অনলাইন ডেস্ক:
সিলেটের এমসি কলেজের ছাত্রাবাসে স্বামীকে আটকে নববধূকে দলবদ্ধ ধর্ষণ, নোয়াখালীর বেগমগঞ্জে গৃহবধূকে বিবস্ত্র করে নির্যাতনের ঘটনায় দেশজুড়ে ধর্ষণ ও নির্যাতনের বিরুদ্ধে তীব্র প্রতিবাদে সোচ্চার হয় সব শ্রেণি-পেশার মানুষ। টানা ৯ দিন ধরে শাহবাগে আন্দোলন কর্মসূচি চালিয়ে যাচ্ছে ছাত্র ইউনিয়নের নেতৃত্বে বিভিন্ন সংগঠন। দেশের বিভিন্ন এলাকায়ও পালন করা হচ্ছে ধর্ষণবিরোধী নানা কর্মসূচি। ধর্ষকদের কঠোর শাস্তির দাবির মুখে গত সোমবার ধর্ষণের সর্বোচ্চ শাস্তি বাড়িয়ে মৃত্যুদণ্ডের বিধান রেখে ‘নারী ও শিশু নির্যাতন দমন (সংশোধন) অধ্যাদেশ, ২০০০’-এর চূড়ান্ত অনুমোদন দেয় মন্ত্রিসভা। গতকাল মঙ্গলবার অধ্যাদেশে সই করেন রাষ্ট্রপতি মো. আবদুল হামিদ। এর পরই গতকাল দুপুরে আইন, বিচার ও সংসদ বিষয়ক মন্ত্রণালয়ের লেজিসলেটিভ বিভাগ অধ্যাদেশটি জারি করে।
এতসবের মধ্যেই গতকাল আগের ২৪ ঘণ্টায় দেশজুড়ে দশজনকে ধর্ষণের খবর পাওয়া গেছে। ধর্ষণের চেষ্টা করা হয়েছে আরো তিনজনকে। দুই আলোচিত ঘটনায় আন্দোলনে কঠোর বিচারের দাবি এবং আইন সংশোধনের সময়ও প্রতিদিনই একক ও দলবদ্ধ ধর্ষণের ঘটনা ঘটেছে।
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, সিলেটের ঘটনার পর গত ১৮ দিনে দেশজুড়ে আরো ৮২টি ধর্ষণের ঘটনা ঘটেছে। মানবাধিকার সংগঠনের তথ্য মতে, চলতি বছরের ৯ মাসে ৯৭৫ জন ধর্ষণের শিকার হয়েছেন, যেখানে দলবদ্ধ ধর্ষণের ঘটনা রয়েছে ২০৮টি। আইনজীবী, মানবাধিকার ও অপরাধ বিশ্লেষকরা বলছেন, শুধু কঠোর আইন করে ধর্ষণ প্রতিরোধ করা যাবে না। এর জন্য সামাজিক প্রতিরোধমূলক ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে। মাদক, পর্নোগ্রাফি, রাজনৈতিক প্রশ্রয়ে অপরাধীদের মদদ বন্ধ করা এবং পুলিশের প্রভাবমুক্ত তদন্ত নিশ্চিত করা গেলে ধর্ষণ কমে আসবে।
গত ২ সেপ্টেম্বর নোয়াখালীর বেগমগঞ্জে একদল লম্পট ঘরে ঢুকে এক গৃহবধূকে বিবস্ত্র করে নির্যাতন চালায়। তাঁর স্বামীকে বেঁধে রেখে দুুর্বৃত্তরা নির্যাতনের ভিডিও ধারণ করে। ওই নারী তাঁর সম্ভ্রম রক্ষায় অনেক অনুনয়-বিনয় করেন, লম্পটদের ‘বাবা’ ডেকে বাঁচার চেষ্টা করেন। এরপর গত ২৫ সেপ্টেম্বর সিলেট এমসি কলেজ ছাত্রাবাসে স্বামীকে আটকে এক গৃহবধূকে ধর্ষণ করে কয়েকজন তরুণ। এই দুই ঘটনায় সরকারি দলের কর্মী এবং উঠতি সন্ত্রাসীরা জড়িত বলে তথ্য মিলেছে। এসব ঘটনায় ধর্ষণের নিরপেক্ষ তদন্ত এবং কঠোর বিচারের দাবি ওঠে সব মহল থেকে। শুরু হয় আন্দোলন।
ধর্ষকদের মনস্তত্ত্বের ব্যাপারে জানতে চাইলে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয়ের মনোরোগ বিভাগের চেয়ারম্যান অধ্যাপক ডা. সালাউদ্দিন কাউসার বলেন, ‘ধর্ষকদের মনস্তত্ত্ব দুইভাবে প্রভাবিত হয়। এক শ্রেণির ধর্ষক সাধারণ অপরাধের মতোই ধর্ষণ করে। তারা বুঝতেই পারে না এটা বড় ধরনের অপরাধ। তাদের হিতাহিত জ্ঞান থাকে না। এদের পারিবারিক, সামাজিক ও নৈতিক শিক্ষা থাকে না। আরেক শ্রেণি সচেতনভাবে, পরিকল্পিতভাবে ধর্ষণ করে। চিহ্নিত সন্ত্রাসী বা গ্যাং বেপরোয়া ধর্ষণ করে। তারা মনে করে, প্রভাবের কারণে কিছু হবে না।’
বাংলাদেশ হিউম্যান রাইটস ফাউন্ডেশনের চেয়ারপারসন অ্যাডভোকেট এলিনা খান বলেন, ‘এখনো যারা ধর্ষণ করে যাচ্ছে, তারা আইনে মৃত্যুদণ্ড হলো কি হলো না তার তোয়াক্কা করে না। মাদকের আগ্রাসন এবং রাজনৈতিক আশ্রয়-প্রশ্রয় এদের বেপরোয়া করে তুলেছে। এগুলো বন্ধ করতে হবে। যুবসমাজকে উন্নয়নমূলক কাজে সম্পৃক্ত করতে হবে।’
তিনি আরো বলেন, ‘একটি বিষয় নিয়ে আমরা আশঙ্কায় আছি, আদালত বিচারের ক্ষেত্রে কোনো অপশন না থাকায় মৃত্যুদণ্ড দেওয়ার আগে অনেক বেশি বিবেচনা করেন। তখন ধর্ষকও বেনিফিট অব ডাউট পেয়ে যেতে পারে। আগে আইনে যাবজ্জীবন ছিল, সেটাই আমরা দিতে পারিনি। বিচারব্যবস্থার সবচেয়ে বড় গলদ রয়েছে তদন্ত আর প্রমাণে। পুলিশ তদন্ত না করেই প্রথমে বলে দেয় মিথ্যা মামলা। ঠিকমতো এজাহারটা না হলে ওই মামলা প্রমাণ করা কঠিন হয়ে পড়ে। ধর্ষিতার মেডিক্যাল পরীক্ষায়ও সময় নেয় পুলিশ। এতে আলামত নষ্ট হয়ে যায়। ১৫ দিন আগে ভারতে একটি নির্দেশ দেওয়া হয়েছে যে থানায় গেলে পুলিশকে ধর্ষিতার দায়িত্ব নিতে হবে। আমাদের দেশেও এটা হতে পারে।’
জাতীয় মহিলা আইনজীবী সমিতির নির্বাহী পরিচালক অ্যাডভোকেট সালমা আলী বলেন, ‘যারা ধর্ষণ করছে, তারা আইন আর আন্দোলনের কিছু জানে বলে মনে হয় না। মোবাইল ফোনের মাধ্যমে গ্রামীণ জনপদে পর্নোগ্রাফি চলে গেছে। মাদকদ্রব্য হাতে হাতে। আছে সামাজিক মূল্যবোধের অভাব। ফলে অনেকে নারীর প্রতি দৃষ্টিভঙ্গির কারণে ধর্ষণকে অপরাধই মনে করে না। এটা নিয়ন্ত্রণের সঙ্গে অনেক বিষয় যুক্ত। শুধু মৃত্যুদণ্ডের আইন হলেই হবে না। থানাকে নিয়ন্ত্রণমুক্ত করতে হবে। প্রতিরোধমূলক সামাজিক ব্যবস্থা গড়তে হবে। দ্রুত বিধিমালা প্রণয়ন করে আইনের বিষয়গুলো স্পষ্ট করতে হবে।’
গত ২৩ সেপ্টেম্বর থেকে গতকাল পর্যন্ত দেশে ৮০ জন নারী-শিশুকে ধর্ষণের অভিযোগ পাওয়া গেছে। এ সময় অরো ৩৫ জনকে ধর্ষণচেষ্টার অভিযোগ ওঠে। ধর্ষিতাদের মধ্যে সিলেটের নববধূ ছাড়াও আরো সাতজন দলবদ্ধ ধর্ষণের শিকার হয়েছে।
রাজধানীর সোহরাওয়ার্দী হাসপাতালে চিকিৎসাধীন স্বামীর জন্য রক্ত জোগাড় করতে গিয়ে ধর্ষণের শিকার হন এক নারী। এ ঘটনায় গত ২৬ সেপ্টেম্বর র্যাব অভিযুক্তকে গ্রেপ্তার করে। ২৮ সেপ্টেম্বর নারায়ণগঞ্জের সিদ্ধিরগঞ্জের মিজমিজি এলাকায় এক নারীকে দলবদ্ধ ধর্ষণের ঘটনা ঘটে। ২৯ সেপ্টেম্বর ভাটারায় এক ধর্ষক ধরা পড়ে, যে চার কিশোরীকে মডেল বানানোর ফাঁদে ফেলে ধর্ষণ করেছিল। গত ১ অক্টোবর পীরেরবাগে এক গৃহকর্মীকে ধর্ষণের ঘটনায় গ্রেপ্তার করা হয় ঢাকা উত্তর ছাত্রলীগের সহসভাপতি (বহিষ্কৃত) সবুজ আল সাবাবকে। ৪ অক্টোবর হবিগঞ্জের চুনারুঘাটে মা-মেয়ে সংঘবদ্ধ ধর্ষণের শিকার হয় বলে অভিযোগ পাওয়া গেছে। বেগমগঞ্জের ঘটনা প্রকাশের পর গত ৫ অক্টোবর রামগতিতে এক বিধবা নারীকে দলবদ্ধ ধর্ষণের অভিযোগ পাওয়া যায়। ৬ অক্টোবর দিনাজপুরের পার্বতীপুরে এক তরুণীকে ধর্ষণের পর হত্যা করা হয়। ৭ অক্টোবর ঢাকার আশুলিয়ায় দুই তরুণীকে ধর্ষণের পর ইন্টারনেটে ছবি ছড়িয়ে দেওয়ার ঘটনা প্রকাশ পায়। ৮ অক্টোবর নারায়ণগঞ্জের সিদ্ধিরগঞ্জে এক নারীকে ধর্ষণের অভিযোগে গ্রেপ্তার হন পুলিশ কনস্টেবল আব্দুল কুদ্দুস নয়ন। ৯ অক্টোবর চট্টগ্রাম ও যশোরে দুই নারীকে সংঘবদ্ধ ধর্ষণের ঘটনাসহ ১৪ জনকে ধর্ষণের অভিযোগ পাওয়া যায়। এর মধ্যে ছয়জনই শিশু। ১১ অক্টোবর বাগেরহাটের ফকিরহাটে এক এনজিওকর্মীকে ঘরে ঢুকে দলবদ্ধ ধর্ষণের ঘটনা ঘটে। গত সোমবার চট্টগ্রামের সীতাকুণ্ডে হোটেলে এক নারীকে আটকে দলবদ্ধ ধর্ষণের অভিযোগ ওঠে।
মানবাধিকার সংগঠন আইন ও সালিশ কেন্দ্রের (আসক) তথ্যানুযায়ী, চলতি বছরের ৯ মাসে ৯৭৫ জন ধর্ষণের শিকার হয়েছে, যেখানে দলবদ্ধ ধর্ষণের ঘটনা ঘটেছে ২০৮টি। ধর্ষণের পর হত্যার শিকার হয়েছে ৪৩ জন আর আত্মহত্যা করেছে ১২ জন নারী। ১৬১ জন নারী হয়েছে যৌন হয়রানির শিকার। যৌন নিপীড়নের প্রতিবাদ করতে গিয়ে অপরাধীদের হাতে ১২ জন খুন হয়েছে (তিনজন নারী ও ৯ জন পুরুষ)।
সাবেক প্রধান বিচারপতি ও আইন কমিশনের চেয়ারম্যান এ বি এম খায়রুল হক বলেন, ‘শুধু সাজা বাড়িয়ে সমাজ থেকে ধর্ষণের মতো জঘন্যতম অপরাধ দূর করা যাবে না। হয়তো কিছুটা কমবে। এ অপরাধ সমাজ থেকে দূর করতে হলে গোড়ায় যেতে হবে। সাজা বাড়ানোর পাশাপাশি যেসব সমস্যা আছে, তা দূর করতে হবে। সংস্কার আনতে হবে প্রচলিত বিচারব্যবস্থায়।’ তাঁর মতে, আদালতে ঘটনার বর্ণনা দিতে গিয়ে ধর্ষিতা আরেকবার ‘ধর্ষণের শিকার’ হয়। বিচারক, আইনজীবী শত শত মানুষের সামনে এমন ঘটনা ঘটান, কোনো কোনো ভিকটিম আদালতে আসেই না। এ কারণে বর্তমান সাক্ষ্য আইনের ১৫৫ নম্বর ধারার ৪ নম্বর উপধারা বাদ দিতে হবে। এটা করা গেলে ধর্ষিতাকে ‘দ্বিতীয়বার ধর্ষণের’ হাত থেকে রক্ষা করা যাবে।
হিউম্যান রাইট সাপোর্ট সোসাইটির উপদেষ্টা নূর খান লিটন বলেন, ‘শুধু কঠোর আইন নয়, প্রয়োজন আইনের কঠোর প্রয়োগ নিশ্চিত করা। আগেও আইন ছিল। তবু তোয়াক্কা করেনি ধর্ষকরা। রাজনৈতিক প্রভাব, দুর্বৃত্তায়ন এর অন্যতম কারণ। ফলে ভয়ে অনেকে ধর্ষণের পর অভিযোগও করে না। সবার জন্য সমানভাবে আইনের প্রয়োগ করতে হবে। ভুক্তভোগীদের সুরক্ষা দিয়ে আস্থায় আনতে হবে রাষ্ট্রকে।’
পুলিশের সাবেক আইজি আব্দুল কাইউম বলেন, ‘ধর্ষণ-নিপীড়ন প্রতিরোধে পুলিশকে স্বাধীনভাবে কাজ করতে দিতে হবে। ধর্ষণ হওয়ার আগেই নিপীড়নের ঘটনায়ও যেন দ্রুত তদন্ত করে ব্যবস্থা নেওয়া হয়। আগের আইনগুলোও আছে। আইনের কঠোর প্রয়োগের মাধ্যমেই পুলিশ পারে ধর্ষণ-নিপীড়ন থামাতে। পুলিশে অনেক দক্ষ, ভালো অফিসার আছেন।’