মানুষ যখন নিজেই নিজের মৃত্যু ঘটায়, তখন এটিকে আত্মহত্যা বলে। আত্মহত্যা যেন রূপ নিয়েছে মানসিক ব্যাধিতে। সমাধানের পথ না খুঁজে, চেষ্টা না করে আত্মহত্যাকেই যেন সমাধান বানিয়ে নিচ্ছেন কেউ কেউ। সাম্প্রতিক সময়ে তরুণদের মধ্যে আত্মহত্যার প্রবণতা বৃদ্ধি পেতে দেখা যাচ্ছে। বিশেষ করে তরুণ-শিক্ষার্থীরা আত্মহত্যার পথ বেছে নেয়ায় তা সচেতন মহলের নিকট উদ্বেগের কারণ হয়ে দাঁড়াচ্ছে। সম্প্রতি চলতি বছরের ৯ই নভেম্বর যশোর শহরের খড়কী এলাকায় আত্মহত্যা করেন শেরেবাংলা কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী জুলহাস সিলভিয়া। এর আগে ২রা নভেম্বর আত্মহত্যা করেন জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের বায়োটেকনোলজি অ্যান্ড জেনেটিক ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগের প্রথম বর্ষের শিক্ষার্থী ফাতেমা এলিন ফুজি। রাজশাহী মহানগরীর বোয়ালিয়া এলাকায় তার বান্ধবীর মেসে গলায় রশি পেঁচিয়ে আত্মহত্যা করেন। এর আগেও তিনি আত্মহত্যার চেষ্টা করেছিলেন বলে জানা গিয়েছে। গত ২৬শে অক্টোবর পাবনার আটঘরিয়ায় জানালার গ্রিলের সঙ্গে ওড়না পেঁচিয়ে আত্মহত্যা করেন ফারিয়া তাবাসসুম রুম্পা নামক একজন শিক্ষার্থী। তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইংরেজি বিভাগের চতুর্থ বর্ষে অধ্যয়ন করেতেন। চলতি বছরের আগস্ট মাসের ১৭ তারিখ নিজের ফেসবুক একাউন্ট থেকে ‘আল বিদা’ স্ট্যাটাস দিয়ে আত্মহত্যা
করেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ২০১৮-১৯ শিক্ষাবর্ষের শিক্ষার্থী ইমাম হোসেন। পরবর্তীতে তার দুই শব্দের ওই স্ট্যাটাস শেয়ার করা হয়েছিলো কয়েক হাজার বার। এছাড়াও তার বন্ধুমহল, সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমের বিভিন্ন সদস্যবহুল গ্রুপ, জনপ্রিয় পেজ থেকেও। এই ঘটনার পক্ষে-বিপক্ষে স্ট্যাটাস দিয়ে, অনেকেই বিশ্লেষণ করার চেষ্টা করেছেন। গণমাধ্যমে প্রকাশিত সংবাদ থেকে জানা যায়, প্রেম সম্পর্কে অবনতি ঘটায় তিনি মানসিকভাবে বিষন্নতা ও
নিঃস্বঙ্গতায় থাকেন এবং আত্মহত্যার পথ বেছে নেন। গতবছরের ১৪ই জানুয়ারি আত্মহত্যা করেছিলেন স্নাতকে ১ম হওয়া শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের ২০১১-১২ শিক্ষাবর্ষের শিক্ষার্থী তাইফুর রহমান প্রতিক। একইবছরের ৭ই ফেব্রুয়ারি আত্মহত্যা করেছিলেন রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী ফিরোজ কবির। ফলাফল খারাপ হওয়ায় ২৯শে মার্চ আত্মহত্যা করেছিলেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী সবুজ মিত্র। ২০১৯ সালের ২২শে এপ্রিল আত্মহত্যা করেছিলেন রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী প্রিয়াঙ্কা সাহা ২০১৯ সালের ৮ই জুন আত্মহত্যা করেছিলেন জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী রাসেল হোসাইন। ১লা জুলাই প্রেম ঘটিত কারণে আত্মহত্যা করেছিলেন চট্টগ্রাম ভেটেরিনারি এণ্ড এনিমেল সাইন্সের শিক্ষার্থী রায়হান উদ্দীন সজিব। একই বছরের ২৯শে আগস্ট আত্মহত্যা করেছিলেন জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলাম বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী জারমিন আক্তার জুঁই। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার ‘প্রিভেন্টিং সুইসাইড: অ্যা সোর্স ফর মিডিয়া প্রফেশনালস ২০১৭’ জরিপ বলছে, ‘প্রতিবছর
বিশ্বে ১০ লক্ষ মানুষ আত্মহত্যা করে। প্রতি ৪০ সেকেন্ডে আত্মহত্যার ঘটনা ঘটে একটি’। আরও একটি জরিপ বলছে, ‘গত ৪৫ বছরে আত্মহত্যার ঘটনা ৬০ শতাংশ বেড়েছে। বিশ্বে বর্তমানে ১৫ থেকে ৪৪ বছর বয়সী মানুষের মৃত্যুর প্রধান তিনটি কারণের মধ্যে একটি হচ্ছে আত্মহত্যা’। এ প্রসঙ্গে বাংলাদেশের পরিসংখ্যানের দিকে দৃষ্টিপাত করলে দেখা যায়, ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশের (ডিএমপি) তথ্য অনুযায়ী, ২০১৬ সালে দেশে আত্মহত্যা করেন ১০ হাজার ৭৪৯ জন। আর ২০১৭ সালে নভেম্বর পর্যন্ত এ সংখ্যা ছিল ১০ হাজার ২৫৬ জন। বছর শেষে এ সংখ্যা নিশ্চিতভাবেই বেড়েছে। এ হিসাব অনুযায়ী, দেশে প্রতিদিন গড়ে ২৯ জনের বেশি আত্মহত্যা করছেন। যাদের মধ্যে তরুণ-তরুণীর সংখ্যাই বেশি। অপরদিকে এক পরিসংখ্যানে দেখা গেছে, ২০১৮ সালে দেশে ১১ হাজারেরও বেশি মানুষ আত্মহত্যা করেছেন।
আশঙ্কা করা হচ্ছে, ২০২০ সালে এ সংখ্যা প্রতি ২০ সেকেন্ডে একজনে পৌঁছাবে। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা আশঙ্কা প্রকাশ করেছে যে, ২০২০ সাল নাগাদ বিশ্বে প্রতিবছর সাড়ে ১৫ লক্ষ মানুষ আত্মঘাতী হবেন। আত্মহত্যার চেষ্টা চালাবেন এর কমপক্ষে ১০ থেকে ২০ গুণ মানুষ।
আত্মহত্যা করা ঢাবি শিক্ষার্থী ইমাম হোসাইনের সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমের একাউন্ট ঘুরে দেখা গিয়েছে, আত্মহত্যার অনেক দিন আগ থেকে তার দেয়া সব স্ট্যাটাসেই প্রকাশ পেয়েছিলো তার মানসিক বিষন্নতা, নিঃসঙ্গতার কথা। অথচ তার আত্মহত্যার পর ওই একটি স্ট্যাটাস যত শেয়ার হয়েছে, যতজন সহানুভূতি বা আফসোস প্রকাশ করেছেন, তার মধ্য থেকে গুটিকয়েক বন্ধুও যদি সময় থাকতেই তাকে সঙ্গ দিত! তার সমস্যাগুলো শুনে তাকে সঠিক পরামর্শ দিত, সমস্যা সমাধানে সহায়তা করত! তাহলে হয়তো নিজেকে হত্যা করে
পৃথিবী থেকে বিদায় নিতে হতো না ইমামকে। বিশ্ববিদ্যালয় পড়ুয়া মেধাবী শিক্ষার্থীরা কেন আত্মহত্যা করেন? বিশেষজ্ঞদের মতে আত্মহত্যার অনেক কারণের মধ্যে একটি হলো, মানসিক চাপ। এ চাপ বেশি হয়ে গেলে কারো কারো মনে হয়, তিনি আর সমস্যার সমাধান
করতে পারছেন না, পরিস্থিতির সঙ্গে খাপ খাওয়াতে পারছেন না। এছাড়া বিষণ্নতায় যারা ভোগেন, জীবন নিয়ে তাদের মধ্যেও নেতিবাচক ধারণা কাজ করে। বিষন্নতায় ভোগা ব্যক্তি নিজেকে একটা সময় অযোগ্য, অবহেলিত, প্রয়োজনহীন ভাবতে শুরু করে, কমে যায় বেঁচে থাকার ইচ্ছে। তারপর কাছের কারো সাপোর্ট না পেয়ে একপর্যায়ে আত্মহত্যার পথটাই তার কাছে সহজ মনে হয়৷ এছাড়া, বিষন্নতা, শিক্ষাজীবন নিয়ে হতাশা, সম্পর্কের সমস্যা,
চাকরি ক্ষেত্রে অনিশ্চয়তার কারণেও আত্মহত্যার পথ বেছে নেন অনেকে। কোনো কারণ ছাড়া, সংকেত ছাড়া হুটহাট করে কেউ আত্মহত্যা করে না। তার আচার-আচরণ, কথাবার্তায়
সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে শেয়ার করা স্ট্যাটাসে তা প্রকাশ পেতে পারে। এক গবেষণায় দেখা গেছে, আত্মহত্যাকারীদের দুই-তৃতীয়াংশই নিজেদের ইচ্ছা সম্পর্কে আগেই অন্যের নিকট বিশেষকরে বন্ধুদের নিকট কমবেশি তথ্য দেয়। সেসব তথ্য গুরুত্ব দিয়ে যথাযথ কাউন্সেলিংয়ের মাধ্যমে অনেক ক্ষেত্রে দুর্ঘটনা এড়ানো সম্ভব বলে মনে করেন বিশেষজ্ঞরা।
এক্ষেত্রে প্রিয়জন, কাছের বন্ধুরা, নিকটাত্মীয়রা তাকে বুঝার চেষ্টা করে, তার কথাগুলো মনোযোগ দিয়ে শুনে, সমস্যা সমাধানের চেষ্টার মাধ্যমে এ চিন্তা থেকে ফেরাতে পারে। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমের ফলোয়ার বহুল গ্রুপ, পেজ থেকে আলোচিত কোনো আত্মহত্যার পর কেবল সহানুভূতি প্রকাশ করে, আবেগপূর্ণ স্ট্যাটাসেই সীমাবদ্ধ না থেকে, আত্মহত্যায় উদ্বুদ্ধ না হওয়ার প্রচারণায়ও ভূমিকা রাখতে হবে। খারাপ সময়, ঘাত-প্রতিঘাত
জীবনে আসবেই, তার মোকাবেলা করতে হবে। মানসিকভাবে সুস্থ থাকার জন্য সুন্দর পারিবারিক পরিবেশ এবং বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক অতি গুরুত্বপূর্ণ। ক্ষেত্র বিশেষে অন্যকে ছাড় দেয়া শিখতে হবে, ভালোবাসতে হবে নিজেকে, প্রিয়জনকে। স্বপ্ন দেখতে হবে বাঁচার, বাঁচানোর।
- লেখক: আব্দুল্লাহ আলম নুর