অনলাইন ডেস্ক:
৮ মার্চ, ১৯৭১। অসহযোগ আন্দোলনে যুক্ত হয় নতুন মাত্রা। এর লক্ষ্য যে একটিই—স্বাধীনতা; তা বুঝতে কারো বাকি থাকে না। ৭ই মার্চের ঐতিহাসিক ভাষণের পর তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানের সব কিছুর কেন্দ্রবিন্দুতে চলে আসেন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। বিচারপতি থেকে শুরু করে সাধারণ মানুষ—সবাই পরিচালিত হতে শুরু করেন তাঁর নির্দেশনা অনুসারে।
বঙ্গবন্ধুর ৭ই মার্চের ভাষণ বাংলাদেশ বেতার থেকে সরাসরি সম্প্রচারের কথা থাকলেও সেনা কর্মকর্তাদের হস্তক্ষেপে তা হতে পারেনি। ফলে জনমনে সৃষ্টি হয় প্রচণ্ড ক্ষোভ। বেতারের বাঙালি কর্মীরা বঙ্গবন্ধুর পূর্বঘোষিত নির্দেশনা অনুসারে কাজ বন্ধ করে দিলে সম্প্রচার মাধ্যমটি অচল হয়ে পড়ে। বাধ্য হয়ে নতিস্বীকার করে প্রশাসন। ৮ মার্চ সকাল সাড়ে ৮টায় ঢাকা বেতার কেন্দ্র থেকে রেসকোর্স ময়দানে দেওয়া বঙ্গবন্ধুর ঐতিহাসিক ভাষণ দিয়ে সম্প্রচার শুরু হয়। ততক্ষণে দেশবাসী ও বিশ্ববাসী জেনে গেছে, আর ফেরার পথ নেই।
এ দিন থেকে কার্যত পূর্ব পাকিস্তানের শাসনভার গ্রহণ করেন বঙ্গবন্ধু। ঢাকাসহ সব শহর-গ্রাম-মফস্বলে সরকারি-বেসরকারি অফিস-আদালত, স্কুল-কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়, কলকারখানা জনগণ স্বতঃস্ফূর্তভাবে বন্ধ করে দেয়। পুলিশ বাহিনী ও ইপিআরের বাঙালি সদস্যরা কার্যত বঙ্গবন্ধুর নির্দেশমতো কাজ করছিলেন। পাকিস্তানের পতাকা প্রদর্শন, জাতীয় সংগীত বাজানো এবং সব প্রেক্ষাগৃহে উর্দু ছবির প্রদর্শনী বন্ধ করে দেওয়া হয়।
‘পূর্ব পাকিস্তান ছাত্রলীগ’ নাম পরিবর্তন করে শুধু ‘ছাত্রলীগ’ করার সিদ্ধান্ত হয়। একই সঙ্গে ছাত্রলীগের কেন্দ্রীয় কমিটি সভায় প্রতিটি জেলা শহর থেকে প্রাথমিক শাখা পর্যন্ত স্বাধীন বাংলাদেশ সংগ্রাম পরিষদ গঠনেরও সিদ্ধান্ত হয়। ছাত্রলীগের সভাপতি নূরে আলম সিদ্দিকী ও সাধারণ সম্পাদক শাজাহান সিরাজ এবং ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কেন্দ্রীয় ছাত্রসংসদ—ডাকসুর ভিপি আ স ম আবদুর রব ও সাধারণ সম্পাদক আবদুল কুদ্দুস মাখন এক যুক্ত বিবৃতিতে বলেন, “বাংলার বর্তমান মুক্তি আন্দোলনকে ‘স্বাধীনতা আন্দোলন’ ঘোষণা করে স্বাধীন বাংলার জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান রেসকোর্স ময়দানের ঐতিহাসিক জনসভায় যে প্রত্যক্ষ কর্মসূচি ঘোষণা করেছেন, আমরা তার প্রতি পূর্ণ সমর্থন জানিয়ে স্বাধীনতা আন্দোলনে ঐক্যবদ্ধভাবে ঝাঁপিয়ে পড়ার জন্য বাংলার সংগ্রামী জনতার প্রতি আহ্বান জানাচ্ছি।’
বঙ্গবন্ধুর ৭ই মার্চের ঘোষণার প্রতি ন্যাপ সভাপতি অধ্যাপক মোজাফ্ফর আহমদ, জাতীয় লীগের আতাউর রহমান খান, বাংলা ন্যাশনাল লীগের অলি আহাদ, পিডিবির নূরুল আমিনসহ বিভিন্ন রাজনৈতিক, সামাজিক ও সাংস্কৃতিক সংগঠনের নেতারা পূর্ণ সমর্থন দেন।
রাতে আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক তাজউদ্দীন আহমদ এক বিবৃতিতে বঙ্গবন্ধুর ৭ই মার্চে ঘোষিত নির্দেশের ব্যাখ্যা দেন। এতে বলা হয়, ব্যাংকগুলো সকাল ৯টা থেকে বিকেল ৩টা পর্যন্ত খোলা থাকবে। বিদ্যুৎ সরবরাহ ও প্রয়োজনীয় বিভাগগুলো খোলা থাকবে। সার সরবরাহ ও পাওয়ার পাম্পের ডিজেল সরবরাহ অব্যাহত থাকবে। পোস্ট অফিস, সেভিংস ব্যাংক খোলা থাকবে। পানি ও গ্যাস সরবরাহ অব্যাহত থাকবে।
সরকারি প্রেসনোটে সাম্প্রতিক আন্দোলনে মাত্র ১৭২ জন নিহত ও ৩৫৮ জন আহত হয়েছে বলে জানানো হয়। তাজউদ্দীন আহমদ পৃথক বিবৃতিতে এ প্রেসনোটের প্রতিবাদ জানান। তিনি বলেন, ‘প্রেসনোটে হতাহতের সংখ্যা অনেক কমিয়ে বলা হয়েছে। নিজেদের অধিকারের সপক্ষে শান্তিপূর্ণভাবে বিক্ষোভরত নিরস্ত্র বেসামরিক অধিবাসীর ওপরই নিশ্চিতভাবে গুলি চালানো হয়েছে।’
সেদিনের পরিস্থিতি সম্পর্কে কথাসাহিত্যিক রশীদ হায়দার লিখেছেন, ‘৮ মার্চে ঢাকার আকাশে দেখা গেল কে এল এম লুফথানসা বি ও এ সি বিমান। এসব যাত্রীবাহী বিমান কখনো ঢাকায় আসে না। এগুলো কেন? জানা গেল বিদেশিরা ঢাকা ছেড়ে চলে যাচ্ছে।’ তৎকালীন সংবাদপত্র বলছে, এ দিন ব্রিটেন ও পশ্চিম জার্মানির ১৭৮ জন ঢাকা ছেড়ে যান।
ব্রিটেনপ্রবাসী প্রায় ১০ হাজার বাঙালি লন্ডনে পাকিস্তানি হাইকমিশনের সামনে স্বাধীন বাংলার দাবিতে বিক্ষোভ দেখান এ দিন।