কুষ্টিয়া প্রতিনিধি ॥ জালিয়াতি ও ভয়ভীতি দেখিয়ে দুর্বল ও অহসায় লোকজনের জমি দখল নিতে জেলা পরিষদ চেয়ারম্যান হাজি রবিউলের পর তার ভাইও মফিজুল হক সিদ্ধহস্ত। ভাইয়ের ক্ষমতার দাপটে মিলপাড়াসহ পুরো শহরে জমি দখল করে আসছিলেন মফিজুল। হাজি রবিউলের নাম আসার পর মুখ খুলতে শুরু করেছেন নির্যাতিত জমির মালিকরা। ইতিমধ্যে মফিজুলের অত্যাচার ও জমি দখলের বিষয়ে বেশ কয়েকটি অভিযোগ জমা পড়েছে প্রশাসনের কাছে। তারাও বিষয়টি খতিয়ে দেখছে।
এদিকে হাজি রবিউল ইসলামের নানা অপকর্মের বিষয়ে সোচ্চার দলীয় নেতারা।
তারাও তার নানা অপকর্মের কথা সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে তুলে ধরছেন। এদিকে
জেলা আওয়ামী লীগের সহ-সভাপতির পদটি যে কোন সময় হারাতে পারে বলে দলীয়
সুত্র জানিয়েছে।
দলীয় সুত্র জানিয়েছে, জমি জালিয়াতির সাথে যারা জড়িত আছেন তাদের বিরুদ্ধে
কঠোর ব্যবস্থা নেয়ার নির্দেশনা দিয়েছেন আওয়ামী লীগের যুগ্ম সাধারন সম্পাদক মাহবুবউল আলম হানিফ এমপি। তার নির্বাচনী এলাকায় এরকম ঘটনায় তিনি বিব্রতকর অবস্থায় পড়েছেন। এর সাথে জড়িত কাউকে ছাড় না দিতে পুলিশ প্রশাসনকে কড়া নির্দেশ দিয়েছেন। হানিফের নির্দেশের পর প্রশাসন আরো কঠোর অবস্থানে চলে গেছেন। জমি জালিয়াতির ঘটনায় প্রত্যেককে আইনের আওতায় আনার জন্য কাজ করছে গোয়েন্দা পুলিশ।
এদিকে হাজি রবিউল ও তার ভাই মফিজুলের অপকর্ম নিয়ে শহরে জুড়ে আলোড়িত
হচ্ছে। দুই ভাইয়ের বিরুদ্ধে মুখ খুলতে শুরু করেছেন দল ছাড়াও সাধারন মানুষ।
হাজি রবিউল ইসলামের বাসা শহরের হরিশংকুর পর আড়াদি মন্ডল সড়কে। সেখানে তার
ডাল মিল রয়েছে। হরিশংকরপুরের পাশেই লাগোয়া মিলপাড়া। এ মিলপাড়া এলাকাতেই
এশিয়ার সব থেকে বড় বস্তকল মোহিনী মিলের অবস্থান। স্বাধীনতা পরবর্তি সময়ে
মহিনী মিলের যৌবন থাকার সময় মিলের ওপর নজর পড়ে হাজি রবিউলসহ তার ৫
বন্ধুর। ৫ বন্ধুর এ টিমকে কুষ্টিয়া শহরের মানুষ ৫ পান্ডব বলে অবহিত করেন।
এ টিমের সদস্যকে একনামে চেনেন বেশির ভাগ মানুষ। মোহিনী মিলের সম্পদ দখল ও
বিক্রির পেছনে এ ৫ জনের হাত রয়েছে বলে বিভিন্ন সময় অভিযোগ এসেছে।
হাজি রবিউল ইসলামের ছোট ভাই মফিজুল ইসলাম। তিনিও হালে এসে আওয়ামী লীগের
রাজনীতিতে নাম লিখিয়েছেন। তার আগে জামায়াতের রাজনীতি করতেন বলে এলাকাবাসী
জানিয়েছেন। কারণ ৯০ সালের পর দেলোয়ার হোসেন সাঈদী মিলপাড়ায় ওয়াজ করতে
এসের তাদের বাড়িতে রাতে খাওয়া দাওয়া করেন। মফিজুল জমির ব্যবসা করেন। তার
পার্টনার যুবলীগ নেতা আশরাফুজ্জামান সুমন। এদের কাজ শহরের বিভিন্ন এলাকায়
ত্র“টিপুর্ন ও শরিকে শরিকে ঝামেলা চলছে এমন জমি খুঁজে বেরা করা। তার পর সেই জমি হাতিয়ে নিতে টিম গঠন করে জমি মালিকের পেছনে লেলিয়ে দেয়া। এরপর
নানা ভাবে ভয়ভীতি দেখিয়ে সেই জমি পানির দরে কিনে নেন মফিজুল। কুষ্টিয়া রেজিষ্ট্রি অফিস সুত্রে জানা গেছে, গত কয়েক বছরে শহরে মফিজুলের নামে বেশ কিছু জমি রেজিষ্ট্রি হয়েছে। তেমনই একটি জমির প্লট ঢাকা-রাজবাড়ী মহাসড়কের পাশে মেডিকেল সংলগ্ন এলাকায় অবস্থিত। পিডব্লিউডি অফিসের কর্মচারী গোলাম মোস্তাফা ও তার ভাগ্নে পান্না ৮ শতক জমি ক্রয় করেন। হঠাৎ করে এ জমিতে বালু ও মাটি ভরাট শুরু হয়। জমির মালিক এর কিছুই জানেন না। এরপর জমি মালিক পাপ্পু অভিযোগ নিয়ে যান হাজি রবিউল ইসলামের কাছে। তিনি শালিসের নামে সময়ক্ষেপন করতে খাকেন। এ সুযোগে তার ভাই মফিজুল মাটি ভরাট করে করে ফেলেন। পরে হাজি বলেন জমি নিয়ে ঝামেলা আছে এই বলে তার ভাই মফিজুলের স্বজনদের নামে রেজিষ্ট্রি করে নেয়। এখন জমির মালিক আর দখল নিতে পারছে। প্রায় ৮ শতক জমি মালিক ফিরে পেতে চেষ্টা করছে।
জমি মালিকর গোলাম মোস্তাফা বলেন,‘ হঠাৎ এসে দেখি মফিজুলের লোকজন মাটি ফেলছে। বিষয়টি তার ভাই হাজি রবিউল ইসলামের কাছে বিচার দিলে তিনি কিছুই করেননি। উল্টো জমি ছেড়ে দিতে বলেন। আমাদের সাইনবোর্ড ফেলে দিয়ে দুই নারী
সাইনবোর্ড ঝুলিয়ে দিয়েছে।
একই ভাবে মফিজুল ও সুজনসহ চক্রের ১৮জন মিলে মার্কাস মসজিদের পাশে এমএমএ
ওয়াদুদের আরেকটি দামি জমির প্লট বিক্রির জন্য চেষ্টা করছিলেন। এ জমি বিক্রির বিষয়টিও হাজি রবিউল জানতে বলে পুলিশ জানতে পেরেছে। সম্পত্তি হাতিয়ে নেয়ার সব আয়োজন শেষ করে। প্রায় ২৫ কোটি টাকার মুল্যের জমি বিক্রিরপাঁয়তারা চলাকালে সব গোমর ফাঁস হয়ে যায়। সুজন ধরা পড়ার পর বিষয়টি সামনে আসে।
এমএমও ওয়াদুদ বলেন, প্রতারক চক্র আমার সব সম্পদত বিক্রির চেষ্টা করছিল।
বিষয়টি সামনে আসায় তারা আর পারেনি।
আর জেলা আওয়ামী লীগের সহ-সভাপতি ও জেলা পরিষদ চেয়ারম্যান হাজি রবিউলের
ইসলামের দলে আসা ও অতীত নানা অপকের্মর বিষয়টি আলোচিত হচ্ছে। এত অপকর্ম
জানার পর দলে তার মত লোককে ঠাঁই দেয়া ঠিক হয়নি বলে মনে করছেন অনেকে।
জেলা আওয়ামী লীগের একটি সুত্র জানায়, হাজি রবিউল ইসলাম ২০০৪ সালের পর
আওয়ামী লীগে আসার পর তখনকার নেতা খন্দকার রশীদুজ্জামান খান দুদুর সাথে
রাজনীতি করতেন। তার আগে ব্যবসায়ী হিসেবে তাকে চিনতো সকলে। তবে আওয়ামী
লীগে আসার আগে ইসলামী শাসনতন্ত্র আন্দোলনে রাজনীতি করেছেন সরাসরি।
এরপর আওয়ামী লীগের রাজনীতিতে যোগ দেয়ার কয়েক বছরের মাথায় আওয়ামী লীগ
ক্ষমতায় আসে। এরপর হাজি রবিউলের দলে অবস্থান ধীরে ধীরে শক্তপোক্ত হতে
থাকে। চামচামি ও তোয়াজ করে অন্য নেতাদের পেছনে ফেলে জেলা পরিষদের মনোনয়ন
পেয়ে চেয়ারম্যান নির্বাচিত হন। এরপর আর তাকে পেছনে ফিরে তাকাতে হয়নি। গত
১২ বছরে নামে-বেনামে বহু সম্পদ গড়েছেন। বিশেষ করে মাহবুবউল আলম হানিফের
নাম ভাঙ্গিয়ে তিনি এসব্ অপকর্ম করে আসছেন। সরকারি অফিস আদালত থেকে শুরু
করে সব খানে তার দাপট বিরাজমান। তিনি কথায় কথায় হানিফের নাম করে সবাইকে
দৌড়ের ওপর রাখতেন। মিলপাড়া এলাকার বাসিন্দা জেলা আওয়ামী লীগের সাবেক স্বাস্থ্য বিষয়কসম্পাদক রবিউল ইসলাম খান বলেন,‘ নানা অপকর্ম তারা করেছে। সুজন আমার ৬০
পয়েন্দা জমি জোর করে দখলে রেখেছে। টাকাও দিচ্ছে না রেজিষ্টি করছে না।
আমরা অপকর্মকারীদের কঠিন বিচার চাই। ছাড় দিলে দলের ক্ষতি হবে। কারণ এখন
কোনঠাসা হলেও আগামীতে আবার ফণা তুলতে পারে। তাই অপকর্মকারীদের বিষ দাঁত
ভেঙ্গে দিতে হবে।’ জমি দখল ও নয়ছয় করার বিষয়টি হাজি রবিউলের পুরানো অভ্যাস বলে মনে করেন দলের প্রবীণ নেতারা। জেলা পরিষদ চেয়ারম্যান হওয়ার পর তিনটি জমি নিয়ে বড় ঘাপলা করেছেন। এর মধ্যে গত বছরের ১০জুন কুষ্টিয়া সদর উপজেলার বটতৈল এলাকার রাকিবুল ইসলাম নামের এক ব্যক্তির মামলিকানা স্বত্ত্ব দখলীয় ও রেকর্ডভুক্ত জমির উপর নির্মিত ২২ দোকান বিশিষ্ট দ্বি-তলা মার্কেটটি প্রকাশ্যে দিবালোকে গুড়িয়ে দেয়া হয়।
জমির প্রকৃত মালিকের অভিযোগ, কুষ্টিয়া জেলা পরিষদের যোগসাজসে জমিটি
জবরদখল করেছে ‘কেএনবি এগ্রো ইন্ডা: লি:’ নামক একটি পোল্ট্রি, মৎস ও
পশুখাদ্য প্রস্তুতকারী কারখানা মালিক কামরুজ্জামান। কামরুজ্জামান হাজি
রবিউল ইসলাম, মিরপুর উপজেলা চেয়ারম্যান কামারুল আরেফিন, ব্যবসায়ী অজয়
সুরেকাসহ আরো কয়েকজনকে ম্যানেজ করে বিল্ডিং গুড়িয়ে দেন।
ক্ষতিগ্রস্থ রকিবুল ইসলাম অতিরিক্ত চীফ জুডিসিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট আমলী
আদালত সদরের বিজ্ঞ বিচারক রেজাউল করীম এর আদালতে মামলা করেন। জেলা
পরিষদের দাবি জমিটি তাদের মালিকানাভুক্ত। যদিও নিটকস্থ সংশ্লিষ্ট জগতি
ইউনিয়ন ভুমি অফিসের রেকর্ড সুত্রের বরাত দিয়ে ভুমি কর্মকর্তা বলছেন,
ঘটনাস্থলের জমিটি নিকট ৫০বছরের রেকর্ড মতে ব্যক্তি মালিকানাধীন হিসেবে
রাজস্ব সংগৃহীত হচ্ছে। হঠাৎ করে জেলা পরিষদের দাবিকৃত তথ্যের কোন সত্যতা
তাদের কাছে নেই বলে নিশ্চিত করেন তিনি।
শিল্পপতি কামরুজ্জামান এ জন্য সব দোষ চাপান জেলা পরিষদের ওপর। আর জেলা
পরিষদ মার্কেট ভাাঙ্গার বিষয়ে দোষ চাপান কামরুজ্জামানের ওপর।
একই ভাবে জাতীয় গৃহায়ন কর্তৃপক্ষ কতৃক স্বল্প আয়ের পেশাজীবীদের বরাদ্দ ও
রেজিষ্ট্রিকৃত ২১২টি হাউজিং প্লট। জেলা পরিষদের চেয়াম্যান কুষ্টিয়া জেলা
আওয়ামীলীগের সহ-সভাপতি হাজী রবিউল ইসলাম বিধি বহির্ভুতভাবে ক্ষমতার
অপব্যবহার করে অবৈধ ভাবে দখল করেন বলে অভিযোগ কতৃপক্ষের। সেখানে স্থাপনাও
নির্মান করছেন বলে অভিযোগ করেন জাতীয় গৃহায়ন কর্তৃপক্ষ কুষ্টিয়ার
উপ-বিভাগীয় প্রকৌশলী সৈয়দ আমিনুল ইসলাম। এ বিষয়ে ১৩জন বাদী হয়ে মামলা
করেছে। অন্যায় ভাবে জমি দখল নিয়ে হাজি রবিউল ইসলাম সেখানে অডিটরিয়া
করছেন। পাশাপাশি তিনি নিজেও সরকারি জমি দখলে রেখেছেন। জেলা প্রশাসকের
সহয়তা নিয়ে হাজি রবিউল এ কাজ চালিয়ে যাচ্ছেন বলে অভিযোগ গনপুর্তের। এছাড়া
নদী ব্যবস্থাপনা কমিটির অনুমোদন ছাড়াই কুষ্টিয়া সদর উপজেলার মহাশস্মান
সংলগ্ন গড়াই নদীর বিস্তৃীর্ন এলাকাজুড়ে জেলা পরিষদ ইকোপার্কের নামে
স্থাপনা নির্মান শুরু করেছেন বলে বাংলাদেশ পানি উন্নয়ন বোর্ড কতৃপক্ষের
অভিযোগ রয়েছে।
এছাড়াও কুষ্টিয়া ভেড়ামারা মহাসড়কের পাশে বারখাদা এলাকার বন্ধ হয়ে যাওয়া
একটি শিল্প প্রতিষ্ঠানের ভু-সম্পত্তি যা ব্যাংকের কাছে মটগেজকৃত সেখানেও
কুষ্টিয়া জেলা পরিষদ অবৈধভাবে দখলে নিয়ে বালি ভরাট করে মার্কেট নির্মানের
চেষ্টাকালে স্থানীয়দের বাধারমুখে সেখান থেকে পিছু হঠতে বাধ্য হন জেলা পরিষদ।
দুই ভাইয়ের অপকর্মের বিষয়ে জেলা আওয়ামী লীগ শক্ত অবস্থানে। মাহবুবউল আলম
হানিফের নির্দেশনা মেনে দলীয় নেতা কাজ করছেন। রবিউল ইসলামকে দল থেকে বাদ
দেয়ার বিষয়টি আলোচনা হচ্ছে। অভিযোগের বিষয়ে জানতে চাইলে মফিজুল ইসলাম বলেন,‘ সব মিথ্যা ও বনোয়াট। মেডিকেলের পাশে যে জমি নিয়ে ঝামেলা চলছে তা মূল মালিক আগেই বিক্রি করে দেয়। গোলাম মোস্তাফা জমি কিনলেও এ জমি নিয়ে ঝামেলা আছে। আর জমি দখলের বিষয়ে আমরা বিরুদ্ধে যেসব অভিযোগ আনা হয়েছে তার কোন ভিত্তি নেই।’
জেলা আওয়ামী লীগের সাধারন সম্পাদক আজগর আলী বলেন,‘ আমাদের নেতা মাহবুবউল
আলম হানিফ সার্বক্ষনিক সব বিষয় মনিটরিং করছে। অন্যায় কারীদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থার নেয়ার বিষয়টি দলীয় ফোরামে আলোচনা হবে। অপকর্মকারীদের দলে কোন জায়গা হবে না। তাদের বাদ দেয়া হবে।’ পুলিশ সুপার এসএম তানভীর আরাফাত বলেন,‘ কুষ্টিয়া শহরের জমি জালিয়াতি চক্রের সবাইকে উৎখাত করা হবে। কোন ভূমিদস্যূকে জেলায় থাকতে দেয়া হবে না। সবাইকে আইনের আওতায় আনা হবে।