে। এর মধ্যে ভয়াবহ অবস্থা চলছে যুক্তরাষ্ট্রে। আক্রান্ত ও মৃত্যু ছাপিয়ে যাচ্ছে বিশ্বের অন্য সব দেশকে। এমনকি প্রথম দফার পরিস্থিতির চেয়ে এবার আরো বেশি অবনতি ঘটেছে; দিনে আক্রান্ত হচ্ছে প্রায় আড়াই লাখ, আর মৃত্যু হচ্ছে তিন হাজার থেকে সাড়ে তিন হাজার মানুষের। পাশাপাশি ব্রাজিল, তুরস্ক, ভারত, রাশিয়া, জার্মানি, যুক্তরাজ্য, ফ্রান্স, ইউক্রেন, মেক্সিকো, ইরান, কানাডা, দক্ষিণ আফ্রিকা, পর্তুগাল, রোমানিয়া, ইন্দোনেশিয়া, আর্জেন্টিনা, হাঙ্গেরি, অস্ট্রিয়ার মতো দেশগুলোতে প্রতিদিন ১০০ থেকে ৮০০ জনেরও বেশি মানুষ মারা যাচ্ছে। যুক্তরাষ্ট্রের পর বেশি বিপর্যস্ত দেশ ব্রাজিল, মেক্সিকো, পোল্যান্ড, রাশিয়া, যুক্তরাজ্য, ইতালি, জার্মানি ও ভারত।
বাংলাদেশে এখনো করোনার প্রথম ঢেউ শেষ হয়নি বা দৈনিক শনাক্ত ৫ শতাংশের নিচে তো দূরের কথা, ১০ শতাংশের নিচেও নামেনি; বরং উল্টো ওপরে উঠতে শুরু করে মাঝপথ থেকেই। এখন আবার হাসপাতালগুলোতে ভিড় বাড়ছে। যেখানে গত সেপ্টেম্বর-অক্টোবরে হাসপাতালের প্রায় ৭০-৭৫ শতাংশ বেড খালি ছিল, এখন সেখানে ঢাকার প্রায় ৭২ শতাংশ সাধারণ বেড ও ৯৩ শতাংশ আইসিইউ বেড পূর্ণ হয়ে থাকছে করোনায় আক্রান্ত রোগী দিয়ে। প্রাইভেট হাসপাতালেও চাপ বেড়েছে। স্বাস্থ্য অধিদপ্তর প্রয়োজনে যেকোনো সময়আবারও অস্থায়ী আইসোলেশন সেন্টার ও হাসপাতাল স্থাপনের জন্য সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তাদের প্রস্তুত থাকতে বলেছে। বিশেষজ্ঞরা অন্যান্য সুরক্ষামূলক পদক্ষেপের ওপরেও জোর দিয়েছেন।
এদিকে টিকা পাওয়ার দৌড়ে আরো এগোচ্ছে মানুষ। যুক্তরাজ্যের পর এবার ফাইজার বায়োএনটেকের ভ্যাকসিন অনুমোদন করার পক্ষে বৃহস্পতিবার সিদ্ধান্ত নিয়েছে যুক্তরাষ্ট্রের খাদ্য ও ওষুধ প্রশাসন (এফডিএ)। অন্যদিকে দেশটির মডার্না ভ্যাকসিনের অনুমোদন যেকোনো সময় মিলে যেতে পারে বলে জানিয়েছেন যুক্তরাষ্ট্রপ্রবাসী একাধিক বাংলাদেশি বিজ্ঞানী। এফডিএ অনুমোদন সাপেক্ষে ২১ ডিসেম্বর থেকে মডার্না ভ্যাকসিন উন্মুক্ত করে দেওয়া হতে পারে।
অন্যদিকে ভারত একাধারে তিনটি ভ্যাকসিন চলতি সপ্তাহের মধ্যেই অনুমোদন দিয়ে দিতে পারে বলে জানা গেছে। গত বুধবার সে দেশের ওষুধ প্রশাসন বৈঠক করে সেরাম ইনস্টিটিউটে উৎপাদিত অক্সফোর্ড-অ্যাস্ট্রাজেনেকা, ভারত বায়োটেক ও ফাইজারের ভ্যাকসিনের অনুমোদনের বিষয় নিয়ে আলোচনা করেছে। চলতি সপ্তাহের মধ্যেই ওই টিকাগুলোর অনুমোদন মিলে যেতে পারে বলে ধারণা করছেন সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা।
ভ্যাকসিন নিয়ে এমন অগ্রগতির মধ্যে বাংলাদেশে করোনার সংক্রমণ কোন পথে চলছে কিংবা করোনার টিকা কবে দেশে আসবে, তা নিয়ে আলোচনা চলছে সব মহলে। স্বাস্থ্যমন্ত্রী জাহিদ মালেক একাধিকবার জানিয়েছেন, জানুয়ারিতে অক্সফোর্ডের টিকা বাংলাদেশ আসবে। তার পরও মানুষের মধ্যে স্বস্তির লক্ষণ নেই।
এদিকে করোনায় মৃত্যু প্রায় এক মাস ধরে ঊর্ধ্বমুখী রয়েছে। তবে গত ২০ দিনের মধ্যে গতকাল মৃত্যুর সংখ্যা ২০ জনের নিচে নামে (১৯)। অন্যদিকে বিশেষজ্ঞরা তাগিদ দিয়েছেন, প্রতিদিন উপসর্গ নিয়ে আসা ব্যক্তিদের মধ্যে করোনা পরীক্ষায় প্রায় ৯০ শতাংশের রেজাল্ট যে নেগেটিভ আসে, তাদের কেন করোনার মতো উপসর্গ বা কোন রোগে তারা অসুস্থ হয়েছে, তা খুঁজে বের করা উচিত। স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের সর্বশেষ হিসাব অনুযায়ী দেখা যায়, গতকাল সকাল ৮টা পর্যন্ত আগের ২৪ ঘণ্টায় করোনা টেস্ট করিয়েছে ১৬ হাজার ৬৪৪ জন। এর মধ্যে পজিটিভ হয়েছে এক হাজার ৮৮৪ জন বা ১১.৫৪ শতাংশ। ফলে প্রশ্ন উঠেছে, বাকিদের মধ্যে কেন উপসর্গ দেখা দিয়েছে। এ ক্ষেত্রে যাদের উপসর্গ আছে কিন্তু ফল নেগেটিভ আসছে, তাদের মধ্যে নানা ধরনের সংশয় তৈরি হচ্ছে এবং অনেকেই ভিন্ন জায়গায় গিয়ে পুনরায় পরীক্ষা করাচ্ছে, যা একদিকে প্রকৃত পরীক্ষার সংখ্যা বাড়িয়ে দিচ্ছে। অন্যদিকে মানুষের হয়রানিও বাড়ছে এবং সেই সঙ্গে প্রয়োজনীয় চিকিৎসা ব্যাহত হচ্ছে।
আইইডিসিআরের উপদেষ্টা ডা. মোস্তাক হোসেন বলেন, ‘ভ্যাকসিন কবে আসবে না আসবে, এর অপেক্ষায় না থেকে আমাদের অবশ্যই জোরালো পরিকল্পনা অনুসারে এগিয়ে যেতে হবে। বিশেষ করে রোগী শনাক্ত, আইসোলেশন, কোয়ারেন্টিনের ওপর জোর দিতেই হবে। যতক্ষণ পর্যন্ত রোগী বৃদ্ধির উৎস বন্ধ করা না যাবে ততক্ষণ কোনো কিছু করেই লাভ হবে না। এ ক্ষেত্রে স্বাস্থ্যবিধি মানার পাশাপাশি নির্দিষ্ট জনবহুল এলাকাগুলোতে আবারও কিছু নিয়ন্ত্রণমূলক পদক্ষেপ নিতে হবে। পাশাপাশি প্রশাসনিক, প্রাতিষ্ঠানিক ও পারিবারিক সচেতনতা বৃদ্ধির জন্য প্রয়োজনীয় অন্য কৌশলগুলো বাস্তবায়ন করতে হবে। তা না করতে পারলে অন্যান্য দেশের মতো বাংলাদেশের পরিস্থিতিও খারাপ অবস্থায় যেতে পারে।’
এদিকে এখন সরকারি হাসপাতালে প্রায় ৭১ শতাংশ সাধারণ বেড ও ৯৩ শতাংশ আইসিইউ বেড রোগীপূর্ণ। অর্থাৎ দুই হাজার ৩৫৭ সাধারণ বেডের মধ্যে এক হাজার ৬৭০ বেডে রোগী আছে এবং ১৩৩ আইসিইউ বেডের মধ্যে ১০৪ বেডে রোগী আছে। প্রাইভেট হাসপাতালে রোগীর চাপ কিছুটা কম হলেও সেখানে গত কয়েক দিনে রোগীর সংখ্যা অনেক বেড়ে গেছে। ঢাকায় করোনা চিকিৎসা হয় এমন ১৯টি সরকারি ও বেসরকারি হাসপাতালের মধ্যে ১০টি হাসপাতালেই গতকাল কোনো আইসিইউ খালি ছিল না। আর ওই ১০ হাসপাতালেই আইসিইউ পাওয়ার জন্য রোগীরা হন্যে হয়ে ঘুরতে থাকে বেশি।
সরকার গঠিত কোনো ভাইরাস মোকাবেলায় জাতীয় কারিগরি পরামর্শক কমিটির হাসপাতাল ব্যবস্থাপনা বিষয়ক অন্যতম পরামর্শক অধ্যাপক ডা. এম ইকবাল হোসেন কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘আমরা বাইরের দেশগুলো পর্যবেক্ষণ করে কয়েক দিন আগেই সরকারকে কিছু পরামর্শ দিয়েছি। আশা করি, সরকার সেগুলো বাস্তবায়নে সচেষ্ট হবে। আমরা হয়তো আবারও দ্রুত সময়ের মধ্যে সভা করে আরো কিছু পরামর্শ দেব।’ তিনি আরো বলেন, হাসপাতালে রোগীর সেবা ব্যবস্থাপনাকে আরো গুরুত্ব দেওয়া দরকার। সঙ্গে কর্তব্যরত চিকিৎসক ও অন্যান্য চিকিৎসাকর্মীদের সুরক্ষার দিকেও নজর দিতে হবে।
স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের অতিরিক্ত মহাপরিচালক অধ্যাপক ডাক্তার নাসিমা সুলতানা বলেন, ‘আমরা সার্বক্ষণিক বাইরের পরিস্থিতির দিকে নজর রাখছি। আমাদের দেশেও প্রতিদিন কোথায় কিভাবে সংক্রমণ হচ্ছে, কী পরিমাণ শনাক্ত হচ্ছে, সেগুলো আমরা মনিটরিং করছি। বিভিন্ন ধরনের অভিযান যেমন হচ্ছে আবার সাধারণ মানুষের মধ্যে মাস্ক বিতরণ করা হচ্ছে। তবে মাঝে কয়েক দিন সংক্রমণ ও শনাক্ত বাড়লেও এখন আবার তা কমের দিকে আছে। বিশেষ করে অন্য দেশগুলোর যে অবস্থা তার তুলনায় এখনো আমরা অনেক ভালো আছি।’ এই কর্মকর্তা আরো বলেন, সামনে পরিস্থিতি অনুসারে প্রয়োজনে এলাকায় এলাকায় আরো আইসোলেশন সেন্টার কিংবা অন্যান্য ব্যবস্থা যাতে দ্রুত সময়ের মধ্যে নেওয়া যায়, সে জন্যও আমরা প্রস্তুতি নিচ্ছি।’