অনলাইন ডেস্কঃ
অবিভক্ত ভারতের শিলংয়ে জন্ম। ১৯৬৫ সালের পাক-ভারত যুদ্ধে ভারতের বিরুদ্ধে লড়েছেন পাকিস্তানের নাগরিক হিসেবে। ১৯৭১ সালে লড়েছেন পাকিস্তানের বিরুদ্ধে বাংলাদেশের স্বাধীনতার জন্য। স্বাধীন দেশে পালন করেছেন গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব। চাকরি থেকে অবসর নেওয়ার পর অবসরজীবন অবসরে কাটেনি তাঁর। স্বাধীন দেশে সাম্প্রদায়িক রাজনীতি, যুদ্ধাপরাধীদের বিচার ও মুক্তিযুদ্ধের চেতনার পক্ষে সোচ্চার ভূমিকা পালন করেছেন। চিরদ্রোহী ব্যক্তিত্ব মুক্তিযুদ্ধকালীন ৪ নম্বর সেক্টরের কমান্ডার মেজর জেনারেল (অব.) সি আর দত্ত (চিত্তরঞ্জন দত্ত) বীর-উত্তম আর নেই।
যুক্তরাষ্ট্রের ফ্লোরিডায় একটি হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় স্থানীয় সময় সোমবার (২৪ আগস্ট) রাত সাড়ে ১১টার দিকে (বাংলাদেশ সময় মঙ্গলবার সকাল) তিনি শেষনিঃশ্বাস ত্যাগ করেন। তাঁর বয়স হয়েছিল ৯৩ বছর। পরিবারের পক্ষ থেকে জানানো হয়েছে, এই মুক্তিযোদ্ধাকে দেশের মাটিতে ফিরিয়ে এনে রাষ্ট্রীয় মর্যাদায় শেষকৃত্য করতে চায় তারা।
কয়েক বছর ধরে ছেলে-মেয়েদের সঙ্গে নিউ ইয়র্কে বসবাস করছিলেন সি আর দত্ত। বড় মেয়ে মহুয়া দত্ত ও ছেলে ডা. রাজা দত্ত সেখানে থাকেন। গত বছরের শেষ দিকে ফ্লোরিডায় ছোট মেয়ে কবিতা দাসগুপ্ত হ্যাপির বাসায় চলে যান। গত মার্চে করোনাভাইরাসের প্রকোপ বাড়লে নিউইয়র্কে না ফিরে ফ্লোরিডাতেই থেকে যান। তাঁর আরেক মেয়ে কানাডায় থাকেন। তিনি বাবার মরদেহ গ্রহণের জন্য ঢাকায় আসছেন বলে জানা গেছে।
প্রয়াতের কনিষ্ঠ জামাতা প্রদীপ দাসগুপ্ত জানান, গত বৃহস্পতিবার বাথরুমে পড়ে ডান পায়ের গোড়ালি ভেঙে যায় সি আর দত্তের। হাসপাতালে নেওয়ার পর তাঁর পায়ে অস্ত্রোপচার করা হয়। তিনি অ্যাজমা সমস্যায় ভুগছিলেন। সার্জারির পর তাঁর শ্বাসকষ্ট বেড়ে যায়, কিডনিও অচল হয়ে পড়ে।
সি আর দত্তের মৃত্যুতে রাষ্ট্রপতি ও প্রধানমন্ত্রী গভীর শোক প্রকাশ করেছেন। রাষ্ট্রপতি মো. আবদুল হামিদ শোকবার্তায় বলেছেন, ‘মুক্তিযুদ্ধে তাঁর অবদান জাতি চিরদিন শ্রদ্ধার সাথে স্মরণ করবে।’ প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা তাঁর শোকবার্তায় বলেন, ‘মহান মুক্তিযুদ্ধে তাঁর অনন্য অবদান দেশ ও জাতি চিরদিন কৃতজ্ঞচিত্তে স্মরণ করবে।’ মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক মন্ত্রী আ ক ম মোজাম্মেল হকসহ মন্ত্রিপরিষদ সদস্যরাও শোক প্রকাশ করেছেন। এ ছাড়া সেক্টর কমান্ডারস ফোরাম, মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘর, একাত্তরের ঘাতক-দালাল নির্মূল কমিটি, আইন ও সালিশ কেন্দ্র, উদীচী শিল্পীগোষ্ঠী, সম্প্রীতি বাংলাদেশ, সম্মিলিত সামাজিক আন্দোলন প্রভৃতি প্রতিষ্ঠান ও সংগঠন গভীর শোক প্রকাশ করেছে।
সি আর দত্তের জন্ম ১৯২৭ সালের ১ জানুয়ারি আসামের রাজধানী শিলংয়ে। প্রাথমিক শিক্ষা শিলংয়ে শুরু হলেও পরে তাঁর পরিবার স্থায়ীভাবে চলে আসে হবিগঞ্জে। ১৯৫১ সালে যোগ দেন তখনকার পাকিস্তান সেনাবাহিনীতে।
১৯৬৫ সালে পাকিস্তান-ভারত যুদ্ধে আসালংয়ে একটি কম্পানির কমান্ডার হিসেবে যুদ্ধ করেন সি আর দত্ত। সেই যুদ্ধে বীরত্বপূর্ণ অবদানের জন্য পাকিস্তান সরকার তাঁকে পুরস্কৃত করে।
পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর সিক্স ফ্রন্টিয়ার্সের বেঙ্গল রেজিমেন্টের সিনিয়র মেজর সি আর দত্ত ১৯৭১ সালের জানুয়ারি মাসে বার্ষিক ছুটি ভোগ করতে দেশে আসেন। বঙ্গবন্ধুর ৭ই মার্চের ভাষণে উদ্দীপ্ত হয়ে তিনি যোগ দেন মুক্তিযুদ্ধে। ২৫ মার্চেই পাকিস্তানি বাহিনীকে মোকাবেলা করার জন্য হবিগঞ্জ থেকে সিলেট অভিমুখে যুদ্ধযাত্রা শুরু করেছিলেন তিনি। তাঁকে দেওয়া হয় স্বাধীনতাযুদ্ধের ৪ নম্বর সেক্টরের কমান্ডারের দায়িত্ব। ওই সেক্টরে হানাদার বাহিনীর সঙ্গে মুক্তিযোদ্ধাদের বহু যুদ্ধ সংঘটিত হয়। যার বেশ কয়েকটিতে নিজেই নেতৃত্ব দেন সি আর দত্ত। মুক্তিযুদ্ধে অসামান্য কৃতিত্ব ও অবদানের জন্য দেশ স্বাধীন হওয়ার পর তাকে ‘বীর-উত্তম’ খেতাবে ভূষিত করা হয়।
১৯৭৩ সালে স্বাধীন বাংলাদেশের সীমান্তরক্ষী বাহিনী গঠনের উদ্যোগ নেওয়া হলে এর দায়িত্ব দেওয়া হয় সি আর দত্তকে। বাংলাদেশ রাইফেলসের প্রথম মহাপরিচালক তিনি। পরে তিনি মুক্তিযোদ্ধা কল্যাণ ট্রাস্ট ও বিআরটিসির চেয়ারম্যানের দায়িত্বও পালন করেন। ১৯৮৪ সালের জানুয়ারিতে মেজর জেনারেল হিসেবে বাংলাদেশ সেনাবাহিনী থেকে অবসর নেন তিনি।
মৃত্যুর আগ পর্যন্ত তিনি হিন্দু বৌদ্ধ খ্রিস্টান ঐক্য পরিষদের সভাপতির দায়িত্ব পালন করেছেন। সেক্টর কমান্ডারস ফোরাম গঠনের পর যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের দাবিতে দেশজুড়ে ঘুরে বেড়িয়েছেন সি আর দত্ত।