অনলাইন ডেস্কঃ
পঁচাত্তরের ১৫ আগস্ট কালরাতে ধানমণ্ডির ৩২ নম্বরে সপরিবারে অত্যন্ত নৃশংসভাবে প্রাণ হারান জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। তখন বিদেশে থাকায় প্রাণে রক্ষা পান জাতির জনকের দুই কন্যা শেখ হাসিনা ও শেখ রেহানা। কিন্তু এই বিদেশ যাওয়া নিয়ে দোটানায় ছিলেন তৎকালীন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের এমএ ক্লাসের ছাত্রী শেখ হাসিনা। এর কারণ প্রিয় শিক্ষক ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের তৎকালীন উপাচার্য ড. আবদুল মতিন চৌধুরীর একটি অনুরোধ। অন্যদিকে স্বামী ড. ওয়াজেদ মিয়ার দিক থেকে তাগাদা ছিল জার্মানি যাওয়ার। শেষ পর্যন্ত শেখ হাসিনা বাবার সঙ্গে বিষয়টি নিয়ে আলোচনা করেই পেয়েছিলেন সমাধান। বঙ্গবন্ধু তাঁকে বলেছিলেন, ‘জামাই যা বলে তা করো।’ এরপর ৩০ জুলাই শেখ হাসিনা পুত্র সজীব ওয়াজেদ জয় ও ছোট বোন শেখ রেহানাকে নিয়ে জার্মানির উদ্দেশ্যে ঢাকা ছাড়েন।
বিদেশ যাওয়া নিয়ে এই দোটানার বিষয়ে বঙ্গবন্ধুকন্যা শেখ হাসিনা ‘ড. আবদুল মতিন চৌধুরী : আমার স্মৃতিতে ভাস্বর যে নাম’ শিরোনামে স্মৃতিচারণামূলক একটি লেখায় তাঁর বিস্তারিত বর্ণনা করেছেন। তিনি ঘটনাটিকে এভাবে লেখেন, ‘দিনটি ছিল ১৯৭৫ সালের জুলাই মাসের শেষের একটি দিন। …… আমি তখন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের এমএ ক্লাসের ছাত্রী। আমার কয়েক মাসের ছুটির প্রয়োজন। কেননা আমাকে যেতে হবে পশ্চিম জার্মানিতে। সেখানে তখন আমার স্বামীর কর্মস্থল। সুতরাং ছুটির প্রয়োজনে এবং সবিশেষভাবে দেখা করে আশীর্বাদ চাইবার ইচ্ছায় আমি উপাচার্য ভবনে ড. আবদুল মতিন চৌধুরীর সঙ্গে দেখা করতে গেলাম। সেদিন আমার সঙ্গে ছিল ছোট বোন রেহানা এবং ছোট ভাই জামালের নবপরিণীতা স্ত্রী রোজী।’
শেখ হাসিনা তাঁর স্মৃতিচারণায় এই সম্পর্কে আরো বলেন, ‘আমি দেখা করে বিদেশ যাওয়ার কথা বলায়, তিনি (উপাচার্য আবদুল মতিন চৌধুরী) প্রথমে আমাকে নিষেধ করলেন। আমি ড. ওয়াজেদের সেখানে একাকিত্বের কথা বলায় তিনি বলেন, তাহলে যেন কয়েকটি দিন অপেক্ষা করে ১৫ (আগস্ট, ১৫) তারিখের অনুষ্ঠানটির পরে রওনা করি। এরপর তিনি আমাকে আগতপ্রায় ওই ঐতিহাসিক দিনটি যে শিক্ষাঙ্গনসমূহে স্মরণকালের সবচেয়ে তাৎপর্যপূর্ণ দিন সম্পর্কে এবং ওই দিনের গৃহীত কর্মসূচির বিষয়ে আলাপ করলেন। পরে তিনি আবার আমাকে ১৫ তারিখ পর্যন্ত থেকে যেতে অনুরোধ করলেন।’
পঁচাত্তরের ১৫ আগস্ট রাষ্ট্রপতি শেখ মুজিবুর রহমানের ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের একটি অনুষ্ঠানে উপস্থিত থাকার কথা ছিল। উপাচার্য ড. আবদুল মতিন চৌধুরী সেই অনুষ্ঠানের গুরুত্ব বুঝিয়ে তাঁর ছাত্রী শেখ হাসিনাকে ১৫ আগস্টের পরে জার্মানি যাওয়ার অনুরোধ করেন। এই অনুরোধের পর বিদেশে যাওয়া নিয়ে দ্বিধাগ্রস্ত হয়ে পড়েন শেখ হাসিনা। এ সম্পর্কে ওই লেখায় তিনি উল্লেখ করেন, ‘স্যারের অনুরোধে আমি ভীষণ দ্বিধাগ্রস্ত হয়ে পড়ে গেলাম। আমি ভাবতেও পারিনি যে তিনি আমাকে থেকে যেতে বলবেন। সুতরাং অপ্রস্তুত হয়ে পড়লাম। কেননা আজীবন শিক্ষকদের কথা মান্য করার শিক্ষাই পেয়ে এসেছি। অথচ আর একটি দিন পরই আমার ফ্লাইট। স্যারকে বললাম, আমি আর একবার বিষয়টি ভেবে দেখছি এবং থেকে যেতেই চেষ্টা করব।’
বঙ্গবন্ধুকন্যা শেখ হাসিনা লিখেছেন, ‘দ্বিধাগ্রস্ত মন নিয়েই বাসায় ফিরলাম এবং ফিরে এসেই মাকে স্যারের অনুরোধের কথাটি বললাম। কয়েক দিন আগে থেকেই আমার ছেলে জয়ের খুব জ্বর এসেছিল। সুতরাং থেকে যেতেই মনস্থির করে ফেললাম। কিন্তু সন্ধ্যায় ড. ওয়াজেদের ফোন এলো জার্মানি থেকে। আমি ওয়াজেদকে স্যারের অনুরোধ এবং ১৫ তারিখে থেকে যাওয়ার ব্যাপারে আমার ইচ্ছার কথা জানালাম। আরো বললাম, একদিকে জয়ের জ্বর, অন্যদিকে ১৫ তারিখের অনুষ্ঠান—আমি খুব দ্বিধাগ্রস্ত হয়ে পড়েছি। উত্তরে আমার স্বামী জানালেন যে তিনি এরই মধ্যে ছুটি নিয়ে ফেলেছেন এবং বাজারও করে ফেলেছেন। অগত্যা আমি যাওয়াই স্থির করলাম। ৩০ জুলাই আমি ঢাকা ছাড়লাম। আর ৩১ জুলাই জার্মানি পৌঁছুলাম। আমার আর স্যারের অনুরোধ রাখা হলো না।’
১৯৭৫-এর জুলাইয়ের শেষ সপ্তায় বঙ্গবন্ধুকন্যা শেখ হাসিনা উপাচার্য আবদুল মতিন চৌধুরীর সঙ্গে সাক্ষাৎ করেছিলেন—এ ধরনের কোনো রেকর্ড ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে রয়েছে কি না—এই প্রশ্নের জবাবে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক উপাচার্য অধ্যাপক আ আ ম স আরেফিন সিদ্দিক বলেন, ‘না, সে রকম কোনো রেকর্ড আমি দেখিনি। আর থাকার কথাও নয়। কারণ বিষয়টি ছিল প্রতিষ্ঠানের একজন ছাত্রীর তাঁর শিক্ষকের (উপাচার্য) সঙ্গে সাক্ষাৎ। তবে ঘটনাটি আমি নেত্রীর মুখ থেকে বিভিন্ন সময় শুনেছি।’ তিনি প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার স্মৃতিচারণা উদ্ধৃত করে বলেন, “প্রিয় ভিসি স্যারের থেকে যাওয়ার অনুরোধ, আবার বিদেশে স্বামীর একাকিত্ব, সেখানে যাওয়ার তাগিদ। এই দুই মিলিয়ে নেত্রী দোটানায় পড়ে যান। তখন বিষয়টি নিয়ে পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের সঙ্গে আলোচনা করেন। তখন বঙ্গবন্ধুই সেই সমাধান দিয়ে দেন। বলেন, ‘জামাই যা বলে তাই করো।’ এরপর দোটানামুক্ত হয়ে বিদেশে যাওয়ার সিদ্ধান্তই নেন শেখ হাসিনা।”
এর ঠিক ১৫ দিন পর ১৫ আগস্ট ইতিহাসের নারকীয় ঘটনায় সপরিবারে প্রাণ হারান জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। বিদেশে থাকায় প্রাণে বেঁচে যান দুই বোন শেখ হাসিনা ও শেখ রেহানা।
বঙ্গবন্ধুকে হত্যার পর ড. আবদুল মতিন চৌধুরীকে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে সরিয়ে দেওয়া হয়। গ্রেপ্তার করে তাঁর ওপর অকথ্য নির্যাতনও চালানো হয়েছিল। দীর্ঘদিন জেল খাটার পর ১৯৭৮ সালে আবদুল মতিন চৌধুরী মুক্তি পান এবং বঙ্গবন্ধু হত্যার বিচারের দাবিতে আন্দোলন শুরু করেন। ১৯৮১ সালের ২৪ জুন তিনি মৃত্যুবরণ করেন।