অনলাইন ডেস্ক:
সরকারের দীর্ঘ প্রচেষ্টার পর অবশেষে রোহিঙ্গাদের একটি দল কক্সবাজার থেকে নোয়াখালীর ভাসানচরে যাচ্ছে। গতকাল বৃহস্পতিবার তারা কয়েকটি বাসে করে কক্সবাজার রোহিঙ্গা শিবির থেকে চট্টগ্রামের উদ্দেশে রওনা হয়। আজ শুক্রবার চট্টগ্রাম থেকে তাদের ভাসানচরে যাওয়ার কথা।
সরকারি সূত্রগুলো বলছে, রোহিঙ্গাদের ভাসানচরে স্থানান্তরের পুরো প্রক্রিয়া ছিল ঐচ্ছিক। যারা যেতে আগ্রহী, শুধু তাদেরই স্থানান্তরের ব্যবস্থা করা হয়েছে। তবে এই স্থানান্তরের ক্ষেত্রে আন্তর্জাতিক বিভিন্ন বেসরকারি সংস্থাসহ (আইএনজিও) স্বার্থান্বেষী কিছু মহলের অব্যাহত নেতিবাচক প্রচারণার কারণে বেশ বেগ পেতে হয়েছে। পররাষ্ট্রমন্ত্রী ড. এ কে আব্দুল মোমেন সাম্প্রতিক মাসগুলোতে প্রকাশ্যেই বলেছেন, এই এনজিওগুলোই রোহিঙ্গাদের ভাসানচরে স্থানান্তরে মূল বাধা। মূলত আইএনজিওগুলো নিজেদের স্বার্থে কক্সবাজার ছেড়ে ভাসানচরে যেতে চায় না এবং রোহিঙ্গাদেরও নিরুৎসাহ করে।
সরকারের উচ্চপর্যায়ে কথা বলে জানা গেছে, রোহিঙ্গাদের ভাসানচরে স্থানান্তরের বিষয়টিও তাদের এ দেশে আশ্রয় দেওয়ার মতো সাময়িক। রোহিঙ্গাদের মিয়ানমারে প্রত্যাবাসনের ওপরই সরকার জোর দিচ্ছে। বাংলাদেশ ও মিয়ানমারকে নিয়ে প্রত্যাবাসন আলোচনা আবার শুরু করতে চীন কাজ করছে। এই প্রক্রিয়ায় যুক্ত হতে আগ্রহ দেখিয়েছে ভারত। মিয়ানমারে প্রত্যাবাসনের আগে রোহিঙ্গাদের এ দেশে দীর্ঘ সময় অবস্থান করতে হতে পারে। মূলত কক্সবাজারের ওপর পরিবেশগত চাপ ও ক্রমবর্ধমান নিরাপত্তাঝুঁকি মোকাবেলায় সরকার প্রায় এক লাখ রোহিঙ্গাকে ভাসানচরে স্থানান্তরের পরিকল্পনা নিয়েছে। প্রথম দফায় আজ প্রায় আড়াই হাজার রোহিঙ্গাকে স্থানান্তর করা হতে পারে। আগামী দিনে পর্যায়ক্রমে আগ্রহী অন্য রোহিঙ্গাদের এভাবে ভাসানচরে নেওয়ার পরিকল্পনা আছে সরকারের।
গতকাল উৎসবমুখর পরিবেশের মধ্য দিয়েই শুরু হয় রোহিঙ্গাদের বহুল আলোচিত ভাসানচরমুখী স্বেচ্ছাযাত্রা। কক্সবাজারের উখিয়া ও টেকনাফের রোহিঙ্গা শিবির থেকে স্বেচ্ছায় রোহিঙ্গাদের সেখানে যাত্রার প্রথম দিনেই যেন ঢল নামে। কার আগে কে গাড়িতে উঠবে—এমনই এক দৃশ্য দেখা গেছে উখিয়া কলেজ মাঠের ট্রানজিট ক্যাম্পে।
গত কিছুদিন ধরে দফায় দফায় শিবিরগুলোর রোহিঙ্গা নেতা এবং বেসরকারি উন্নয়ন সংস্থার (এনজিও) প্রতিনিধিরা ভাসানচর পরিদর্শন করে আসছিলেন। সেই থেকে ভাসানচর সম্পর্কে রোহিঙ্গাদের মধ্যে ইতিবাচক মনোভাব সৃষ্টি হয়। ভাসানচর ঘুরে দেখা রোহিঙ্গা নেতা ও এনজিও প্রতিনিধিদের কাছ থেকে সেখানে বসবাসসহ নানা বিষয়ে জেনে রোহিঙ্গাদের অনেকে সেখানে যাওয়ার জন্য ইচ্ছা প্রকাশ করে আসছিল।
এ প্রসঙ্গে গতকাল সন্ধ্যায় রোহিঙ্গা নেতা মাস্টার সোহেল বলেন ‘আজ (বৃহস্পতিবার) প্রথম দিনেই অন্তত ১০ হাজার রোহিঙ্গা স্বেচ্ছায় ভাসানচরে যেতে প্রস্তুত ছিল। কিন্তু সে রকম ব্যবস্থা না থাকায় শিবিরে অবস্থানরত ভাসানচরে যেতে ইচ্ছুকদের বারণ করেছি। তাদের বুঝিয়ে বলা হয়েছে, আরো কটা দিন অপেক্ষা করার জন্য। পর্যায়ক্রমে তারাও যেতে পারবে।’
মাস্টার সোহেলও তাঁর পরিবারের পাঁচ সদস্য নিয়ে বাসে করে যাচ্ছিলেন চট্টগ্রাম। কক্সবাজারের উখিয়া থেকে রোহিঙ্গাবোঝাই বাসের সে এক দীর্ঘ বহর। সেই বহর থেকেই সোহেল মোবাইল ফোনে কথা বলছিলেন। রোহিঙ্গা নেতা বলেন, তিনি ২০১৭ সালের আগস্ট-পরবর্তী সময়ে সীমান্ত পাড়ি দিয়ে উখিয়ার কুতুপালং শিবিরের ঘিঞ্জি বস্তিতে আশ্রয় নেন। এমন পরিবেশে জীবন বিষিয়ে উঠেছে। তাই ভাসানচরে যাত্রা।
কুতুপালং ২ নম্বর শিবিরের রোহিঙ্গা শেড মাঝি ফয়েজ বলেন, ‘আমরা কেবল আমাদের সুবিধার জন্য ভাসানচরে যাচ্ছি না। উখিয়া-টেকনাফের শিবিরের ভারী পরিবেশকে একটু হালকা করার জন্যই ভাসানচরে যাওয়া। এতে করে আমাদের যেমন উপকার হবে, তেমনি স্থানীয় বাসিন্দারাও উপকৃত হবে।’ রোহিঙ্গা মাঝি ফয়েজ বলেন, ভাসানচরে গেলে কী উপকার হবে তা এত দিন রোহিঙ্গারা বুঝতে পারেনি। এ কারণেই সেখানে যেতে এত বিলম্ব। তিনি মনে করেন, সামনে এত বেশিসংখ্যক রোহিঙ্গা ভাসানচরে যেতে ইচ্ছুক হবে যে সেখানে স্থান সংকুলান করা যাবে কি না তা বলা মুশকিল।
কুতুপালং শিবিরের নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক একজন রোহিঙ্গা জানান, তিনি প্রথম দফায় যাওয়ার সুযোগ পাননি। তবে আগামী কয়েক দিনের মধ্যেই পুরো পরিবারসহ যেতে চান। তিনি বলেন, ‘ভাসানচরে গরু-মহিষ, ছাগল ও মুরগি পালনের জায়গা রয়েছে। সেখানে গেলে ক্ষেত-খামার করতে পারব। মাছ ধরে খেতে পারব। নিশ্চিন্তে ঘুমাতে পারব পাকা দেয়াল ও টিনের চালের ঘরে। ইচ্ছামতো পিঠে রোদ ও বাতাস লাগানো যাবে। তাই কুতুপালংয়ের ঘিঞ্জি পরিবেশ ছেড়ে যেতে চাই।’
অন্যদিকে এত দিন পর রোহিঙ্গাদের ভাসানচরমুখী যাত্রায় স্থানীয় এলাকাবাসীও বেজায় খুশি। ২০১৭ সালের ২৫ আগস্ট থেকে মিয়ানমারের রাখাইন থেকে আসা রোহিঙ্গা ঢলের কারণে কক্সবাজারের উখিয়া-টেকনাফের স্থানীয়রাও নানাভাবে দুর্ভোগের শিকার হচ্ছিল। এলাকার লোকজন গতকাল ভাসানচরমুখী রোহিঙ্গাবোঝাই বাসের বহর দেখে আনন্দে মেতে ওঠে।
উখিয়ার রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসন সংগ্রাম কমিটির সাধারণ সম্পাদক নুর মোহাম্মদ সিকদার বলেন, “বাস্তবে রোহিঙ্গারা শিবিরের বস্তি থেকে বের হতে পেরে যেন নিজ দেশে ফিরে যাওয়ার মতো আনন্দ উপভোগ করছে। তারা যেন এত দিন ‘মিনি কারাগারে’ বন্দি ছিল। এমন পরিবেশ থেকে এক উন্নত পরিবেশে যাচ্ছে তারা।” তিনি মনে করেন, ভাসানচরে কিছু রোহিঙ্গা গিয়ে অন্তত স্থানীয় বাসিন্দাসহ অন্য রোহিঙ্গাদের কিছুটা হলেও হালকা করবে।
ভাসানচরে বাংলাদেশ নৌবাহিনীর তত্ত্বাবধানে নির্মাণ করা হয়েছে আশ্রয়ণ-৩ প্রকল্প। ২০১৭ সালের আগস্ট মাসের শেষ দিকে নতুন করে জেনোসাইড, গণহত্যা, জাতিগত নির্মূল অভিযান শুরু হলে বাস্তুচ্যুত, নিপীড়িত রোহিঙ্গাদের জন্য এ দেশের সীমান্ত খুলে দিয়েছিলেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। প্রায় ১২ লাখ রোহিঙ্গার চাপে কক্সবাজারের জনজীবন ও পরিবেশে বিরূপ প্রভাব পড়েছে। প্রধানমন্ত্রী ২০১৭ সালের শেষ দিকে রোহিঙ্গাদের একটি অংশকে স্থানান্তরের জন্য ভাসানচরকে প্রস্তুত করার নির্দেশনা দেন। ওই বছরেরই নভেম্বর মাসে ভাসানচরে আশ্রয়ণ-৩ প্রকল্প অনুমোদন দেওয়া হয়। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সরকার তিন হাজার ৯৫ কোটি টাকা ব্যয়ে ভাসানচর গড়ে তুলেছে রোহিঙ্গাদের সাময়িক আশ্রয় স্বচ্ছন্দ ও নিরাপদ করতে। সে জন্য সব ব্যবস্থাই রাখা হয়েছে ভাসানচরে।