অনলাইন ডেস্কঃ
করোনাকালে সরকারসহ সংশ্লিষ্ট সব মহলকে সংবাদপত্রশিল্পকে রক্ষায় এগিয়ে আসার আবেদন জানিয়েছে নিউজ পেপার ওনার্স অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশ (নোয়াব)। একই সঙ্গে পাঠক, সাংবাদিক, বিজ্ঞাপনদাতা, এজেন্ট ও হকারদের এই দুঃসময়ে নিজ অবস্থান থেকে সংবাদপত্রশিল্পের পাশে থাকার আহ্বান জানিয়ে বলা হয়, আপনাদের সহযোগিতা সংবাদপত্রশিল্প বাঁচিয়ে রাখতে একান্ত কাম্য। গতকাল শুক্রবার নোয়াবের এক বিবৃতিতে এ আবেদন ও আহ্বান জানানো হয়।
বিবৃতিতে বলা হয়, ‘বাংলাদেশসহ বিশ্বব্যাপী কভিড-১৯ মহামারির প্রভাবে অর্থনীতি থমকে পড়েছে। করোনা সংকটের প্রভাব সংবাদপত্রশিল্পে পড়েছে মারাত্মকভাবে। দেশের সংবাদপত্রশিল্প প্রায় ধ্বংসের দ্বারপ্রান্তে। সব পত্রিকা বিক্রির সংখ্যা অনেক কমে গেছে। একইভাবে বিজ্ঞাপনও কমেছে ভীষণভাবে। ঢাকাসহ দেশজুড়ে অনেক সংবাদপত্র প্রকাশ বন্ধ হয়ে গেছে। বর্তমানে বেশ কিছু পত্রিকা শুধু অনলাইনে প্রকাশিত হচ্ছে। ফলে বহু পত্রিকা তাদের কর্মীদের বেতন-ভাতা নিয়মিত পরিশোধ করতে পারছে না। যে পত্রিকাগুলো ছাপা অব্যাহত রেখেছে তারা বাধ্য হয়ে ব্যয় সংকোচনের নানা পদ্ধতি খুঁজছে। পত্রিকার পৃষ্ঠাসংখ্যা কমানো, ছাপার পরিমাণ কমানো, রঙিন পৃষ্ঠা কমানো, প্রশাসনিক ব্যয় কমিয়ে ব্যয় সঙ্কোচন করে টিকে থাকার চেষ্টা করছে।
বিশ্বায়ন ও ডিজিটাল মিডিয়ার যুগে ছাপা সংবাদপত্র এমনিতেই রুগ্ণ শিল্পে পরিণত হয়েছিল। করোনাভাইরাসের অতিমারি রুগ্ণ সংবাদপত্রশিল্পের জন্য আরো ভয়াবহ পরিস্থিতি তৈরি করেছে। দেশজুড়ে পত্রিকা বিক্রি কমে গেছে প্রায় দুই-তৃতীয়াংশ। বিজ্ঞাপনের আয় কমে নেমে এসেছে এক-চতুর্থাংশে। সব দিক থেকে আয় কমে যাওয়ায় কর্মীদের বেতন-ভাতা পরিশোধ করতে পারছে না। কেউ অর্ধেক দিচ্ছে। অনেকে তা-ও দিতে হিমশিম খাচ্ছে। সব ধরনের ব্যয় কমিয়েও পত্রিকাগুলোর টিকে থাকা কঠিন হয়ে পড়েছে। এমন অস্থিরতায় চট্টগ্রামে সব পত্রিকা ছাপা ও বিতরণ বন্ধ ছিল বেশ কিছুদিন।
কভিড-১৯ কালীন পরিস্থিতিতে তথ্যমন্ত্রীর সঙ্গে সংবাদপত্র মালিকদের সংগঠন নোয়াবের একাধিক বৈঠক হয়েছে। বৈঠকে সংবাদপত্রের পক্ষ থেকে সংকট উত্তরণে একাধিক প্রস্তাব দেওয়া হয়েছে। এরপর পরিস্থিতির আরো অবনতি হয়েছে। এ সমস্যা সমাধানে সরকারের পক্ষ থেকে আমরা বিশেষ উদ্যোগের অপেক্ষায় রয়েছি। অন্যান্য শিল্পখাত বিভিন্ন মাত্রায় সরাসরি সরকারি সহায়তা পেয়েছে। কিন্তু সরকারিভাবে সংবাদপত্র সেবাশিল্প হিসেবে স্বীকৃত হলেও এই শিল্প এখনো কোনো সহায়তা পায়নি।
সংবাদপত্রশিল্পের এই সংকটকালে সংবাদপত্র মালিক, সম্পাদক, সাংবাদিক, এজেন্ট ও হকাররা নিজেদের মধ্যে আলোচনা করছেন। তাঁরা সংকট উত্তরণের পথ খুঁজছেন। বিভিন্ন প্রাসঙ্গিক দাবি তাঁরা সরকারের কাছে পেশ করেছেন। নোয়াব বরাবর চেষ্টা চালিয়ে এসেছে যাতে সরকার নীতিমালা নির্ধারণ ও বাজেট প্রণয়নের সময় সংবাদপত্রশিল্পের বাস্তব অবস্থা ওয়াকিবহাল হয়ে বিবেচনা করতে পারে। গত বছরের মতো এ বছরও নোয়াব বাজেট প্রণয়নের আগে সংবাদপত্রশিল্পসংশ্লিষ্ট কর, মূল্য সংযোজন কর ইত্যাদি বিষয়ে বাস্তবানুগ দাবি জানিয়েছে জাতীয় রাজস্ব বোর্ড, অর্থ মন্ত্রণালয় ও তথ্য মন্ত্রণালয়ের কাছে। কিন্তু আমরা লক্ষ করেছি, এসব বিষয়ের একটিও বিবেচনায় নেওয়া হয়নি।
বর্তমান সংকটময় পরিস্থিতি থেকে উত্তরণে নোয়াবের পক্ষ থেকে বিভিন্ন প্রস্তাব ও দাবি নিয়ে অর্থমন্ত্রী আ হ ম মুস্তফা কামাল, তথ্যমন্ত্রী হাছান মাহ্মুদ এবং প্রধানমন্ত্রীর বেসরকারি শিল্প ও বিনিয়োগবিষয়ক উপদেষ্টা সালমান এফ রহমানের সঙ্গে দেখা করেছেন নোয়াব নেতারা। তাঁরা নোয়াবের এই বিষয়গুলো জরুরি বলে মনে করেন এবং এ বিষয়ে উদ্যোগ নেবেন বলে আশ্বাস দেন। ২০২০-২১ অর্থবছরের প্রস্তাবিত জাতীয় বাজেটের আগে অর্থমন্ত্রী আ হ ম মুস্তফা কামালের কাছে সংগঠনের পক্ষ থেকে পাঁচ দফা লিখিত প্রস্তাব দেওয়া হয়েছে। তাতে বলা হয়, বর্তমান সংকটকালে সরকারের সহযোগিতা ছাড়া এ শিল্পের টিকে থাকা কঠিন। কিন্তু সরকারের কাছ থেকে কোনো ইতিবাচক সাড়া পাওয়া যায়নি। গত বাজেটে এসব দাবি সম্পর্কে কিছু ছিল না। তবে সম্প্রতি তথ্য মন্ত্রণালয় থেকে কিছু বকেয়া বিল পরিশোধের উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে।
শ্রম আইন অনুসারে সংবাদপত্র একটি শিল্প। ২০১৪ সালে সংবাদপত্রকে সেবাশিল্প ঘোষণা করা হয়। রুগ্ণ শিল্পে পরিণত হওয়া সংবাদপত্রের করপোরেট ট্যাক্স ৩৫ শতাংশ থেকে কমিয়ে ১০ শতাংশ করার দাবি জানিয়েছিল নোয়াব। একই সঙ্গে নিউজপ্রিন্ট আমদানির ওপর ১৫ শতাংশ মূল্য সংযোজন কর (ভ্যাট) বাদ দেওয়ার দাবি জানানো হয়। অন্য দাবিগুলোর মধ্যে ছিল—বিজ্ঞাপন আয়ের ওপর উৎস কর (টিডিএস) ৪ শতাংশ থেকে কমিয়ে ২ শতাংশ করা, উৎসস্থলে কাঁচামালের ওপর ৫ শতাংশের পরিবর্তে অগ্রিম কর (এআইটি) শূন্য শতাংশ করা।
সংবাদপত্র সেবাশিল্প হওয়ার পরও বিশেষ কোনো সুবিধা পাচ্ছে না। যেমন তৈরি পোশাকশিল্প মুনাফা অর্জনকারী শিল্প হওয়ার পরও এর করপোরেট ট্যাক্স ১০ থেকে ১২ শতাংশ। অথচ সংবাদপত্র সেবাশিল্প হওয়ার পরও করপোরেট ট্যাক্স ৩৫ শতাংশ। এবারের বাজেটে সব শিল্পের জন্য ২.৫% করপোরেট ট্যাক্স কমানো হয়েছে। এ প্রেক্ষাপটে সংবাদপত্রের করপোরেট ট্যাক্স ১০ থেকে ১৫ শতাংশ করা জরুরি ছিল। আয়কর অধ্যাদেশ অনুসারে সংবাদপত্রের বিজ্ঞাপন আয়ের ওপর টিডিএস ৪ শতাংশ, উৎসস্থলে কাঁচামালের ওপর এআইটি ৫ শতাংশসহ মোট ৯ শতাংশ। বেশির ভাগ সংবাদপত্রের মোট আয়ের ৯ শতাংশ লভ্যাংশই থাকে না। এ অবস্থায় টিডিএস ৪ থেকে ২ শতাংশ এবং এআইটি ৫ শতাংশের পরিবর্তে শূন্য শতাংশ দাবি করছে নোয়াব।
মূল্য সংযোজন কর ও সম্পূরক শুল্ক আইনে সংবাদপত্র ভ্যাট থেকে অব্যাহতিপ্রাপ্ত সেবার তালিকায় অন্তর্ভুক্ত। এ ছাড়া এটি সেবাশিল্প এবং এই শিল্পের প্রধান কাঁচামাল নিউজপ্রিন্ট, যা মোট খরচের অর্ধেকের বেশি। ভ্যাট থেকে অব্যাহতিপ্রাপ্ত সেবার তালিকায় থাকার পরও ১৫ শতাংশ ভ্যাট দিতে হচ্ছে। নোয়াব নিউজপ্রিন্ট আমদানির ওপর ভ্যাটমুক্ত সুবিধা দিতে কিংবা সর্বোচ্চ ৫ শতাংশ ভ্যাট নির্ধারণের দাবি করেছে।
বর্তমান কভিড-১৯ সংকটে সব খাতই সরকারের প্রণোদনা, বড় ধরনের সহায়তা বা ছাড় পাচ্ছে। অথচ সংবাদপত্র তথা গণমাধ্যম এসবের বাইরে রয়ে গেছে। সংবাদপত্রের মূল কাঁচামাল নিউজপ্রিন্টে এত অধিক হারে ভ্যাট থাকা সমীচীন নয়। সংবাদপত্রশিল্পের এই সংকটে করপোরেট ট্যাক্স, এআইটি এবং টিডিএসসহ যেসব কর রয়েছে, সেগুলো বাদ না দিলে কিংবা ন্যূনতম পর্যায়ে না আনলে এ খাত টিকবে না।
অন্যদিকে সরকারের উদ্যোগে সংবাদপত্রশিল্পের নবম ওয়েজ বোর্ডের জন্য রোয়েদাদ ঘোষণা করা হয়েছে। সংবাদপত্রশিল্প আগে থেকেই দুঃসময়ের মধ্য দিয়ে যাচ্ছিল। ফলে রোয়েদাদ কার্যকরের চাপ তাদের জন্য পরিস্থিতি আরো জটিল করে তুলছে। হাইকোর্টে এ বিষয়ে একাধিক রিট বর্তমানে চলমান।
আগের প্রতিটি ওয়েজ বোর্ড রোয়েদাদও বাস্তবানুগ ছিল না। দেশের স্বল্পসংখ্যক সংবাদপত্রেই অতীতে ওয়েজ বোর্ড রোয়েদাদ কার্যকর হয়েছে। তখনো সরকারের পক্ষ থেকে কোনো বিশেষ সহায়তা ও অনুদান ছিল না। কোনো সুযোগ-সুবিধাও ছিল না। বর্তমান প্রতিযোগিতামূলক বাজারে, ডিজিটাল মিডিয়ার যুগে চাইলেই সংবাদপত্র প্রতিষ্ঠান নিজস্ব আয় বাড়ানোর উদ্যোগ নিতে পারছে না।
সংবাদপত্র মজুরি বোর্ডে মালিকপক্ষের মতামত কখনো বিবেচনায় না নেওয়ায় মজুরি বোর্ড শুধু বেতন-ভাতার মধ্যে সীমাবদ্ধ হয়ে পড়েছে। যা দিন দিন এই শিল্পকে আরো রুগ্ণ করছে। আর্থিক চাপ সামলাতে না পেরে আবশ্যিক ব্যয় সংকোচন করতে বাধ্য হয়েছে। এ অবস্থায় প্রতিষ্ঠানগুলো ওয়েজ বোর্ড রোয়েদাদ কার্যকর না করে বা আংশিক দিয়ে, সব মিলিয়ে প্রতিষ্ঠান বন্ধ হওয়ার পর্যায় তৈরি হচ্ছে।
এমন পরিস্থিতিতে বর্তমানে সংবাদপত্রশিল্পের টিকে থাকাই বড় প্রশ্ন হয়ে সামনে এসেছে। ফলে আমরা সরকারের কাছ থেকে দেশে সংবাদকর্মীদের বেতন-ভাতা, এই শিল্পের ব্যয়, সামগ্রিকভাবে সংবাদপত্রশিল্পকে রক্ষায় সহজ শর্তে ঋণ ও প্রণোদনা জরুরি মনে করছি। একই সঙ্গে সরকারের কাছে পাওনা বিজ্ঞাপনের বিপুল পরিমাণ বিল দ্রুত পরিশোধেরও আবেদন জানাচ্ছি। সেই সঙ্গে সংবাদপত্রশিল্প সংশ্লিষ্ট শুল্ক, ভ্যাট ইত্যাদি নিয়ে জটিলতা নিরসনে দ্রুত সিদ্ধান্ত গ্রহণের দাবি জানাই।
সব পাঠক, সাংবাদিক, বিজ্ঞাপনদাতা, এজেন্ট ও হকারদের এই দুঃসময়ে নিজ অবস্থান থেকে আমাদের পাশে থাকার আহ্বান জানাচ্ছি। সরকারসহ সংশ্লিষ্ট সব মহলের কাছে আমরা সংবাদপত্রশিল্পকে রক্ষায় এগিয়ে আসতে আবেদন জানাচ্ছি।