অনলাইন ডেস্ক:
করোনাভাইরাস মহামারির মধ্যে ব্যস্ত রাজধানীতে গতকাল বৃহস্পতিবার হঠাৎ আগুন সন্ত্রাসে বিস্ময় ও উৎকণ্ঠা ছড়িয়ে পড়ে। বিভিন্ন এলাকায় একের পর এক যাত্রীবাহী বাসে আগুন জ্বলে ওঠে। দুপুর ১২টা থেকে সন্ধ্যা ৬টা পর্যন্ত্ত বিভিন্ন স্থানে দাঁড়িয়ে থাকা ও চলন্ত ১১টি বাসে অগ্নিসংযোগের ঘটনা ঘটে। দুর্বৃত্তরা যাত্রী সেজে বাসে উঠে গানপাউডার বা এ জাতীয় বিস্ফোরক দিয়ে আগুন ধরিয়ে দেয়—এ রকম আলামত পাওয়া গেছে বলে দাবি পুলিশের। বেশির ভাগ ক্ষেত্রে বাসের পেছনের অংশে আগুন লাগিয়ে দেওয়া হয়। তিনটি স্থানে ককটেল বিস্ফোরণের ঘটনাও ঘটেছে। তবে এসব ঘটনায় কোনো হতাহতের খবর পাওয়া যায়নি।
বাসে আগুন দেওয়া ও বিস্ফোরণের ঘটনায় সন্দেহভাজন হিসেবে যুবদলের মিছিল থেকে ৯ জনসহ ২০ জনকে আটক করা হয়েছে।
গতকাল ছিল ঢাকা-১৮ ও সিরাজগঞ্জ-১ আসনের উপনির্বাচন। উপনির্বাচন ঘিরেই রাজধানীর অন্য এলাকায় নাশকতা চালানো হয়েছে বলে দাবি পুলিশের। দুপুর থেকেই রাজধানীতে নিরাপত্তা জোরদার করা হয়েছে বলে জানিয়েছেন পুলিশ কর্মকর্তারা।
গণপরিবহনের যাত্রী, চালকসহ ক্ষতিগ্রস্তরা বলছে, ২০১৩-১৪ সালে দশম জাতীয় সংসদ নির্বাচন ঘিরে হরতাল ও অবরোধে যেভাবে বাসে অগ্নিসংযোগ করা হয়, সেভাবেই গতকাল হঠাৎ আগুন দেওয়া শুরু হয়। এ ঘটনায় উৎকণ্ঠার সঙ্গে বিস্ময়ও প্রকাশ করেছে সবাই। কারণ ওই নির্বাচনের পর গত কয়েক বছরে যানবাহনে এমন অগ্নিসংযোগের ঘটনা ঘটেনি। সম্প্রতি ঢাকা-১০ ও ঢাকা-৫ আসনের উপনির্বাচন হয়েছে। সে সময়েও এমন নাশকতা হয়নি।
অগ্নিসংযোগের এ ঘটনাকে বিএনপি-জামায়াতের সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ড বলে অভিযোগ করেছেন ক্ষমাতসীন আওয়ামী লীগের নেতারা।
অন্যদিকে ঢাকা-১৮ আসনের উপনির্বাচন প্রত্যাখ্যান করে আবার নির্বাচন দেওয়ার দাবি জানিয়েছে বিএনপি। নাশকতার ঘটনাকে ‘সরকারের নীলনকশা’ বলে অভিহিত করেছেন দলটির নেতারা।
ঢাকা মহানগর পুলিশের উপকমিশনার (মিডিয়া) ওয়ালিদ হোসেন সন্ধ্যায় বলেন, নাশকতা সৃষ্টির লক্ষ্যে দুর্বৃত্তরা পরিকল্পিতভাবে ৯টি স্থানে বাসে আগুন দিয়েছে। ধারণা করা হচ্ছে, এসব ঘটনা ঢাকা-১৮ আসনে চলমান উপনির্বাচন কেন্দ্র করে। সিসি ক্যামেরার ফুটেজ সংগ্রহ, প্রত্যক্ষদর্শী এবং বিভিন্ন স্থানে দায়িত্বরত পুলিশ সদস্যদের সহযোগিতায় জড়িত ব্যক্তিদের শনাক্ত করার চেষ্টা চলছে। কয়েকজনকে শনাক্ত করা গেছে। জানতে চাইলে তিনি বলেন, কয়েকটি স্থানে ককটেলের বিস্ফোরণ ঘটানো হয়েছে। গানপাউডার বা এজাতীয় বিস্ফোরক ব্যবহারের আলামত পাওয়া গেছে। কয়েকটি স্থানে দুর্বৃত্তরা যাত্রীবেশে বাসে ওঠে। আবার দাঁড়ানো সরকারি গাড়িতেও আগুন দেয় তারা। সন্দেহভাজন কয়েকজনকে আটকও করা হয়েছে। প্রতিটি ঘটনায় আলাদা মামলা দায়েরের প্রক্রিয়া চলছে।
ঢাকা মহানগর পুলিশের (ডিএমপি) তথ্য মতে, দুপুর ১২টা ৫ মিনিটে পল্টন থানার বিএনপি অফিসের উত্তর পাশে কর অঞ্চল ১৫-এর পার্কিং করা সরকারি বাসে অগ্নিসংযোগের ঘটনা ঘটে। দুপুর ১টার দিকে মতিঝিলের মধুমিতা সিনেমা হলের সামনে অগ্রণী ব্যাংকের স্টাফ বাস, ১টা ২৫ মিনিটে গুলিস্তানে বঙ্গবন্ধু এভিনিউয়ে রমনা হোটেলের সামনে ভিক্টর ক্লাসিক পরিবহনের চলন্ত বাস, দেড়টায় শাহবাগ আজিজ সুপার মার্কেটের সামনে দেওয়ান পরিবহনের বাস, ২টা ১০ মিনিটে সচিবালয়ের উত্তর পাশে রজনীগন্ধা পরিবহনের বাস এবং বংশাল থানার নয়াবাজার এলাকায় দুপুর ২টা ২৫ মিনিটে দিশারী পরিবহনের বাসে আগুন লাগানোর ঘটনা ঘটে। দুপুর ২টা ৪৫ মিনিটে পল্টন থানা এলকায় জৈনপুরী পরিবহনের বাস, বিকেল ৩টায় মতিঝিলে পূবালী পেট্রল পাম্প সংলগ্ন এলাকায় বিআরটিসির দোতলা বাস এবং বিকেল ৪টা ৩২ মিনিটে ভাটারা থানাধীন প্রগতি সরণির কোকা-কোলা মোড়ে ভিক্টর ক্লাসিক পরিবহনের আরেকটি বাসে আগুন দেওয়া হয়। প্রতিটি ঘটনায়ই পুলিশ ঘটনাস্থলে যায় এবং ফায়ার সার্ভিসের কর্মীরা গিয়ে আগুন নেভান।
তবে ফায়ার সার্ভিসের তথ্য মতে, দুপুর সাড়ে ১২টার দিকে প্রথম শাহজাহানপুর থানাধীন খিলগাঁও এলাকায় একটি বাসে অগ্নিকাণ্ড ঘটে। সন্ধ্যায় উত্তরার আজমপুর ফ্লাইওভারের কাছে আরেকটি বাসে আগুন লাগার খবর পাওয়া যায়। পুলিশের তথ্যের সঙ্গে এই হিসাব যোগ করলে মোট ১১টি বাসে অগ্নিসংযোগ করা হয়েছে।
ফায়ার সার্ভিসের জনসংযোগ কর্মকর্তা শাহজাহান সরদার বলেন, এক ঘণ্টার মধ্যেই ছয়টি বাসে আগুন লাগার খবর আসে।
শাহবাগে আগুনে পোড়া দেওয়ান পরিবহনের বাসের যাত্রী ছিলেন রফিকুল ইসলাম নামের এক ব্যবসায়ী। তিনি সাংবাদিকদের বলেন, ‘আমি গেটের কাছে বসে ছিলাম। সিগন্যালের কারণে বাস আস্তে চলছিল। হঠাৎ দেখি, পেছনে আগুন জ্বলছে। সবাই নেমে যাই। পুরো বাসটি পুড়ে গেছে।’
বাসটির চালক মো. রায়হান বলেন, ‘আমার ৪০ সিটের বাসে ১২-১৩ জন যাত্রী ছিলেন। দুপুর ২টার দিকে কাটাবন সিগন্যাল পার হওয়ার পরই হঠাৎ আমার গাড়ির পেছনের দিকটায় আগুন দেখতে পাই। তবে পেছনের সিটগুলো পুরো খালি ছিল। আগুন দ্রুত ছড়িয়ে পড়ে। নেভানো যায়নি।’
গুলিস্তান ও প্রেস ক্লাব এলাকার কয়েকজন প্রত্যক্ষদর্শী জানায়, জাতীয় প্রেস ক্লাবের সামনে রজনীগন্ধা পরিবহনের একটি বাসে আগুন ধরে গেলে যাত্রীরা তড়িঘড়ি করে নেমে যায়। কে বা কারা কিভাবে আগুন দিয়েছে, তাত্ক্ষণিক তা বোঝা যায়নি। সদরঘাটগামী ভিক্টর ক্লাসিক পরিবহনের বাসটিতে আগুন দেওয়ার সময় প্রথমেই পেছন দিক থেকে কয়েকজন যাত্রী নেমে গেছে। তাদের সন্দেহ করছে সবাই। ওই বাসের যাত্রী মাহমুদ বলেন, ‘পেছনে কয়েকটা ছেলে হঠাৎ করে নেমে যায়। এরপর দেখি পেছনে আগুন। এখন কি আবার আগুন সন্ত্রাস শুরু হলো কি না কে জানে।’
প্রগতি সরণির কোকা-কোলা এলাকায় আগুনের ঘটনার পর সেখানে থাকা বাসের যাত্রী রবিউল ইসলাম বলেন, ‘হঠাৎ করে কী হলো, বুঝলাম না। আবার কি আগুন সন্ত্রাস শুরু হলো?’
রাজধানী পরিবহনের চালক মমিন হোসেন বলেন, ‘২০১৩ সালে এক আগুন সন্ত্রাস দেখেছি। কত মানুষ মরল। এখন কি আবার সেই সন্ত্রাস? করোনার কারণে এমনেই যাত্রী পাই না। এই সব করলে না খাইয়া মরতে হইব আমাগো।’
পল্টন থানার ওসি আবু বক্কর সিদ্দিক জানান, পল্টনে যুবদলের মিছিল এবং এর আশপাশ থেকে অভিযান চালিয়ে ৯ জনকে আটক করেছে পুলিশ। অগ্নিকাণ্ডে তারা জড়িত কি না সেটা যাচাই-বাছাই করা হচ্ছে। তিনি আরো বলেন, সিসি ক্যামেরায় কয়েকজন মাস্ক পরা যুবক যাওয়ার সময় দুজনকে কর বিভাগের বাসে আগুন দিয়ে দৌড়ে পালাতে দেখা গেছে।
গতকাল সকালে উপনির্বাচন চলাকালে উত্তরার মালেকাবানু আদর্শ বিদ্যানিকেতন স্কুল কেন্দ্রে ককটেল বিস্ফোরণের ঘটনায় সন্দেহভাজন দুজনকে আটক করেছে পুলিশ। বিকেলে তুরাগ থানা এলাকা থেকে সোহেল নামের একজনকে ককটেলসহ আটক করা হয়েছে।
দুই দলের বক্তব্য : জানতে চাইলে আওয়ামী লীগের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক আ ফ ম বাহাউদ্দিন নাছিম বলেন, এই হামলা স্পষ্ট সন্ত্রাসী তৎপরতা। এ ধরনের কাজ অতীতে বিএনপি-জামায়াত করেছে। তারা বাস, ট্রাক, গাড়ি পোড়ানোসহ নানা সন্ত্রাসী কাজকে মনে করে আন্দোলন, কিন্তু এ ধরনের কাজ কখনোই আন্দোলনের অংশ হতে পারে না। নাশকতার প্রতিবাদে গতকাল সন্ধ্যায় গুলিস্তানে প্রতিবাদ মিছিল করেছে ঢাকা দক্ষিণ আওয়ামী লীগ ও যুবলীগের কেন্দ্রীয় কমিটি।
বিএনপির নেতাকর্মীরা জড়িত—এমন অভিযোগের জবাবে দলটির ভাইস চেয়ারম্যান বরকতউল্লা বুলু বলেন, ‘স্পষ্ট করে বলছি, বিএনপি সন্ত্রাস, জ্বালাও-পোড়াও রাজনীতিতে বিশ্বাস কখনোই করেনি, এসব কর্মকাণ্ডে প্রশ্রয়ও দেবে না। যারা জ্বালাও-পোড়াওয়ের রাজনীতি করে বিএনপির ওপর দায় চাপাতে চায়, তাদেরই মুখোশ উন্মোচনের সময় এসেছে, সময়মতো জনগণ তা করবে।’ গত রাতে এমরান সালেহ প্রিন্স স্বাক্ষরিত এক সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে জানানো হয় যে বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর ঢাকা-১৮ ও সিরাজগঞ্জ-১ আসনে উপনির্বাচনের দিনে ঢাকা মহানগরীর বিভিন্ন স্থানে হঠাৎ বিভিন্ন গণপরিবহনে আগুন দেওয়ার ঘটনাকে ন্যক্কারজনক আখ্যা দিয়ে নিন্দা ও প্রতিবাদ জানিয়েছেন। তিনি এ ঘটনাকে পূর্বপরিকল্পিত ও উদ্দেশ্যমূলক বলে বর্ণনা করেন।
মির্জা ফখরুলের অভিযোগ, সরকার এসব দুষ্কর্মের মাধ্যমে আগের মতোই বিএনপিকে হেয় করা এবং এর দায়-দায়িত্ব বিএনপির নেতাকর্মীদের ওপর চাপিয়ে মিথ্যা ও গায়েবি মামলা করে হয়রানি করতে চায়।