অনলাইন ডেস্কঃ
১১ বছর আগে (২০০৯ সাল) বিদ্যুতের অভাবে দেশের অর্থনীতি ছিল ভঙ্গুর। শিল্প-বাণিজ্য ছিল স্থবির। জনজীবনে লোডশেডিং ছিল অসহনীয়। বর্তমান সরকার দেশে অবকাঠামো উন্নয়নের পাশাপাশি বিদ্যুৎ ও জ্বালানি সক্ষমতা অর্জনে দূরদর্শী, সাহসী ও সময়োপযোগী সিদ্ধান্ত গ্রহণ এবং বাস্তবায়নের ফলে বিদ্যুৎ খাতে অভূতপূর্ব সাফল্য অর্জিত হয়েছে। দেশের প্রতিটি ঘরে ২০২১ সালের মধ্যে শতভাগ বিদ্যুৎ পৌঁছে দেওয়ার ঘোষণা দেওয়া হয়। ১১ বছর আগে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার ওই ঘোষণা অনেকটা স্বপ্ন মনে হলেও নির্ধারিত সময়ের এক বছর আগেই কাঙ্ক্ষিত লক্ষ্যের দোরগোড়ায় পৌঁছে গেছে সরকারের বিদ্যুৎ বিভাগ। চলতি মুজিববর্ষের আগামী ডিসেম্বরের মধ্যেই শতভাগ বিদ্যুৎ সুবিধার আওতায় নিয়ে আসা হচ্ছে পুরো দেশ। সরকারি ও বেসরকারি যৌথ উদ্যোগের ফলেই মাত্র ১১ বছরে বিদ্যুৎ খাতে বড় ধরনের বিপ্লব ঘটেছে। সরকারি ও বেসরকারি উদ্যোগে মেগাপ্রকল্পগুলো বাস্তবায়িত হচ্ছে। বিদ্যুৎ চাহিদার তুলনায় উৎপাদন বেশি হওয়ায় লোডশেডিং শূন্যের কোঠায় নেমে এসেছে। নবায়নযোগ্য জ্বালানির বড় প্রসার হয়েছে।
নির্ধারিত সময়ের আগে এই (শতভাগ বিদ্যুৎ) লক্ষ্য পূরণে বেশ কিছু প্রতিবন্ধকতাও ছিল। এর মধ্যে প্রত্যন্ত চরাঞ্চলে বিদ্যুতের লাইন নেওয়া ছিল বড় একটি চ্যালেঞ্জ। আবার মানুষ নিজের গ্রাম, আদিনিবাস ছেড়ে ‘মাঠে-প্রান্তরে’ কিংবা নতুন সড়কের পাশে বাড়িঘর তৈরি করছে। ফলে বিদ্যুতের বর্ধিত চাহিদার যোগান দেওয়ার পাশাপাশি সঞ্চালন ও বিতরণ লাইন স্থাপনসহ নানা চ্যালেঞ্জ মোকাবেলা করতে হয়েছে বিদ্যুৎ বিভাগকে। এসব প্রতিকূলতা মোকাবেলা করে সাফল্যের দৃষ্টান্তও স্থাপন করেছে বিদ্যুৎ বিভাগ। মাত্র ১১ বছরে বিদ্যুৎ খাতে যে বিপ্লব ঘটেছে, সেটি প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার দূরদর্শিতায়, প্রতিমন্ত্রী নসরুল হামিদের বলিষ্ঠ নেতৃত্বের কারণে সম্ভব হয়েছে বলে জানান বিদ্যুৎ খাত সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা।
বিদ্যুৎ বিভাগ সূত্র জানায়, স্বাধীনতার ৩৯ বছরে (১৯৭১-২০০৯) যেখানে ৪৭ শতাংশ মানুষ বিদ্যুতের আওতায় এসেছে, সেখানে ২০২১ সালের মধ্যে অর্থাৎ মাত্র ১২ (২০০৯-২০২১) বছরে অবশিষ্ট ৫৩ শতাংশ মানুষকে বিদ্যুতের আওতায় আনার ঘোষণা ‘স্বপ্নের’ মতোই মনে হয়েছিল। তবে প্রধানমন্ত্রীর প্রতিশ্রুতি বাস্তবায়নে কাজ শুরু করে মাত্র ১১ বছরে আরো ৫০.৫০ শতাংশ মানুষকে বিদ্যুতের আওতায় আনতে সক্ষম হয়েছে সরকার। বর্তমানে দেশের ৯৭.৫০ শতাংশ মানুষ বিদ্যুৎ সুবিধা পাচ্ছে। সরকারের রূপকল্পে ছিল ২০২১ সালের ডিসেম্বর, তবে বিদ্যুৎ বিভাগ তা এক বছর এগিয়ে অবশিষ্ট ২.৫০ শতাংশ মানুষকে বিদ্যুৎ সুবিধার আওতায় এনে চলতি বছরের ডিসেম্বর অর্থাৎ মুজিববর্ষেই শতভাগ বিদ্যুৎ সুবিধা ঘোষণা করা হবে। সে লক্ষ্য নিয়েই কাজ করছে বিদ্যুৎ বিভাগ।
বিদ্যুৎ বিভাগের তথ্য মতে, ‘২০০৯ সালে দেশে বিদ্যুৎকেন্দ্রের সংখ্যা ছিল ২৭। বর্তমানে বিদ্যুৎকেন্দ্রের সংখ্যা ১৩৮। মাত্র ১১ বছরে ১১১টি নতুন বিদ্যুৎকেন্দ্র স্থাপন করা হয়। আগে উৎপাদন ক্ষমতা ছিল চার হাজার ৯৪২ মেগাওয়াট। বর্তমানে উৎপাদন ক্ষমতা ২৩ হাজার ৫৪৮ মেগাওয়াট (ক্যাপটিভ ও নবায়নযোগ্যসহ)। ১১ বছর আগে দেশে বিদ্যুতের গ্রাহক সংখ্যা ছিল এক কোটি আট লাখ। বর্তমানে বিদ্যুতের গ্রাহক সংখ্যা তিন কোটি ৭৯ লাখ। আগে আমদানি করা বিদ্যুৎ ছিল না, বর্তমানে এক হাজার ১৬০ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ আমদানি হচ্ছে। গ্রিড সাবস্টেশন ক্ষমতা ছিল ১৫ হাজার ৮৭০ এমভিএ, সেটি বেড়ে এখন হয়েছে ৪৭ হাজার ৩০৪ এমভিএ। সঞ্চালন লাইন ছিল আট হাজার সার্কিট কিলোমিটার, সেটি বর্তমানে ১২ হাজার ২৯৩ সার্কিট কিলোমিটার। বিতরণ লাইন ছিল দুই লাখ ৬০ হাজার কিলোমিটার। বর্তমানে সেটি বেড়ে হয়েছে পাঁচ লাখ ৮২ হাজার কিলোমিটার। বিদ্যুৎ সুবিধাপ্রাপ্ত জনগোষ্ঠী ৪৭ থেকে বেড়ে হয়েছে ৯৭.৫০ শতাংশ। ১১ বছর আগে মাথাপিছু বিদ্যুৎ উৎপাদন ছিল ২২০ কিলোওয়াট ঘণ্টা। বর্তমানে তা বেড়ে দাঁড়িয়েছে ৫১২ কিলোওয়াট ঘণ্টায়। বিতরণ সিস্টেম লস ছিল ১৪.৩৩ শতাংশ, বর্তমানে কমে হয়েছে ৮.৭৩ শতাংশ।’
বিদ্যুৎ ও জ্বালানি খাতের পরিসংখ্যান বিশ্লেষণ করে দেখা গেছে, ‘জ্বালানিসংকটের কারণে ১১ বছর আগে বিদ্যুৎ উৎপাদনে স্থবিরতা দেখা দেয়। পরিস্থিতি উত্তরণে আওয়ামী লীগের নেতৃত্বাধীন সরকার মিশ্র ও নবায়নযোগ্য জ্বালানির ওপর গুরুত্ব দিয়ে পরিকল্পনা গ্রহণ করে। সরকারের পৃষ্ঠপোষকতায় গ্যাসের উৎপাদন দ্বিগুণ হয়। সরকার তেল ও গ্যাসভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্র নির্মাণের পাশাপাশি কয়লা, তরলীকৃত প্রাকৃতিক গ্যাস (এলএনজি), সৌর, বায়ু, বায়োগ্যাসভিত্তিক বিদ্যুৎ উৎপাদনে উদ্যোগ নেয়। সরকারের ধারাবাহিকতা বিদেশি বিনিয়োগকারীদের বাংলাদেশে বিনিয়োগে আগ্রহী করে তোলে। সরকারি-বেসরকারি উদ্যোগে শুরু হয় এলএনজি আমদানি। নীতিমালা সহজ করায় বিভিন্ন বেসরকারি কম্পানিও বিদ্যুৎ খাতে বিনিয়োগ শুরু করে। তা দেশের বিদ্যুৎ খাতকে আরো এক ধাপ এগিয়ে নেয়।’
পাওয়ার সেলের মহাপরিচালক মোহাম্মদ হোসাইন বলেন, ‘২০০৯ সালে বিদ্যুৎ বিধ্বস্ত একটি খাতকে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা দূরদর্শিতা, সাহসিকতা, সততা দিয়ে মাত্র ১১ বছরে সফলতার খাতে পরিণত করেছেন। এ অগ্রগতি বিশ্বজুড়ে সমাদৃত হয়েছে। বর্তমানে চাহিদার চেয়ে বিদ্যুতের উৎপাদন বেশি। আমাদের প্রায় শতভাগ মানুষ বিদ্যুৎ সুবিধার আওতায় চলে এসেছে। আর প্রতিমন্ত্রী নসরুল হামিদের নেতৃত্বে বিদ্যুৎ বিভাগের কর্মীবাহিনী কাজ করেছে বলেই বিদ্যুৎ খাত এ পর্যন্ত আসতে পেরেছে। আমাদের উপদেষ্টা ড. তৌফিক-ই-এলাহী চৌধুরীর অবদানও অস্বীকার করার উপায় নেই। তবে এখনো কিছু অসম্পূর্ণতা রয়ে গেছে, যেমন নিরবচ্ছিন্ন বিদ্যুৎ সেবা ও সাশ্রয়ী বিদ্যুৎ। এসব জায়গাতে এখন আমরা কাজ করছি।’
বিদ্যুৎ, জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ প্রতিমন্ত্রী নসরুল হামিদ বলেন, ‘বাংলাদেশের শতভাগ মানুষের কাছে বিদ্যুৎ পৌঁছে যাচ্ছে, এটা বিদ্যুৎ খাতের বড় বিল্পব। পৃথিবীর ইতিহাসে এটা বিরল। ২০০৯ সালের নির্বাচনে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার ওয়াদা ছিল শতভাগ বিদ্যুতায়ন করা। আওয়ামী লীগের ইশতেহার অনুযায়ী সে ওয়াদা বাস্তবায়িত হচ্ছে। আর নির্ধারিত সময়ের এক বছর আগেই আমরা কাঙ্ক্ষিত লক্ষ্যের দোরগোড়ায় পৌঁছে যাচ্ছি। মুজিববর্ষের মধ্যেই গ্রিড এলাকা শতভাগ বিদ্যুৎ সুবিধার আওতায় আসবে। অফগ্রিড এলাকায় কিছু নতুন চর এলাকা হয়েছে। আগামী বছর আগস্টের আগেই সেসব অফগ্রিড এলাকায়ও সোলার সিস্টেমে শতভাগ বিদ্যুৎ সুবিধা নিশ্চিত করা হবে। মাত্র ১১ বছরে বিদ্যুৎ খাতে যে অভূতপূর্ব পরিবর্তন এসেছে, এর পেছনের কারণ হলো প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার ওপর আস্থাশীল হয়ে বিদেশিরা বিলিয়ন বিলিয়ন ডলার বিনিয়োগ করেছে।’
প্রতিমন্ত্রী আরো বলেন, ‘বর্তমান সরকারের মেয়াদেই বিদ্যুতের গ্রাহকদের স্মার্ট প্রিপেইড মিটারের আওতায় আনা হবে। দেশের সর্বত্র নিরবচ্ছিন্ন বিদ্যুৎ জ্বালানি সেবা নিশ্চিত রাখতে কাজ করা হচ্ছে। একই সঙ্গে গ্রাহক সেবার মান বাড়াতে বিদ্যুৎ বিভাগের সব দপ্তর, প্রতিষ্ঠানকে দ্রুত এন্টারপ্রাইজ রিসোর্স প্ল্যানিংয়ের (ইআরপি) আওতায় নিয়ে আসার তাগিদ দেওয়া হয়েছে। বর্তমানে দেশের ৯৭.৫০ শতাংশ মানুষ বিদ্যুৎ সুবিধার আওতায়। এত বড় সেবা খাত সঠিকভাবে পরিচালনা করতে দ্রুত ডিজিটাল সেবা দিতে হবে। ইআরপি সিস্টেম চালু হলে কেন্দ্রীয়ভাবেই সব মনিটর করা যাবে। গ্রাহক সেবার মানও বৃদ্ধি পাবে।’